গান্ধীজীর দৃষ্টিতে সঙ্ঘ পরিবার


বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সঙ্ঘ বিরোধী ব্যক্তিত্বরা প্রমাণ ছাড়াই বলে থাকেন সঙ্ঘ গান্ধী বিরোধী।তা ঘুনাক্ষরেও সত্য নয়। কারণ, সঙ্ঘ কখনই গান্ধী বিরোধী ছিল না। না ! তো, গান্ধীজী সঙ্ঘ বিরোধিতা করতো।তাই একটা ঘটনা বলি,
১৯৩৪ সালের ২৪ডিসেম্বর মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ডা জেলার গান্ধীজীর সত্যাগ্ৰহ আশ্রমের কাছেই সেবাগ্ৰাম রোডে সেই সময় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শীতকালীন প্রশিক্ষণ শিবির চলছিল। ২৩ডিসেম্বর আগের দিন রাতেই বিভিন্ন রাজ্যের জেলা শহরতলি, গ্ৰাম,ও খন্ড অনুসারে স্বয়ংসেবকরা আসতে লাগলেন সেই শিবিরে অংশগ্রহণ করার জন্য। কেউ ট্রেনে, কেউ বাসে, কেউ গরুর গাড়িতে, আবার কেউ কেউ পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে শুরু করলো শিবিরে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা স্বয়ংসেবকদের সংখ্যাও ছিল ১৫০০জন। যা শিবিরের আয়োজনের থেকেও ২০০ জন বেশি। শিবিরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আশ্রমিকরাই উপস্থিত ছিলেন। ফলে শিবিরে সম্পূর্ণ জায়াগা পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।২৫ ডিসেম্বর সরসঙ্ঘচালক পূজনীয় ডাক্তারজী এসে পৌঁছালেন শিবিরে।
এদিকে গান্ধীজী ওয়ার্ডার আশ্রমের বাড়ির ছাদ থেকে শিবিরে চলাকালীন কার্যক্রম প্রত্যক্ষ অনুভব করতে লাগলেন, কি সুন্দর অনুশাসন বদ্ধ পরিকরের মধ্যে দিয়ে চলছে সঙ্ঘের শীতকালীন প্রশিক্ষণ শিবির।‌যা ভোরের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আত্মত্যাগ, ও বীরত্বের প্রতীক পরম পবিত্র গৈরিক ধ্বজকে সাক্ষী রেখে ” নমস্তে সদা বৎসলে মাতৃভূমে/ ত্বয়া হিন্দুভূমে সুখং বর্ধিতোহহম্।” প্রার্থনায় সকলে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মাতৃ আরাধনায় কোমর বেঁধে ভারত মায়ের কাছে সিংহ বিক্রমের দুর্জয় শক্তির আরাধনায় মিলিত হয়ে একসাথে সকলে বলে চলেছেন,

              "প্রভো শক্তিমন্ হিন্দুরাষ্ট্রাঙ্গভূতা
                হিমে সাদরং ত্বাং নমামো বয়ম্
                ত্বদীয়ায় কার্যায় বদ্ধা কটীয়ং
                শুভামাশিষং দেহি তৎপূর্তয়ে।
                অজয়্যাং চ বিশ্বস্য দেহীশ শক্তিম্
                সুশীলং জগদ্ যেন নম্রং ভবেৎ
                 শ্রুতং চৈব যৎ কন্টকাকীর্ণমার্গম্
                 স্বয়ং স্বীকৃতং নঃ সুগং কারয়েৎ।।"

যা গান্ধীজী কে মনোমুগ্ধ করেছিল।

তিনি এও সচক্ষে দেখলেন, কিভাবে শক্তিমন প্রভুর কাছে ভারত মায়ের নিঃস্বার্থ সেবা করার জন্য স্বয়ংসেবকরা কোটিবদ্ধ হয়ে পূর্ণভূমি, মাতৃভূমি ভারত মায়ের চরণতলে নিরন্তর প্রণাম জানিয়ে তারা আশিষ চেয়ে নিচ্ছেন। যাতে,বিনম্র, বিশুদ্ধ ও শুভ চেতনা বুদ্ধি সম্পন্ন চরিত্রের অধিকারী হয়ে কন্টকময় পথকে সুগম করিতে পারে।
পরের দিন অর্থাৎ ২৬শে ডিসেম্বর সঙ্ঘ প্রভাবের আলো কাছ থেকে দেখার জন্য মহাত্মা গান্ধীজী একটি চিঠি লিখে শিবিরে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন । শেঠ যমুনালালের ছেলে কমলনয়ন বাজাজ গান্ধীজীর পক্ষ থেকে একটি চিঠি নিয়ে হাজির হলেন ডাক্তারজীর কাছে। চিঠিটি হাতে নিয়ে খোলা মাত্রই দেখলেন গান্ধীজী শিবিরে আসতে চাইছেন নিজের থেকে। তাই অধীর আগ্ৰহের সাথে খুশি হয়ে ডাক্তারজী আশ্রমে গেলেন গান্ধীজীকে শিবিরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে। গান্ধীজীও খুব খুশি হলেন এত বড়ো সংগঠনের নেতা, সমাজ গড়ার কারিগর, স্বয়ং নিজে এসেছেন তাঁর কাছে।
তাই পরের দিন সকাল ছয়টা পনেরো মিনিটে ডাক্তারজীর আমন্ত্রণে শিবিরে এসে পৌঁছালেন গান্ধীজী, মীরা বেন, ও মহাদেব দেশাই সহ আরো পঁয়ত্রিশ জন। গান্ধীজী কে দেখা মাত্রই প্রত্যেক স্বয়ংসেবক আনন্দিত ও উচ্ছাসিত হয়ে ফুলের মালা পড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।
শুরু হয়ে গেল বাঁশির ফুঁ তে তরুণ,যুবক, বালক,ও শিশু চারটি বিভাগে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সঙ্ঘ দক্ষের ভঙ্গিমাতে ধ্বজত্তোলন। গান্ধীজীও সেই মত দক্ষ অবস্থায় দাঁড়িয়ে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের সাথে ডান হাত বক্ষে রেখে ধ্বজ প্রণাম করলেন। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ছিল সেদিন। সহস্র জনগণের নেতা ভোরের হিমেল হাওয়ায় সূর্য আলোকে গৈরিক ধ্বজকে পুরোভাগে রেখে ১৫০০ জন স্বয়ংসেবকদের সাথে প্রণাম করছেন।
এরপর গান্ধীজীকে শিবিরের সকল বিভাগ ঘুরিয়ে দেখালেন পরম পূজনীয় ডাক্তারজী। ভোজন কক্ষে নিয়ে গেলেন, যেখানে ৫০জন স্বয়ংসেবক রান্নার কাজে নিয়োজিত ছিল। সেই ভোজন কক্ষ এতটাই গোছানো,ও পরিচ্ছন্ন ছিল যে গান্ধীজী কে খুব সহজেই আকৃষ্ট করেছিল। তিনি ডাক্তারজীকে বললেন, যেখানেই গেছি সাধারণত রান্নার জায়গা দেখেছি অগোছালো ও অপরিচ্ছন্ন থাকে।পায়ের জুতো থাকে এদিক-সেদিক ছোঁড়া অবস্থায়। কিন্তু আপনাদের তো দেখছি অদ্ভুত ব্যতিক্রমি। পায়ের জুতোও কি সুন্দর দু-তিনটে সারিতে ভাগ করে রাখা আছে। খাওয়ার সময় কখন ? ডাক্তারজীকে জিগ্গেস করতে লাগলেন গান্ধীজী।
‘এগারোটা থেকে বারোটা।’
মাত্র এক ঘণ্টায় সমগ্ৰ শিবিরের খাওয়ার পাট চুকে যাবে? ডাক্তারজীর হ্যাঁ শুনে, গান্ধীজী বিস্মৃত হলেন।
এরপর স্বয়ংসেবকদের ভোজন চলাকালীন গান্ধীজী সেখানে উপস্থিত হয়ে লক্ষ্য করলেন, সকল শ্রেনী বর্ণের মানুষ একসাথে মাটিতে আসন পেতে বসে ভোজন মন্ত্র উচ্চারণ করে ভোজন শুরু করছে । যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বী মানুষ।যাদের আচার, অনুষ্ঠান ও আচরণ পদ্ধতিও আলাদা। কেউ মরাঠী, কেউ তামিল, কেউ বাঙ্গালী, তো আবার কেউ ওড়িয়া। জাত পাতের উর্ধ্বে উঠে আশ্রমিক থেকে শুরু করে,গরীব-বড়োলোক সবাই মাতৃ মন্ত্রের দীক্ষা নিয়ে দেশ সেবার মতন মহান কাজে মিলিত হয়েছে প্রাচীন ও শ্বাশত গুরু গৈরিক ধ্বজের চরণতলে।পরম পূজনীয় কেশবরাও দীক্ষীতের একটি কবিতার ভাষায়, ” হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই/ঠাঁই ঠাঁই থাকবো না/ এক মনেতে ভালোবেসে কখনোই দূরে থাকবো না।”
তাই তো গৈরিক ধ্বজের চরণতলে আসলে মন শুদ্ধ হয়।শুভ বুদ্ধি চেতনা জাগ্ৰত হয়। যেখানে সকল শ্রনীর মানুষের প্রতি নিজের মায়ের পেটের ভাই মতন সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এরপর শিবির চলাকালীন গণবেশ পরিহিত স্বয়ংসেবকদের সাথে গল্প গুজবের ছলে জিগ্গেস করলেন, তোমরা যে গণবেশ কেনার জন্য বাড়িতে টাকা চাও বাড়িতে বকাবকি করে না? তখন এক স্বয়ংসেবক বলে উঠলো, না ! কারণ, দেশের জন্য যখন কাজ করবো বলি সঙ্ঘে যুক্ত হয়ে।তখন এই কথা শুনে বাড়ির লোক গর্ববোধ করেন।কারণ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ দেশ ও সমাজ কল্যাণের হিতে কাজ করেন।তাই সঙ্ঘ শিবিরে যুক্ত হতে গেলে গণবেশ পরা অতি আবশ্যক। আপনি যদি সঙ্ঘের নিত্য শাখায় দেখেন, তাহলে ওখানে গণবেশ না পড়েও আপনি সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক হয়ে নিত্য শাখায় আসতে পারবেন। কিন্তু গণবেশ ছাড়া আপনি সঙ্ঘের শিবিরে অংশগ্ৰহণ করতে পারবেন না।
এরপর একটু ঘুরিয়ে অন্য দিক দিয়ে প্রশ্ন করলেন এক ব্রাহ্মণ স্বয়ংসেবক কে, তোমরা উঁচু জাতের লোক হয়ে কি করে নিচু জাতের সাথে থাকো, খাও, একসাথে ঘুমাও? একে কি অপমান মনে করো না?
তখন প্রত্যেক স্বয়ংসেবক একই সুরে বলে উঠলেন, সঙ্ঘে এই সব জাত পাতের বিভেদ আমরা মানি না। আর আমরা মানতে চাইও না।আমরা সকলেই হিন্দু, সকলেই আমার ভাই। এটাই আমাদের পরিচয়।
গান্ধীজী স্বয়ংসেবকদের ধ্যায় নিষ্ঠা, আদর্শ, অনুশাসন, ও দেশের জন্য সর্বোপরি ত্যাগ দেখে খুব খুশি হলেন।স্বয়ংসেবকদের শৃঙ্খলাপূর্ণ কার্যক্রম গান্ধীজীর এত হৃদয়গ্ৰাহ্য হয়েছিল যে, তিনি ডাক্তারজীর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘আমি অত্যন্ত খুশি, দেশের কোথাও আমি এই রকম নির্মল এত সুন্দর দৃশ্য দেখি নি আগে। গান্ধীজীর কাছে, ” সঙ্ঘ শক্তি দেশ শক্তি/একক শক্তি কিছুই নয়/সংগঠনই মুক্তির পথ/অন্য কোন পথই নাই।”
যা আপনাদের সঙ্ঘ পরিবারে এসে আজ প্রতক্ষ্য পরোক্ষভাবে অনুভব করলাম।আর তিনি সঙ্ঘে এসে এটাও বুঝলেন যে সঙ্ঘ সাধনায় একমাত্র ভারতকে অজেয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবে।

                        * সমাপ্ত*

কৌশিক দাস ( ঝাড়গ্ৰাম )
তারিখ : ১৭/০৪/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.