সেটাও ছিল জুলাই মাস। সালটা ১৯৮৮। কলকাতা উত্তাল। ২০২১-এর ৫ জুলাইও শহর উত্তাল জাল টিকার প্রতিবাদে বিজেপি-র আন্দোলনের জন্য। ’৮৮-তে উত্তাল ছিল বেহালার ভেজাল তেলকান্ডে। পার্থক্যটা হল সেদিন আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তিনি শাসক-নেত্রী হিসাবে আন্দোলন ভাঙার দায়িত্বে। রাজনীতির বৃত্ত এভাবেই বুঝি সম্পূর্ণ হল।
জাল টিকা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। লোকে ভুলে গিয়েছে, কী হয়েছিল ৩১ বছর আগে? এক রাতে ভেজাল রেপসিড তেলে তৈরি রান্না খেয়ে বেহালার বুড়ো শিবতলা তল্লাটে শ’তিনেক মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল অন্ধকার৷ এত বছর পরেও তাঁদের খেতে হয় ওষুধ৷ অনেকেই হাঁটতে পারেন না লাঠি ছাড়া৷ কেউ আবার হাঁটেন দেওয়াল ধরে বা কারও কাঁধে ভর দিয়ে৷
১৯৮১-র উদ্বেগ-আতঙ্ক শুরু হয় জুলাইয়ের মাঝপর্বে। হঠাৎ দেখা যায় প্রায় একই সঙ্গে বেহালার বুড়োশিবতলার রায়বাহাদুর রোড, কবিগুরু সরণি, মুসলমান পাড়া, মালাকার পাড়া, গোবরঝুড়ির মূলত বস্তিবাসীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। চিকিৎসকরা এটি সাধারণ খাদ্যজনিত বিষ বলে মনে করেছিলেন। ১৭ জুলাই পক্ষাঘাতগ্রস্থ ৩০ জন রোগী বিদ্যাসাগর হাসপাতালে যায়। স্রোতের হত হাসপাতালে আসতে থাকে রোগীরা। কয়েক দিনের মধ্যে, সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৫০০। ‘গরিব ভাণ্ডার’ নামে রেশন দোকান থেকে তাঁরা রেপসিড তেল কিনে রান্না করেছিলেন। সেই তেলের বিষক্রিয়াতেই অত কান্ড হয়।
জাল টিকাকান্ড প্রকাশ্যে আসার পর প্রায় প্রথম দিন থেকে সরকার এবং শাসকপক্ষের সঙ্গে মূল অভিযুক্তর ঘনিষ্ঠ যোগসাজসের অভিযোগ উঠছে। ভেজাল তেলকান্ডে কংগ্রেসের তরফে অভিযোগ তোলা হয় ‘গরিব ভাণ্ডার’-এর মালিকের ছেলের সঙ্গে রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী রবীন মুখার্জির ছেলের বন্ধুত্ব রয়েছে। তবে, এবারের জাল টিকাকান্ডে যোগসাজসের অভিযোগ আরও প্রসারিত, আরও গভীর।
যাই হোক, ভেজাল তেলকান্ডে মাঠে নেমে পড়েন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তখন কংগ্রেস সাংসদ। দিনের পর দিন সংবাদপত্রে প্রথম পৃষ্ঠার খবর। সমাবেশ-মিছিলে ঝলকে উঠছে প্রতিবাদ। এই প্রতিবেদক সংবাদ সংগ্রহের জন্য কোনও দিন হাজরার মিছিলে, কোনও দিন
বিদ্যাসাগর হাসপাতালে গিয়েছিলেন। আন্দোলনের পুরোভাগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কয়েকজন এখন রাজ্যের নেতা-মন্ত্রী। ছিলেন আপাত নির্বাসিত শোভন চট্টোপাধ্যায়ও।
সেই আন্দোলনেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের সহযোগিতা নেন। কেন্দ্রীয় রাজস্বমন্ত্রী অজিত পাঁজা, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মতিলাল ভোরা — হাসপাতালে এঁদের ঢল পড়ে গিয়েছিল অসুস্থদের দেখার জন্য। অজিত পাঁজা অসুস্থদের বেশ কিছু পরিবারকে ৫০০ টাকা করে সহায়তা দেন। ১৯৮৮-র ফেব্রুয়ারি থেকে চার বছর ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সুধীর রঞ্জন মজুমদার। মমতার আবেদনে সাড়া দিয়ে তিনিও এলেন। আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে উত্তরবঙ্গেও। কোচবিহারে পুলিশের গুলিতে দু’জনের মৃত্যু হয়। বামফ্রন্ট সরকার দোকানমালিক-সহ ১৬ জনকে গ্রেফতার করে।
মমতার সেই আন্দোলনে নাজেহাল হয় সরকার। জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী। খাদ্য ও সরবরাহ দফতর ফরওয়ার্ড ব্লকের হাতে। মন্ত্রী নির্মল বসু সাফাই গাইলেন, “রেশন দোকানে তেল সরবরাহ পর্যন্ত আমাদের দায়িত্ব।“ তাহলে কলকাতা পুরসভা কী করছিল? মেয়র কমল বসু প্রথমে দাবি করলেন, “পুর ইন্সপেক্টরদের রেশন দোকানে তল্লাশির এক্তিয়ার নেই।“ জানা গেল, তাঁর দাবি ঠিক নয়। এবার চেপে ধরায় তিনি বললেন, “এলাকায় অসন্তোষ হতে পারে ভেবে রেশন দোকানে অভিযান হয়নি।“
জানা গিয়েছিল, সরিষার তেল (দাম প্রতি কেজি ২৬ টাকা) বিক্রি করার জন্য ট্রাইসাইল ফসফেটকে রেপসিড তেলের (দাম ১৪.৪০ টাকা কেজি) সঙ্গে মেশানোয় বিষক্রিয়া হয় বলে জানা গিয়েছিল। যদিও গরিব ভান্ডারে তৎক্ষণাৎ এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চের অভিযান হয়নি। সূত্রের খবর, মালিক চটজলদি ভেজাল তেলের মজুত দোকান থেকে সরিয়ে দেন। ফলে লঘু হয়ে যায় অভিযুক্তর বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ।
আজও পঙ্গু হয়ে মৃতপ্রায়ের মত বেঁচে আছে বেহালার সেই ভেজাল-তেল কান্ডে অসুস্থদের অনেকে। ওই আন্দোলনের ধাপে অনেকটাই উত্তরণ হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এক দশক ধরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। জাল টিকাকান্ডে আন্দোলন ভাঙার ঘুঁটি সাজাতে হচ্ছে তাঁকে। এভাবেই বুঝি ফিরে আসে ইতিহাস।
অশোক সেনগুপ্ত