পর্ব_১
সব লেখা লুপ্ত হয়, বারম্বার লিখিবার তরে
নূতন কালের বর্ণে। জীর্ণ তোর অক্ষরে অক্ষরে
কেন পট রেখেছিস পূর্ণ করি। হয়েছে সময়
নবীনের তুলিকারে পথ ছেড়ে দিতে। হোক লয়
সমাপ্তির রেখাদুর্গ। নব লেখা আসি দর্পভরে
তার ভগ্নস্তূপরাশি বিকীর্ণ করিয়া দূরান্তরে
উন্মুক্ত করুক পথ, স্থাবরের সীমা করি জয়,
নবীনের রথযাত্রা লাগি। অজ্ঞাতের পরিচয়
অনভিজ্ঞ নিক জিনে। কালের মন্দিরে পূজাঘরে
যুগবিজয়ার দিনে পূজার্চনা সাঙ্গ হলে পরে
যায় প্রতিমার দিন। ধুলা তারে ডাক দিয়ে কয়–
“ফিরে ফিরে মোর মাঝে ক্ষয়ে ক্ষয়ে হবি রে অক্ষয়,
তোর মাটি দিয়ে শিল্পী বিরচিবে নূতন প্রতিমা,
প্রকাশিবে অসীমের নব নব অন্তহীন সীমা।’
সুপ্রাচীন ভারতবর্ষ হতে সুপ্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা , সুপ্রাচীন চৈনিক সভ্যতা হতে সুমারীয় , ব্যাবিলনীয় , আসিরীয় সভ্যতা, প্রাচীন রোম অথবা গ্রীস – মূর্তিগঠনের সাধনা যুগ হতে যুগান্তরে শিল্পীগণকে নানা পরিকল্পনায় অনুপ্রাণিত করে আসছে। শিল্প যাই হোকনা কেন তা এক প্রকার সাধনা। যেকোনো শিল্প শিল্পীর নিকট পরম আরাধ্য দেবতার ন্যায় পূজনীয় বা স্বয়ংই দেবতার রূপ । তবে অনেক সময়ই মূর্তি গঠন করার অভ্যাস শিল্পীর অর্থলোভ বৃদ্ধি করে। মূর্তি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য নির্মাণে শিল্পীর অপূর্ব সাধনার ও সংযমের প্রয়োজন। তাঁর আরাধ্য দেবতার অনুপ্রেরনায় শিল্পীর সকল কলাশক্তি উদ্বোধিত হয়। সেই দেবতার আশীর্বাদে শিল্পী নিত্যনব পরিকল্পনা করবার শক্তি অর্জন করেন, শিল্পীর স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটে; তিনি অপরূপ স্বর্গীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে সমর্থ হন। সেই নিমিত্ত ভারতের শিল্পসম্পদ যুগ যুগ ধরে দেশ হতে
দেশান্তরে সৌন্দর্যের উপাসক শিল্পানুরাগীকে আকৃষ্ট করে আসছে। ভারতের শিল্পীদের সাধনা দর্শকদের হৃদয় চিরকাল আনন্দে ভরে দেয়। সাধকগণ ভারতীয় শিল্প সম্পদের মধ্যে সৎ চিৎ আনন্দময়ের সন্ধান পান।
শহরের কোলাহল ও সংসারের মায়া , মার, দুঃখ হতে চিরকালই মানব কিছুকালের জন্য মুক্তি পেতে চেয়েছেন। তাই তো সেই সুপ্রাচীন কাল হতে সাধকগণ সিদ্ধ হবার জন্য, নির্বাণ লাভের জন্য নির্জন এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য্য লীলা নিকেতন অন্বেষণ করে এসেছেন। তাই সকল সাধকের ভারতের (India) রম্য স্থানেই আশ্রম, মন্দির, গুহা বা বিহার নির্মাণ করেছেন।
স্বাধীন সনাতনী সুপ্রাচীন ভারতের শিল্প সাধনার কথা অফুরন্ত। এর মধ্যে অবশ্যই গুপ্তযুগের শিল্পীর কৌশল , পরিকল্পনা ও দক্ষতা জগতে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। গুপ্তযুগ সনাতন ধর্মের অন্যতম তীর্থস্থানে পরিণত হয় ।
মধ্য ভারতের সুরম্য উদয়গিরিতে গুপ্তযুগের সাধকেরা ভগবৎ সাধনার জন্য পর্বত গুহা গাত্র খোদিত করে তথায় তাঁদের আসন পেতে ছিলেন। তাঁরা শিল্পীকে বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন । সনাতন ও তার দুই মার্গ বৌদ্ধ ও জৈন , এই তিনটি সাধনার ফল উদয়গিরির গুহায় নানা মূর্তির ভিতর দিয়ে ফুটে উঠেছে। শিল্পী তাঁর কল্পনাবলে অমরাবতীর সুষমা ভূমন্ডলে আনয়ন করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন। গুপ্তযুগের শিল্পীগণ কেউ স্থপতী নন তাঁরা সাধক এবং পূজারী।
মধ্যপ্রদেশের (Madhya Pradesh) গোয়ালিয়রের (Gwalior) মধ্যে ভীলসা (Vilsa) এক ক্ষুদ্র স্থান। বৌদ্ধ যুগের প্রারম্ভে ভীলসার সংলগ্ন ভূমিখন্ডে বিশাল মালোয়ার বা মালবের সমৃদ্ধশালী রাজধানীর নাম ছিল বেশনগর। বতুয়া ও ব্যাস নদীর তীরবর্তী বেশনগর ইন্দ্রের অমরাবতীরন্যায় বিরাজ করতো। রেলস্টেশন হতে দুই মাইল দূরে এখনো বেশ নগরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। আজি হতে দুই সহস্র বৎসর পূর্বে এই স্থলে যেথায় মালোয়ার রাজধানী ছিল ,তথায় বাসুদেবের একটি বৃহৎ মন্দির বিরাজিত ছিল।
মালোয়া একটি সুপ্রাচীন স্থান। সেই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে মহাভারত হয়ে নন্দ বংশ, মৌর্য বংশ , কুষান হতে শুঙ্গ, গুপ্ত , সাতবাহন, প্রতিহার হয়ে পারমার বংশ মালবে রাজত্ব করেছিলেন। আমি আজ যে সময়ের কথা বলব তখন মালবে রাজত্ব চলছে শুঙ্গ বংশের। শুঙ্গ ব্রাক্ষন্য রাজবংশ ১৮৭ থেকে ৭৮ খ্রীস্টপূর্বে ভারতের উত্তর ও পূর্বভাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর পূষ্যমিত্র শুঙ্গ এই সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। মূলত এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের জধানী ছিল পাটলীপুত্র, কিন্তু ভগভদ্র প্রভৃতি শাসকগণ পূর্ব মালবের বেশনগর (বিদিশা) থেকেও দরবার চালাতেন।
তো , সেই প্রাচীন বাসুদেবের মন্দিরের প্রাঙ্গনে গ্রিক রাজবংশীয়পুত্র হিলিয়োডোরাস একটি গরুড় স্তম্ভ নির্মাণ করে দেন । সেই স্তম্ভটি এখনও হিলিয়োডোরাসের_গরুড়স্তম্ভ নামে বা খাম্বাবা নামে বিখ্যাত হয়ে দন্ডায়মান রয়েছে। খুব অবাক লাগছে না ? হিলিওডোরাস- বিষ্ণুমন্দির ও গরুড় স্তম্ভ ? এমনও হয়। গ্রিকরা তো সেই কবে ভারতে এসেছিল …..
গ্রিকরা গান্ধারকে বলত ‘গান্ডারীর নগর’। গান্ধারের রাজধানী ছিল তক্ষশীলা । শিক্ষা ও বানিজ্যকেন্দ্র হিসাবে তক্ষশিলা সুপরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পারস্যের সম্রাট করু বা সাইরাস গান্ধার জয় করেন। পারস্য সম্রাট ডারিয়ুসের বেহিস্তান শিলালিপিতে (খ্রিস্টপূর্ব ৫২০-৫১৮) গান্ধারগন কে আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের প্রজাপুঞ্জের অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রিসের সঙ্গে পারস্যের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। পারস্যের সৈন্যবাহিনীতে ‘সুতির কাপড় পরা’ ভারতীয় সৈন্যের উল্লেখ করেছেন গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দের শুরুতে আলেকজান্দার ব্যাকট্রিয়া এবং বুখারা জয় করে সির দরিয়া অবধি অগ্রসর হন। এর পর হিন্দুকুশ পাহাড়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে মে মাসে সিন্ধু নদের নিকটে পৌঁছন। গান্ধারের রাজধানী তক্ষশিলা ছিল সিন্ধু নদ ও ঝিলাম নদীর মধ্যবর্তী স্থানে। ঝিলাম নদীকে গ্রিকরা বলত হাইডাসপেস। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গান্ধারের রাজা ছিলেন ট্যাকসিলিস। তিনি আলেকজান্দারের জন্য মূল্যবান উপঢৌকন পাঠান। তাঁর মৃত্যুর পর অম্ভি গান্ধারের রাজা হন। অম্ভি আলেকজান্দারে কে ৬৫ হাতি এবং ৩০০ ষাঁড় উপহার দেন।
আলেকজান্দারের ভারত আক্রমনের কিছু কাল পরে চন্দ্রগুপ্ত (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪-৩০০) উত্তর ভারতের মগধে শক্তিশালী মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা করেন । এই বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৩২) । অশোকের মৃত্যুর মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই মৌর্যবংশের পতনের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং সেই পতনের সুযোগে গ্রিকরা ভারতের উত্তরপশ্চিমের বিশাল অংশ জয় করে নেয়ে। অবশ্য এই সব গ্রিক আক্রমনকারীরা ইউরোপের মূলভূখন্ড থেকে আসেনি। মনে থাকার কথা খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দের শুরুতে আলেকজান্দার ব্যাকট্রিকা এবং বুখারা জয় করে সির দরিয়া অবধি অগ্রসর হয়েছিলেন। আলেকজান্দার যেখানেই যেতেন গ্রিসের আদলে নগর ও জনবসতি গড়ে তুলতেন। এসব গ্রিক মূলত ব্যাকট্রিয় গ্রিক। গান্ধার শিল্পের বিকাশ হয়েছিল এই ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের সময়ে। এর মানে, গান্ধার শিল্পের মূলে ছিল ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের শিল্পকৌশল।
ব্যাকট্রিয় গ্রিক শাসকরা ইন্দো-গ্রিক নামেও পরিচিত। ইন্দো-গ্রিক শাসকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মেনান্দার। সময়কাল: ১১৫-১৯০ খ্রিস্টপূর্ব। মেনান্দারের জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের শিয়ালকোট। শিয়ালকোটই ছিল মেনান্দার এর রাজধানী। ইনি বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগার্জুনকে বৌদ্ধ মার্গ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। ইতিহাসে যা ‘মিলিন্দ পঞহো’ নামে পরিচিত। মেনান্দার সন্তুষ্ট হয়ে বৌদ্ধ মার্গের পৃষ্ঠপোষক হন।
গ্রিকদের পরে শকরা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল আক্রমন করে । মধ্য এশিয়ার যাযাবরদের নাম ছিল স্কাইথিয়। এদেরই এক শাখার নাম শক। এরা ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের আধিপত্য ধ্বংস করেই তবে ভারতবর্ষে এসেছিল। শকদের রাজধানী ছিল তক্ষশিলা; তক্ষশিলার প্রথম শক রাজার নাম ছিল মাওয়েস। তিনি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর গোড়ায় সিংহাসনে বসেন। যা হোক। শকরা ব্যাকট্রিয় ইন্দো-গ্রিক প্রবর্তিত গান্ধার শিল্পের পৃষ্টপোষকতা অব্যাহত রেখেছিল।
শকদের পরে ভারতবর্ষে আসেন কুষাণরা। কনিস্ক (১২৭-১৫১ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন অন্যতম কুষাণ নৃপতি। কনিষ্কর রাজধানী ছিল পুরুষপুর; কনিষ্ক বৌদ্ধ মার্গ গ্রহণ করেন এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন। এসব কারণে গান্ধার শিল্পে গভীর কুষাণ প্রভাব অক্ষুন্ন থাকে । শক কিংবা কুষাণরা বিদেশী হিসেবে ভারতে এলেও বেশি দিন বিদেশী থাকেননি। এরা ক্রমশ ভারতীয় সভ্যতায় মিশে যান।
আফগানিস্তানের বামিয়ানে বৌদ্ধমূর্তি। আজও গান্ধার শিল্পের ধ্রুপদী উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের শিল্পরীতি গ্রহন করেছিল শক ও কুষানরা। যার ফলে গড়ে উঠেছিল গান্ধার শিল্প –যে শিল্পের বিকাশকাল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ।
হ্যাঁ ,ওই যাঁরা বিষ্ণুমন্দিরের গ্রিক হিলিওডোরাসের নাম শুনে ভ্রু কুঞ্চিত করেছিলেন তাঁদের জন্যই এই ইতিহাস বললাম।
খ্রিস্টপূর্ব ১৪০ অব্দে হিলিওডোরাস গরুড়স্তম্ভটি মালোয়ার রাজার কুলদেবতা বাসুদেব মন্দিরের প্রাঙ্গনে নির্মাণ করেছিলেন। স্তম্ভ গাত্রে ব্রাহ্মী অক্ষরে গ্রিক রাজবংশীয়পুত্র হিলিওডোরাস কর্তৃক এই স্তম্ভ নির্মিত হওয়ার কাহিনী এবং তাঁকে পরম_ভাগবত নামে খ্যাতির কথা উৎকীর্ণ আছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই লিপির ইংরেজি অনুবাদ স্তম্ভের পাদদেশে মার্বেল ফলকে উৎকীর্ণ করে রেখেছেন। বাসুদেব মন্দিরের পূজারীর বংশধর গোস্বামীরা এখনো এই খাম্বাবা নিকট বাস করছেন। হিন্দুদেব মন্দিরের প্রামানিক প্রাচীনতম নিদর্শন হল এই হিলিওডোরাসের স্তম্ভ।
এই স্তম্ভটির সহিত একটি অপূর্ব কাহিনী জড়িত আছে। দুই সহস্র বৎসর পূর্বের দুই ভিন দেশীয় যুবক যুবতীর অপূর্ব প্রণয় ও পরিণয়ের কাহিনী এই স্তম্ভের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। দেশের মানুষ কেবল রোমিও জুলিয়েট, লায়লা মজনুর প্রেমের গল্প করেন, অথচ আমাদের দেশের কোনায় কোনায় , পৌরাণিক গাঁথায় , ইতিহাসে কত যে ,অমর প্রেমকাহিনী জড়িত আছে তার হিসাব কেউ রাখেন না। প্রেমে পড়ে বাদশাহ তাজমহল বানিয়ে ছিল কি না তার বিতর্ক থাকলেও প্রেমে পড়ে গ্রিক রাজবংশীয় কুমার নিজের আত্মাকে শুদ্ধ করে মন্দিরের দালানে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। বিতর্ক নেই তাই হয়ত প্রচারও নেই। কি ছিল সেই প্রণয় ইতিহাস ? আজ কথক ঠাকুর হয়ে একটু মধ্যভারতের সেই প্রেম এবং সনাতনী জয়ের এক কাহিনী বলব , আর ভ্রমণ করে দেখব ভীলসার আনাচে কানাচের অতীত ইতিহাসে।
ব্যাকট্রিয়ন গ্রিক নরপতি এন্টিসিলিওডিরাস খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে তক্ষশীলায় রাজত্ব করছিলেন। এদিকে নবম শুঙ্গ শাসক কাশীপুত্র মহারাজ ভগভদ্র তখন মালব শাসন করছেন। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ৩৬ বছর রাজত্ব করেছিলেন এবং তার পর তার পুত্র অগ্নিমিত্র সিংহাসনে বসেন। দশজন শুঙ্গ রাজা ছিলেন। যদিও রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা অগ্নিমিত্রের মৃত্যুর পরই সাম্রাজ্য দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে। শিলালিপি এবং মুদ্রা থেকে জানা যায়, উত্তর ও মধ্যভারতের অধিকাংশ অঞ্চল ক্ষুদ্র রাজ্য এবং নগর-রাজ্য দ্বারা গঠিত ছিল এবং এগুলি শুঙ্গ শাসন মুক্ত ছিল। এই সাম্রাজ্য প্রভূত পরিমাণে বিদেশী আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তারা কলিঙ্গ, সাতবাহন সাম্রাজ্য, ইন্দো-গ্রীক রাজ্য এবং সম্ভবত পাঞ্চাল ও মথুরার সঙ্গেও যুদ্ধে লিপ্ত থাকত।
সেই সময় মালব বা মালোয়া রাজ্যে হস্তীর অত্যন্ত প্রাচুর্য ছিল। এদিকে গ্রিক নরপতির একটি হস্তী বাহিনী গঠনের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। তখন তক্ষশীলা ছিল একটি সমৃদ্ধশালী মহানগরী। তার সুবিশাল শিক্ষাপীঠের নিমিত্ত সুখ্যাতি দিগ্ হতে দিগন্তে বিস্তার লাভ করেছে। তার বিপুল বাণিজ্যকেন্দ্র মস্তক তুলে বজ্রনির্ঘোষে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। তক্ষশীলা সৌন্দর্য সম্পদে তখন নব যৌবন লাভ করেছে।
বিদ্যা হতে বৃহৎ সম্পদে পৃথিবীতে কিছু নেই , তা মালোয়ার রাজা ভগভদ্র উপলব্ধি করেছিলেন। যতই ক্রুরতা , বৈষম্য , রাজনৈতিক মতানৈক্য থাক না কেন রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত এবং সুশাসিত করার জন্য একজন রাজার সুশিক্ষিত এবং সর্ববিদ্যায় পারদর্শী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তাই ,রাজা ভগভদ্র যুবরাজকে তক্ষশীলায় গ্রিক রণ কৌশল এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের নিমিত্ত প্রেরণের মনস্থ করলেন।
মালোয়ার রাজপুত্র তক্ষশীলায় আগমন করলে গ্রিক নরপতি পরম সমাদরে তাঁর অভ্যর্থনা করলেন। রাজঅথিতি রূপে তাঁর স্থান হল রাজ আত্মীয় ডিয়নের গৃহে। ডিয়নের এক পুত্র ছিল। তাঁর নাম হিলিওডোরাস। সমবয়সী হবার নিমিত্ত হিলিওডোরাসের সঙ্গে রাজপুত্রের অতি অল্পকালের মধ্য সৌহার্দ্য ও সখ্যতা স্থাপিত হল।
গিরি যে তুষার নিজে রাখে, তার
ভার তারে চেপে রহে ।
গলায়ে যা দেয় ঝরনাধারায়
চরাচর তারে বহে ॥
শীতের অবসানে একদিন গ্রীষ্মাধিক্যে তুষার গলিত হয়ে স্বচ্ছ সলিল ধারায় বহমান ….রাজপুত্র সেই জলধারায় অবগাহন করার লোভ সংবরণ করতে পারলেন না। মালোয়ার তপ্ত জীবন এবং হিমালয় পর্বত শ্রেণীর শীতল জীবন এক নয়, অনুমান গিরিশ্রেণীর সৌন্দর্য ও তুষারমালার রূপ কুমারের সেই বোধকে হরণ করেছিল অথবা কুমার নিজেকে পার্বত্যবাসীদের একজন বলে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন। সুতরাং, অনেক বাধা সত্ত্বেও সেই শীতল জলে স্নান করে ভগভদ্র পুত্রের ভীষণ জ্বরবিকার হল এবং জীবন সংশয় হয়ে উঠল। হিলিওডোরাস ও তাঁর জননীর দিবা রাত্রি সেবায় রাজপুত্র আরোগ্য লাভ করলেন।
সময় বয়ে গেল, গ্রিক নরপতি হস্তী সংগ্রহ এবং বন্ধুত্ব দৃঢ় করবার নিমিত্ত মালোয়ার রাজধানীতে হিলিওডোরাসকে রাজদূত নিযুক্ত করলেন। বিদায়কালে মালোয়ার রাজকুমার সম্রাটকে পত্রে হিলিওডোরাসের সদ্ব্যবহারের কথা জানালেন। গ্রিক কুমারের ভ্রাতার ন্যায়ের যত্নে এবং তাঁর মাতার মাতৃস্নেহে কিরূপে যে, রাজকুমারের নবজীবন লাভ হয়েছে সে কথা উল্লেখ করে হিলিওডোরাসকে নিজ পরিবার ভুক্ত করে রাখার অনুরোধ জ্ঞাপন করলেন।
রাজ্য হতে বহু দূরে বিদেশী গ্রিকদের মাঝে অবস্থিত পুত্রের বিরহে কাতর মালোয়ার সম্রাট অপত্যস্নেহে বিগলিত হয়ে হিলিওডোরাসকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন এবং নিজ পরিবার ভুক্ত করে রাখলেন।
মাধবীকা , মালোয়ার এক মাত্র রাজকুমারী। তাঁর রূপ ঠিক কেমন করে বর্ণনা করা যায় ? তিনি বতুয়া নদীর ন্যায় সুন্দর , স্বচ্ছ এবং চঞ্চল, বিন্ধ্য পর্বতের মেঘের ন্যায় স্নিগ্ধ আর বিন্ধ্যবাসিনীর ন্যায় পবিত্র। তিনি বাসুদেব গোবিন্দের উপাসিকা ছিলেন। একদিন প্রাতে পূজা গৃহ থেকে আগত শ্বেত বস্ত্র পরিহিতা রাজকুমারীকে উদ্যানে দেখলেন হিলিওডোরাস। শ্বেত শুভ্র মেঘের ন্যায় স্নিগ্ধ ও সূর্যালোকের প্রথম আলোয় রাঙা রাজকুমারীকে দেখে হিলিওডোরাসের কেমন যেন গ্রিক দেবী এথেনার কথা মনে পড়ল…..
ওই বুঝি বাঁশি বাজে বনমাঝে কি মনোমাঝে।
বসন্ত বায় বহিছে কোথায়, কোথায় ফুটেছে ফুল,
বলো গো সজনি, এ সুখরজনী কোন্খানে উদিয়াছে—
বনমাঝে কি মনোমাঝে॥
ভারতীয় উপমহাদেশে থেকে এবং তক্ষশীলায় অধ্যয়ন করে হিলিওডোরাস প্রতিদিন সকালে উঠে যোগাভ্যাস ও অন্যান্য শরীর চর্চা রপ্ত করেছিলেন। আবার, তেমনি এক বসন্ত প্রভাতে , মৃদু বাতাসে , পুষ্পের গন্ধে মাঝে রাজকুমারী দেবগৃহে গমন কালে যোগরত হিলিওডোরাসকে দেখলেন….তারপর দেখতেই থাকলেন। হিলিওডোরাসের সুগঠিত , দীর্ঘ এবং সুশ্রী রূপ এবং নানা গুণে আকৃষ্ট হলেন কুমারী।
হে স্তব্ধবাণী, কারে দিবে আনি
নন্দনমন্দারমাল্যখানি,
বরমাল্যখানি,
প্রিয়- বন্ধনগান-জাগানো রাতে
শুভ দর্শন দিবে তুমি কাহার চোখে॥
মালোয়ার বসন্ত উৎসব প্রাচীনকাল হতে অতীব বিখ্যাত ছিল। ওই দিন নরনারী অবাধে একত্র হয়ে নৃত্যগীতাদি উৎসবে মেতে উঠতেন। সেদিন দেহ মন রঙে রঙে রাঙিয়ে গিয়ে একাকার হয়ে যেত প্রকৃতির সঙ্গে। দেবগৃহের পরমেশ্বর , উদ্যানের বৃক্ষ আবির রঙে, ফুলের রাগে মেতে উঠত। পুরবাসীজন নগরের পথে হোরি খেলতে খেলতে আনন্দ সংগীতে দিগন্ত মুখরিত করে তুলতেন।
রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে–
তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে
অশ্রুজলের করুণ রাগে॥
রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে,
সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে॥
সেই বসন্তোৎসবের সন্ধ্যায় পূর্ণিমালায় যখন রাজার দুলালী গাছের ডালে ঝুলন দোলনায় দুলতে দুলতে পুষ্পবীথিকায় চরণাঘাত করছিলেন – তখন হিলিওডোরাস তাঁর আরক্ত চরণের শোভায় মুগ্ধ হয়ে হয়ে বললেন – ” আমি যদি পুষ্পবিথীকা হতেম তাহলে দেবীর চরণ স্পর্শ করে ধন্য হতেম।”
মাধবীকা , তাঁর চঞ্চল হংসীর ন্যায় গ্রীবা ঘুরিয়ে পশ্চাতে দৃষ্টি ক্ষেপণ করলেন। চারি চক্ষুর মিলনে অনেক অব্যক্ত কথা প্রকাশিত হল।
দুজনে দেখা হল মধুযামিনী রে–
কেন কথা কহিল না, চলিয়া গেল ধীরে॥
নিকুঞ্জে দখিনাবায় করিছে হায়-হায়,
লতাপাতা দুলে দুলে ডাকিছে ফিরে ফিরে॥
দুজনের আঁখিবারি গোপনে গেল বয়ে,
দুজনের প্রাণের কথা প্রাণেতে গেল রয়ে।
দুইটি তরুণ তরুণীর হৃদয়ে প্রণয় বীজ অঙ্কুরিত হল এবং পরিণামে তা পরিণয়ে পর্যবসিত হল।
সেই সদ্য প্রস্ফুটিত প্রেমপুষ্পের মিষ্ট সুবাস বাতাসে ভর করে মালোয়ার রাজদরবারে পৌঁছল। মালোয়ার সম্রাট কাশীপুত্র ভগভদ্র সেই প্রণয় কাহিনী শুনে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হলেন। একে বিদেশী তার উপর গ্রিক দৌত্য, এমনিতেই পূর্বে গ্রিকদের সঙ্গে শুঙ্গদের যুদ্ধ বিবাদ লেগেই থাকত। কিছুকাল হল মহারাজ কেবল তক্ষশীলার কথা চিন্তা করে সৌহার্দ্য স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন। তার জন্য এত স্পর্ধা ? একেবারে রাজ অন্তঃপুরে..!…এই জন্যই সকলে এদের ম্লেচ্ছ বলে!
সে কালে দূত ছিলেন অবধ্য। তাই মালব রাজ হিলিওডোরাসকে অপমান করে রাজপ্রাসাদ ও রাজধানী হতে বিতাড়িত করে দিলেন। মর্ম্মাহত হিলিওডোরাস যখন তাঁর প্রণয়িনীর নিকট বিদায় গ্রহণের জন্য এলেন , তখন রাজকুমারী অশ্রু আরক্ত দুই নয়ন নিয়ে পরন্ত বেলায় দেবগৃহের দিকে মুখ করে নিষ্পলক ভাবে বসে ছিলেন। তাঁর সুন্দর দুই কপোল আঁখির বারি ধারায় সিক্ত হয়ে ধৌত হয়ে যাচ্ছিল। পদশব্দে রাজকুমারীর সম্বিৎ ফিরলো কিন্তু পিছু ফিরে তাকালেন না। যন্ত্রণাবনত কন্ঠে বললেন , ” হিলিওডোরাস , আমি তোমার বাগদত্তা। তুমি নালন্দায় নিশ্চয় শাস্ত্র পড়েছ ? না পড়লেও এখানে তো শাস্ত্র পাঠ করেছ মন্দিরে বসে আচার্যের নিকট….তুমি জানো যে ,আমাদের বিচ্ছেদ নেই। হিন্দু মতে একজন সনাতন কন্যা বাগদত্তা হলে সে অন্য কাউকে এজীবনে গ্রহণ করে না। আমি , আমার পিতা এবং আমার বংশ কুলদেবতা বাসুদেবের ভজনা করি। তোমার কুলদেবতা বা দেবী হয়ত অন্যকেউ, তুমি বলেছ …কিন্তু তুমি যদি পুরুষোত্তম বাসুদেব কৃষ্ণের ভজনা করতে পার তাহালে আমাকে তুমি লাভ করতে পারবে।”
গ্রিক হিলিওডোরাস তাঁর প্রণয়িনীর কথায় বিশ্বাস করলেন। গ্রিক কুমারের রাজ্যে অনেকেই শিবের পূজা করেন, অনেকে বিষ্ণুর, অনেকে করেন ধ্যানী বুদ্ধের উপাসনা। শিশুকাল হতে মা, দাই মা আরো অনেকের নিকট রামায়ণ , মহাভারতের কথা শুনে আসছেন। শুনেছে নানা পুরাণের কথাও। তাঁর নিজ গৃহে দেবী এথেনা ও এপেলোর উপাসনা হয়। নালন্দায় তিনি ধ্যানী বুদ্ধের নামে যোগসাধনা শিখেছেন। তাঁর মাতা স্বেচ্ছায় মহাকালের নামে ব্রত উপবাস করেন। তাই ঈশ্বরের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। মাতা বলেন , “প্রাণ দিয়ে যদি তাঁকে ডাক তবে কোনো আড়ম্বর ছাড়াই তিনি সারা দেবেন। “
তিনি বতুয়া নদীর জলে স্নান করে উপাস্য ও বিন্ধ্যবাসিনীকে স্মরণ করলেন। তিনিই মায়া, শুনেছেন তিনিই মহামায়া রূপে এই মায়ার সংসার পরিচালনা করেন। কুমার যাঁর উপাসনা করতে যাচ্ছেন তিনি দেহধারী পরম ব্রহ্ম। তিনি গুণের গুণময়। তিনি পাপের বিনাশ করতে যুগে যুগে আবির্ভুত হন। একদিন রাজআচার্যও সন্ধ্যায় দেবমন্দিরের বাতায়নে বসে গীতা পাঠের সময় সেই কথা বলছিলেন। নগর হতে বিতাড়িত হিলিওডোরাস প্রাচীন বাসুদেবের মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেবের পূজা অর্চনায় নিজের মন, প্রাণ এবং দেহকে সমর্পণ করলেন।
হিলিওডোরাসের একাগ্র সাধনা ও নিষ্ঠা দেখে মালোয়াবাসী বিস্মিত হল। ক্রমে রাজার কঠিন হৃদয়ও দ্রবীভূত হল। অন্যদিকে রাজকুমারী প্রেমাস্পদের লাঞ্চনায় ও বিরহে মর্ম্মাহত হয়ে দিন দিন ক্ষীণ হতে লাগলেন। বহুদিন উপবাস থেকে কন্যা উৎকট ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন। মহারাণী কন্যার অবস্থা দেখে বিচলিত হলেন। তাঁর মাতৃস্নেহ কোন বাঁধা মানল না। সন্তানের প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত তিনি মহারাজকে অনুরোধ করলেন , ” কন্যার প্রাণ রক্ষার্থে আপনি ওই গ্রিকের হস্তে কন্যা প্রদান করুন।”রাজা এবং মন্ত্রী মন্ডলী হিলিওডোরাসের দেবপ্রীতি ও নিষ্ঠার সঙ্গে অচর্না দেখে কন্যা প্রদান করতে সম্মত হলেন। মালোয়ার ভক্তিমতী রাজকন্যার সঙ্গে গ্রিক হিলিওডোরাসের পরিণয় সুসম্পন্ন হল। রাজপুরী উৎসবে মেতে উঠল।
হিলিওডোরাসের দেব প্রীতি ও একনিষ্ঠ ভক্তি দেখে মালোয়ার ব্রাহ্মণ এবং পন্ডিতগণ তাঁকে পরম ভাগবত উপাধিতে ভূষিত করেন। এই ইতিবৃত্ত এবং কাহিনীর মর্ম্মকথা ব্রাহ্মী অক্ষরে স্তম্ভগাত্রে উৎকীর্ণ আছে। হিলিওডোরাসের মনস্কামনা পূর্ণ হওয়াতে এই গরুড় স্তম্ভটি বাসুদেব মন্দিরের প্রাঙ্গনে স্থাপিত করেছিলেন।বর্তমান সময়ে এই স্তম্ভ আবিষ্কারকে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্তিক আবিষ্কার বলে মনে করা হয়। কৃষ্ণভাবনামৃত দর্শন এবং তৎকালীন পৃথিবী সম্পর্কে জানতে এই স্তম্ভটি যথেষ্ট। কেননা দুই সহস্র বৎসর পূর্বে একজন পাশ্চাত্যবাসীর মনে কৃষ্ণভাবনামৃত দর্শন যে, গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল, এটি তার দৃষ্টান্তস্বরূপ।
হেলিওডোরাসের এই স্তম্ভটি সর্বপ্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক নজরে আসে ১৮৭৭ সালে, যখন জেনারেল আলেকজান্ডার কানিংহাম এই স্থানে একটি প্রত্নতাত্তিক জরিপ সম্পাদন করেন। তবে সেই সময় এই স্তম্ভে বিদ্যমান শাস্ত্রলিপিগুলো নজর এড়িয়ে যায়। কেননা সেই সময় পিলারের উপর লাল সীসার আবরণ বিদ্যমান ছিল।
তৎকালীন সময়ে একটি ঐতিহ্য ছিল যে, তীর্থযাত্রীরা যেকোন স্তম্ভকে তাদের আরাধনার অংশ হিসেবে সিঁধুর লাগিয়ে দিত। কানিংহাম যখন এই স্তম্ভটি পর্যবেক্ষণ করেন তখন তিনি এটির স্থাপত্যকাল নির্ণয় করেছিলেন গুপ্তযুগের অর্থাৎ ৩০০ থেকে ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দের। ৩২ বছর পর যখন (১৯০৯ সালে) এই স্তম্ভের গায়ে লিখিত শাস্ত্রলিপিগুলো আবিষ্কৃত হল, তখন বোঝা গেল যে, এই স্তম্ভ তৎকালীন ধারণার চেয়েও অধিক পূর্বে নির্মাণ করা হয়েছিল।
১৯০১ সালের জানুয়ারি মাসে মিস্টার লেক নামক ব্যক্তি উপলব্ধি করেন যে, এই স্তম্ভের নিচের দিকে কিছু একটা লেখা আছে। এরপর তার ধারণা সত্য হয় যখন তিনি স্তম্ভের কিছু সিঁদুরের রং পরিষ্কার করেন। মি. লেকের সঙ্গী ড. জ. স. মার্শাল ১৯০৯ সালে জার্নাল অব দ্যা রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটিতে এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের তথ্য বর্ণনা করেন। মার্শাল এবং লেকের বর্ণনা অনুসারে এই স্তম্ভের নিমার্ণকাল গুপ্তযুগেরও কয়েক শতাব্দীর পূর্বে। এই সময়কাল নির্ণয় করা গেলেও সেখানের শিলালিপি সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। জার্নাল অব দ্যা রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রকাশিত এই কলামের লেখাগুলো পড়ে বোঝা যায় যে এগুলো ছিল প্রাচীন ব্রাহ্মিলিপিতে লেখা। লেখাটি ছিল :
দেবাদিব্যাস বাসুদেবস্য গরুধ্বজ্য অথম
করিতো অ হেলিওডোরিনা ভগ
ভতিনা দিয়াসা পুত্রিনা টাখসিলাক্সনা
যনদতিনা অগতিনা মহারাজস
অমতলিকিতাস উপমতা শঙ্খসম রানো
কাশিপুতরস ভগবাদ্রস তর্তরস
ব্যাসিনা চর্তুদসিনা রাজেন ভধামানস
অর্থাৎ , দেবতারও দেবতা পরমেশ্বর বাসুদেবের (বিষ্ণু) এই গরুড় স্তম্ভটি স্থাপিত হয়েছে বিষ্ণুভক্ত হেলিওডোরাস কর্তৃক যিনি হচ্ছেন ডিওনের পুত্র এবং টেক্সিলার অধিবাসী। যিনি রাজা এ্যানশিয়ালডসের আদেশে গ্রীক রাষ্ট্রদূত হিসেবে ত্রাতা রাজা কাশিপুত্র ভগভদ্রের নিকট এসেছিলেন, যিনি ১৪ বছর যাবৎ সফলভাবে রাজত্ব করছেন।
এরপর স্তম্ভ গাত্রে উৎকীর্ণ হয়েছিল দুই ছত্রের তিন অমর পন্থার কথা –
ত্রিনি অমূতাপদানি – সু অনূথিতানি
নয়মতি সগ দম ছগো অপরামাদো
ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উক্ত দুই ছত্র নিয়ে লিখেছেন :
তিনটি অমৃতপদ সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হলে।
নিয়ে যায় স্বর্গ গমনে – আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মৎস্বর্গ, সতর্কতা।।
খ্রীষ্টপূর্ব্ব দ্বিতীয় শতকের যবন ( গ্রিক) বৈষ্ণব
ডিওয়নের পুত্র হেলিওডোরাসের শিলালিপি হইতে।।
- শ্ৰী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (Mr. Sunitikumar Chatterjee)।
হেলিওডোরাসের স্তম্ভে লিখিত ব্রাহ্মিলিপি থেকে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, হেলিওডোরাস ছিলেন একজন বিষ্ণুভক্ত। বাসুদেব এবং বিষ্ণু উভয় নামই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিখ্যাত নাম হিসেবে পরিচিত। এছাড়া হেলিওডোরাসের প্রত্যয়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ (দম্), আত্মউৎসর্গ (ছাগো) এবং সতর্কতা (অপারমাদো) গুণসমূহ দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করছে যে, তিনি একজন কৃষ্ণভক্ত ছিলেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী হেলিওডোরাস সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি ভাগবত বৈষ্ণব মতের সকল শাস্ত্র সম্পর্কে অবগত ছিলেন।ঐতিহাসিক মতে হেলিওডোরাস হচ্ছেন সনাতনী বৈষ্ণবে পরিবর্তিত হওয়া প্রাচীন পাশ্চাত্যবাসী। কিন্তু এ. এল. ব্যাসাম, টমাস হোপকিন্স সহ আরো বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের মতে শুধুমাত্র হেলিওডোরাস নন আরো অনেকেই সনাতন ধর্মের বিভিন্ন মার্গ সে সময়ে গ্রহণ করেছিলেন। ‘ফ্রাঙ্কলিন ও মার্শাল’ কলেজের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হোপকিন্স বলেন যে, যেহেতু হেলিওডোরাসের অস্তিত্ব সম্বলিত একটি স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে সেহেতু ধারণা করা সহজ যে এই ধরণের আরো অধিক স্থাপত্য তখন ছিল এবং আরো অনেকে বৈষ্ণব মত গ্রহণ করেছিল।
আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে স্তম্ভ সমূহের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে বৈষ্ণব দর্শনে কৃষ্ণের প্রতি বিশুদ্ধ ভক্তি প্রকাশিত হয়েছে।হেলিওডোরাসের এই স্তম্ভ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আর্বিভাবের সঙ্গে একটি সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। ২৫০০ বছর পূর্বে এই হেলিওডোরাস স্তম্ভ বা কৃষ্ণভক্ত হেলিওডোরাস হল প্রমাণ স্বরূপ , যে সুপ্রাচীন কালে সমগ্র পৃথিবী সনাতনী ছিল।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. ভারতের দেব দেউল
২. . India: The Ancient Past: A History of the Indian Subcontinent from C. 7000 BCE to CE 1200