ভারতের উদ্বাস্তু বাঙালদের উত্তরপ্রজন্ম- বোঝে কি যাতনা ?

ভারতবর্ষে ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় থেকেই পূর্ববঙ্গেরবাঙালদের উদ্বাস্তু জীবনের শুরু। এর আগে তারা লেখাপড়া এবং চাকরিসূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও অধিকাংশেরই শিকড় প্রোথিত ছিল পূর্ববঙ্গে, ছুটি পেলেই তারা শিকড়ের টানে ছুটে আসতো।ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় থেকেই স্ব-ভূমি থেকেবাঙালদের এই শিকড় উৎপাটনের শুরু। দাঙ্গা? পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা? ভুল হচ্ছে আমার!দাঙ্গা হয়েছিল কলকাতায়, দাঙ্গা হয়েছিল বিহারে, দাঙ্গা হয়েছিল পাঞ্জাবে। পূর্ববঙ্গে বা পূর্ব পাকিস্তানে অথবা বাংলাদেশে কখনোই দাঙ্গা হয়নি; এখানে একতরফাভাবে হিন্দুদের নিপীড়ন এবং হত্যাকরা হয়েছে। একতরফা নিপীড়ন এবং হত্যাকে আর যাই হোক দাঙ্গা বলা যায় না। বললে কলকাতা, বিহার এবং পাঞ্জাবের দাঙ্গার মান খর্ব করা হয়!দু-পক্ষে সমানে সমানে কিংবা ঊনিশ-বিশ অথবা নিদেনপক্ষে দশ-বিশের লড়াই না হলে কি তাকে দাঙ্গা বলা যায়? যা না। এখানে হিন্দুরা একতরফাভাবে নিপীড়ন এবং হত্যার শিকার হয়েছে, কোনোরকম প্রতিরোধ গড়ার পরিবর্তে হিন্দুরা প্রাণভয়ে যে যেভাবে পেরেছে পালিয়েছে। সেই যে ১৯৪৬ সালে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালদেরমানবট্রেনের যাত্রা শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা-আসাম অভিমুখে, আজ এতো বছর বাদে এই ২০১৯ সালেও ছেচল্লিশের সেই মানবট্রেনটি চলছে! বাংলাদেশের শেষ হিন্দু মানুষটি যেদিন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পাড়ি দেবে, সেদিনই যেন ট্রেনটি বিলীন হবে! অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের গবেষণা মতে, গড়ে প্রতিদিন বাংলাদেশ ত্যাগ করছে ৬৩২ জন হিন্দু। বাস্তব পরিসংখ্যান হয়তো আরো বেশি।

১৯৪৬ সালে যে-সবউদ্বাস্তু প্রথম ভারতে পা রেখে জীবনের নতুন স্বাদ পেয়েছিল, এখন হয়তো সেখানে তাদের তৃতীয়-চতুর্থ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। এরপরে আরো যে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু বাঙাল ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের কারো হয়তো দ্বিতীয় প্রজন্ম চলছে, কারো হয়তো প্রথম প্রজন্ম। আমি এখন এই লেখাটি লিখছি, ঠিক এই সময়ও নিশ্চয় অনেকেমাতৃভূমি ছেড়ে যাত্রা শুরু করেছে ভারতের উদ্দেশ্যে, যারা আর ফিরবে না।

এই যে ভারতে উদ্বাস্তু বাঙালদের উত্তরপ্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, বেড়ে উঠছে; তারা কি জানে যে কেন, কোন পরিস্থিতিতে, কী অবস্থায় তাদের পূর্ব-পুরুষেরা ভিটে-মাটি, ঘর-বাড়ি, ধানের গোলা, হালের বলদ, দুধেল গাই, পুকুর, ফসলি জমি ফেলে, সাধের জন্মস্থান ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল ভারতে?

৭১ এ ভারত অভিমূখী বাংলাদেশের শরনার্থী

উদ্বাস্তু বাঙালদের বিরাট অংশ ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছে। লেখাপড়া এবং কর্মসূত্রে তাদের অনেকেই ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতবর্ষে, এমনকি ভারতের বাইরেও। তবে অধিকাংশেরই বাস পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরায়। এই যে ১৯৪৬ থেকে ২০১৯, এই দীর্ঘ সময়ে ভারতের অর্থনীতি বদলেছে, বদলেছে মানুষের জীবন-যাপনের ধরণ। একদিন যে উদ্বাস্তু বাঙাল স্টেশনের প্লাটফর্মে কিংবা রেললাইনের পাশের ঝুপড়ি ঘরে বাস করতো, এখন তারউত্তরপ্রজন্ম হয়তো দালানে থাকে;একদিন যে উদ্বাস্তু বাঙাল বাড়ি থেকে খোরমা কিংবা লতিকা বানিয়ে বনগাঁ লোকালে ফেরি করে বিক্রি করতো, এখন তার উত্তরপ্রজন্ম হয়তো কোনো নামী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর হেড অব মার্কেটিং; একদিন যে উদ্বাস্তু বাঙালপূর্ববঙ্গ থেকে এক কাপড়ে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, আজ তার উত্তরপ্রজন্মের বাড়িতে হয়তো কাপড় রাখার চারটে আলমারি; একদিন যেউদ্বাস্তু বাঙাল ক্ষুধার তাড়নায় কিংবা ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে খাবার তুলে দিতে রেললাইনের ধারের ঝোপঝাড়ের আড়ালে শরীর বিকোতো, এখন তার উত্তরপ্রজন্ম হয়তো কলকাতা কিংবা মুম্বাইয়ের কোনো পাঁচ তারকা হোটেলের ড্যান্সার; একদিন যে উদ্বাস্তু বাঙাল ঘটিবাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় মাংসের ঘ্রাণ পেয়ে পূর্ববঙ্গের হারানো বিত্ত-বৈভবের কথা স্মরণ করে কেঁদে ফেলতো, এখন হয়তো তার উত্তরপ্রজন্ম প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে প্রায়ই সন্ধ্যায় নামী রেস্টুরেন্টের মোলায়েম আলোয় প্লেটে সাজানো নরম মাংসে কামড় বসায়।

এই যে বাঙালদের পরিবর্তিত উত্তরপ্রজন্মের কথা বললাম, এদের অনেকের মুখেই আজ গদগদ পাকিস্তানপ্রীতির কথা শোনা যায়; যেন পাকিস্তানের প্রশংসা করলে, পাকিস্তানীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে, ভারতে অসংখ্য শিল্পী থাকতেওপাকিস্তানী শিল্পীর গান সিনেমায় ব্যবহার করলে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে প্রমাণ করা যায়!কী যে মারিয়া প্রচেষ্টা এদের, নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করার, এমনকি নিজের দেশকে ছোট করে হলেও!অথচ ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল বলেই এদের পূর্বপুরুষেরা সব হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছিল; পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল বলেই এদের কারো কারো পূর্ব-পুরুষকে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল, যারা পরবর্তীতে পালিয়ে ভারতে গিয়ে পুনরায় স্ব-ধর্মে ফিরে যায়; পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল বলেই এদের অনেকের বংশের কুলনারী ধর্ষিত হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের জন্ম, একজন অসাম্প্রদায়িকের পক্ষে সেই রাষ্ট্রকে কেবল ঘৃণা করাই সম্ভব, ভালবাসা নয়; সেই ইতর রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব তো নয়ই।

অথচ তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক সেজে থাকার নেশায় আজকের অনেক বাঙাল নিজেকে পাকিস্তানপ্রেমী হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করে; ভারতবর্ষে ইসলামের আবির্ভাব এবং মুসলিম শাসনের যে বর্বর ইতিহাস, তা মাটিচাপা দিতে চায়; এমনকি মুসলিমদের অন্যায় কিংবা অসভ্য প্রথাকেও প্রশ্রয় দেয়।

মুসলিমদের তিন তালাক প্রথা কেবল অন্যায় নয়, একটি বর্বর প্রথা। অথচ ভারতে যখন মুসলিমদের এই অসভ্য প্রথাটি নিষিদ্ধ করলো বিজেপি সরকার, তখন রাজনৈতিক কারণে এর বিরোধিতা করলো কংগ্রেস, তৃণমুল, বামপন্থীরা।তাদের ভাষ্য মতে মুসলিম বিদ্বেষ থেকেই নাকি বিজেপি সরকার তিন তালাক নিষিদ্ধ করেছে। অথচ এই তিন তালাকের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেনতালাকপ্রাপ্ত পাঁচজন মুসলিম নারী- সায়রাবানো, আফরিনরহমান, গুলশানপারভিন, ইশরাতজাহানওআতিয়াসাবরি। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছি কোনো কোনো বাঙাল তিন তালাক বহাল রাখার পক্ষে কথা বলেছেন। বিজেপি’র হাজারটা দোষ থাকতে পারে, তার সমালোচনাও করা যেতে পারে। তাই বলে রাজনৈতিক কারণে বা নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের জন্য বিজেপি বিরোধীতা করতে গিয়ে বর্বরতার পক্ষ নিতে হবে?ব্যাপারটা এমন যে বিজেপি যদি বলে, ‘মানুষ হত্যা অপরাধ।’ তাহলে বিজেপি’র বিরোধীতা করতে বা নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতে কি বলতে হবে যে মানুষ হত্যা অপরাধ নয়?

ভারত সরকার যখন সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করলো, তখন মুসলিমদের সঙ্গে সুর তুলে মাতম করতে দেখেছি অসংখ্য বাঙালকে। ৩৭০ ধারা বহাল থাকুক, মুসলিমরা তা চাইবেই; শুধু ৩৭০ ধারা বহাল কেন, মুসলিমরা চায় কাশ্মীর স্বাধীন হোক, যেমনি তারা পাকিস্তানের স্বাধীনতা চেয়েছিল। শুধু কাশ্মীর নয়, অধিকাংশ মুসলিম চায় ভারত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাক!যেমনি পাকিস্তান পেয়েছিল, তেমনি ভারতের আরো কয়েকটি টুকরো পাক মুসলিমরা। তারপর সেই কয়েক টুকরো মুসলিম ভূ-খণ্ড থেকে পিটিয়ে তাড়াবে হিন্দুদের, নয়তো ধর্মান্তরিত করে মুসলিম বানাবে। ভোটের সমীকরণের কারণে কংগ্রেস, তৃণমুল, বামফ্রন্ট এই সহজ সত্যটি স্বীকার করতে চায় না।অন্ধভাবে এইসব রাজনৈতিক দলকে অনুসরণ করে কিছু বুদ্ধিজীবী এবং নানা শ্রেণি-পেশার কিছু মানুষ। এদের বিরাট অংশ আবার মুসলিমদের তাড়া খেয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে নেংটি পরে পালানো বাঙালদের বংশধর!

রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে যে করেই হোক কিছু বাঙাল অসাম্প্রদায়িক তকমা পেতে চায়। অবশ্যই মানুষকে অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো এরা অসাম্প্রদায়িক সাজতে চায়, এদের কাছে অসাম্প্রদায়িক থাকা মানে হলো মুসলিমদের খুশি রাখা, মুসলিমদের কাছ থেকে একটা অসাম্প্রদায়িক সার্টিফিকেট পাওয়া!ফলে মুসলিম দেশগুলোতে অমুসলিমদের ওপর নিপীড়ন এবং হত্যার বিষয়ে এরা চুপ থাকে; আইসিস, আল কায়েদা, লস্কর-ই তৈয়বা’র নিরীহ মানুষ হত্যার বিষয়ে চুপ থাকে; কোরানের সভ্যতাবিধ্বংসী আয়াতগুলো নিয়ে মুখে টু শব্দটি করে না; এরা বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করে, অথচ মুসলিমদের আদম-হাওয়ার কাল্পনিক গল্প নিয়ে প্রশ্ন তোলে না!

এভাবে নির্দিষ্ট একটি ধর্মের মানুষের প্রতি অন্ধ থেকে কি নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করা যায়? যায় না। অসাম্প্রদায়িক হতে গেলে সকল ধর্মের বা শ্রেণির মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে তর্জনী তুলতে হয়, সকল ধর্মের কু-সংস্কারের বিরুদ্ধে সমানভাবে কথা বলতে হয়। এই তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক বাঙালদের অধিকাংশ-ই কিন্তু আবার নিজের কিংবা পরিবারের কারো বিয়ের সময় সমগোত্রের পাত্র বা পাত্রী খোঁজে!

দুজন বাঙাল বুদ্ধিজীবীর কথা না বললেই নয়; একজন লেখক অরুন্ধতী রায়, আরেকজন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। দুজনেরই শিকড় পূর্ববঙ্গে।

অরুন্ধতী রায়, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী। কি বামপন্থী বুদ্ধিজীবী কি বামপন্থী রাজনীতিক, এরা প্রায় সকলেই এখন বামৈস্লামিক (সত্যিকারের বামপন্থীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে), যেন আল-কায়েদা বা আইসিসপন্থীদের মডারেট ভার্সন!দেশবিরোধীতা যেন এদের রক্তে মিশে আছে!অরুন্ধতী রায় এই ঘরানার, তিনি নাকি নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলেন! তার ভাষায় ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরের মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চালায়। তাই তিনি কাশ্মীরের স্বাধীনতা চান। আচ্ছা, অরুন্ধতী কি এই সত্য বলতে পারবেন যে কি করে হিন্দু-বৌদ্ধদের কাশ্মীরে জনসংখ্যার ৬৮ ভাগ মুসলিম হলো? তিনি কি এই সত্য বলতে পারবেন যে কাশ্মীরের বিখ্যাত জুম্মা মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে তরাদেগা (৬৯৭ খৃষ্টাব্দ) নামক একজন হিন্দু রাজা কর্তৃক নির্মিত প্রাচীন মন্দিরের ওপর? তিনি কি এই সত্য বলতে পারবেন যে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের বহু মসজিদ এবং খানকাহ্ দাঁড়িয়ে আছে মুসলিমদের হাতে ধ্বংস হওয়া হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈনদের মন্দির ও শিখদের গুরুদুয়ারার জায়গার ওপর?তিনি কি এই সত্য বলতে পারবেন যে কাশ্মীরের সুফিরা কিভাবে মুসলিম শাসকদেরকে প্ররোচিত করেছে হিন্দুদের হত্যা, ধর্মান্তর এবং তাদের মন্দির ধ্বংস করার জন্য?তিনি কি এই সত্য বলতে পারবেন যে সুলতান মামুদ কিভাবে অমুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল?তিনি কি এই সত্য বলতে পারবেন যে বখতিয়ার খিলজী কিভাবে নালন্দা, বিক্রমশীলা, পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহারে গণহত্যা চালিয়েছিল এবং ধ্বংস করেছিল?

পারবেন না, অরুন্ধতী রায়ের মতো বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এই সত্য বলতে পারবেন না, এই সত্য বলার সাহস তারা কখনোই দেখাবেন না। তাহলে মুসলিমরা তাদেরকে সাম্প্রদায়িক বলবে, তাদের প্রাণ সংশয় হবে, মুসলিম দেশগুলোতে ঢুকতে পারবেন না। আরো কতোসব গুপ্ত কারণ আছে! তাই অরুন্ধতী রায়দের একপেশে কথা বলতে হয়, বলে যান আজীবন।

অরুন্ধতী রায় আধা বাঙাল। তার বাবার নাম রাজীব রায়, বরিশালের সন্তান। অরুন্ধতী রায় কি কখনো তার নিজের শিকড় খোঁজার চেষ্টা করেছেন?তিনি কি জানার চেষ্টা করেছেন যে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলে তার বাবা বসবাসের জন্য পাকিস্তানকে বেছে না নিয়ে ভারতকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?

অরুন্ধতী রায় কেবল রেস্টুরেন্টে কাটলেট খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে জীবন পর করে দেওয়া নির্বোধ বাঙাল নন, তিনি ধূর্ত শেয়াল। তিনি ইতিহাস জানেন, কিন্তু চিন্তা প্রকাশে অসৎ। অসৎ বলেই এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলতে পেরেছেন-‘India deployed its military against its own people. The state of Pakistan has not deployed its army against its own people the way the democratic Indian state has.’

কী ডাঁহা মিথ্যাচার, কী ইতিহাস বিকৃতি, কী সীমাহীন নির্লজ্জতা! ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলাম,সারা বিশ্ব জানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানের ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, দুই লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করেছে। পাকিস্তানের শাসনের চব্বিশ বছরে সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময়ে মৌলবাদীদের ব্যবহার করেছে হিন্দু গণহত্যায়। সেনা শাসিত পাকিস্তান সরকার কখনোই চায়নি হিন্দুরা পূর্বপাকিস্তানে থাকুক। ১৯৬৫ মালে পাকিস্তান সরকার ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস, ১৯৬৫’ জারি করে। এই আইন প্রয়োগ করে বহু হিন্দুর সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষণা করে কেড়ে নেয়, দেশান্তর হয় বহু হিন্দু।

এই সত্য অরুন্ধতী জানেন না? নিশ্চয় জানেন, কিন্তু জেনেও মিথ্যাচার করেন। অরুন্ধতী এটাও জানেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আজাদ কাশ্মীরের মানুষের ওপর নিপীড়ন চালায়; অরুন্ধতী বেশ ভালো করেই জানেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বালুচিস্তানের মানুষের ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ এবং হত্যাযজ্ঞ চালায়; অরুন্ধতীর জানতে বাদ থাকে না যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিভাবে সিন্ধ এবং খাইবার পাখতুনওয়ার মানুষের ওপর নির্যাতন চলায়;এরা সবাই এখন পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হতে চায়।অরুন্ধতী রায় বেশ জানেন যে পাকিস্তানী সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জঙ্গি লালন করে আর কয়েকদিন পরপর জঙ্গিদেরকে লেলিয়ে দেয় ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার জন্য।অরুন্ধতী রায় নিশ্চয় জানেন যে আইএসআই অস্থির করে রেখেছে গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে।

এতোসব জানার পরও অরুন্ধতীকে বলতে হয় যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার নিজের মানুষকে নির্যাতন করেনি।এটাই অরুন্ধতীদের অসাস্প্রদায়িক চরিত্র, যা রীতিমতো মানবতাবিরোধী। আফসোস, ভারতের বহু বাঙাল আজ অরুন্ধতীর মতোই ধূর্ত শিয়াল অথবা ইতিহাস অজ্ঞ নির্বোধ।

আরেক বিখ্যাত বাঙাল অর্মত্য সেন।ভারত সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করায় তার হৃদয়ে শোকের শ্মশান নেমে এসেছে! তিনি বলেছেন-‘গোটা বিশ্বে গণতান্ত্রিক আদর্শ অর্জনের জন্য এতো কিছু করেছে ভারত। তবে এখন আর আমি একজন ভারতীয় হিসেবে এই সত্য নিয়ে গর্বিত নই যে ভারতই গণতন্ত্রের পক্ষে প্রথম প্রাচ্যের দেশ ছিলো। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে যা করা হচ্ছে, তাতে আমরা সেই খ্যাতি হারিয়ে ফেলেছি।’

অমর্ত্য সেনের পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে। ঢাকার সেইন্ট গ্রেগরী উচ্চ বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। দেশভাগের পর তার পিতা অধ্যাপক আশুতোষ সেন পরিবার নিয়ে ভারতে স্থায়ী হন। আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি দেশত্যাগ করলেন কেন?কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মুসলিম দেশে, মুসলিম শাসনে তাদের জীবন সুখের হবে না। সুলতানি এবং মুঘল শাসনের ইতিহাস তিনি নিশ্চয় জানতেন।

তারই পুত্র ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করায় ভারতীয় হিসেবে গর্বিত হতে পারছেন না! কাশ্মীর ভারতের অধীনে থাকা অবস্থায়-ই কাশ্মীরের পণ্ডিতদের ওপর মুসলিমরা যেভাবে নির্যাতন করেছে, যেভাবে হত্যা-ধর্ষণ করেছে, পণ্ডিতদের যেভাবে উচ্ছেদ করেছে এবং একনো করছে; কাশ্মীর পুরোপুরি স্বাধীন হলে পণ্ডিতদের কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। অমর্ত সেনরা হয়তো সেই কাশ্মীর-ই দেখতে চান, শুধুমাত্র মুসলিম অধ্যুসিত কাশ্মীর।

অমর্ত্য সেন বা অরুন্ধতী যে ‘ইসলামিক অসাম্প্রদায়িক’ রোগে আক্রান্ত, তা ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের আরো বহু বাঙালের মধ্যেও। তরুণ প্রজন্মের বাঙালদের একটা অংশ তো রীতিমতো ইসলামিক অসাম্প্রদায়িকতার রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত! এরা এতোটাই আক্রান্ত যে চা কিংবা কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে শ্যামাপ্রসাদকে ‘হিন্দত্ববাদী’ বলে গালি দেয়।এই নির্বোধরা কি জানে শ্যামাপ্রসাদ না থাকলে তার পেয়ালার চা কিংবা কফিতে চুমুক দিয়ে প্রায়ই বিষের অনুভূতি হতো? শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন বলেই এখনো বাঙালী হিন্দুর একটা দাঁড়াবার জায়গা আছে, নইলে বাঙালীদের অবস্থা হতো রোহিঙ্গাদের চেয়েও খারাপ। পশ্চিমবঙ্গ আজ বাংলাদেশের অংশ হলেহিন্দুদের অবস্থা হতো ফুটবলের মতো! বাংলাদেশী মুসলিমদের লাথি খেয়ে ভারতের অবাঙালী হিন্দুদের কাছে যেতো, আবার অবাঙালী হিন্দুদের লাথি খেয়ে বাংলাদেশে আসতো অথবা অন্য কোথাও আশ্রয়ের চেষ্টা করতো।এই সত্য বোঝার বোধ কি ভারতের বর্তমান প্রজন্মের ইসলামিক অসাম্প্রদায়িকতার রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত বাঙালদের আছে?এরা কি জানে কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে তাদের পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল?ভারতে নিরাপদ মাটিতে জন্মে, নিরাপদ মাটিতে বেড়ে উঠে, এরা কি অনুভব করতে পারে পূর্বপুরুষেরশিকড় ছেঁড়ার যাতনা?যদি না পারে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এবং সংকট আসন্ন।

মিলন মিশু

ঢাকা।

আগস্ট, ২০১৯।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.