বাসন্তী, কুলতলি, কুলপি, রায়দীঘি, মন্দিরবাজার, জয়নগর, বারুইপুর পূর্ব, ক্যানিং পশ্চিম, ক্যানিং পূর্ব, বারুইপুর পশ্চিম, মগরাহাট পূর্ব, মগরাহাট পশ্চিম, ডায়মণ্ডহারবার, ফলতা, সাতগাছিয়া, বিষ্ণুপুর—দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এই ১৬ আসনে নির্বাচন আগামীকাল, ৬ই এপ্রিল। এগুলির মধ্যে প্রথম ৯ টি আসন পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী ও অনুপ্রবেশ-প্রবণ। খুব বেশি ঘনবসতিপূর্ণ এই বিধানসভাক্ষেত্রগুলি ‘তৃণমূলের গড়’ কারণ এখানকার অধিকাংশ মানুষ তৃণমূলের ভোটার। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এইসব জায়গায় তৃণমূলের অমুসলিম নেতা, কর্মী ও সমর্থকরা যেভাবে পার্টি-আশ্রিত গুণ্ডাদের হাড়হিম করা সন্ত্রাসের থাবার মধ্যে বাঁচছেন ৩৬৫ দিন, তা নজিরবিহীন। তৃণমূলেরই মুসলিম ও অমুসলিম লবির মধ্যে অবিরত চলেছে দমবন্ধকরা নিঃশব্দ দ্বন্দ্ব যা জেলার তপশীলি ও সাধারণ হিন্দুদের ঠেলে দিয়েছে অভিষেক ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন যুব তৃণমূলের সন্ত্রাসের ফাঁদে যা থেকে বেরোনোর ব্যাপারে তাঁরা আশাবাদী নন। একটি তথ্য এই জেলার মানুষের দুর্গতির যৎসামান্য আভাস দিতে পারে। ২০১২ সাল থেকে শুরু করে গত ৮ বছরে পশ্চিমবঙ্গে যতগুলি বড় মাপের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, তার ২৫%ই হয়েছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়। ক্যানিং, মগরাহাট পশ্চিম, বারুইপুর পশ্চিম, ফলতা, ডায়মণ্ডহারবার ও মেটিয়াবুরুজ বিধানসভার সাধারণ মানুষ ভুগেছেন দাঙ্গায়। সীমান্ত মারফত অনবরত অনুপ্রবেশের কারণে এইসব জায়গার ডেমোগ্রাফি বদলাচ্ছে দ্রুত যা জেলার আদত বাসিন্দাদের করছে কোণঠাসা। আদত বাসিন্দাদের এক অংশ অবশ্য অনুপ্রবেশের পৃষ্ঠপোষক লবিকে তোষণ করছেন কিছুটা ভয়ে আর মূলতঃ বেআইনি রোজগারের লোভে। অনুপ্রবেশ এ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে এক বেআইনি ইণ্ডাস্ট্রিতে যার বেনিফিট শুধু মুসলিমরা নয়, জেলার অমুসলিমদের এক অংশও পাচ্ছেন। টিএমসি-পরিচালিত, সুপরিকল্পিত অনুপ্রবেশ জেলার তপশীলি ও সাধারণ হিন্দুদের অস্তিত্বকে করে তুলছে সংকটাপন্ন।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অধিকাংশ মানুষই যেখানে তৃণমূলের ভোটার, সেখানে তৃণমূলের পুরোনো অমুসলমান নেতা, কর্মী, সমর্থকরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। ফলতার এক ভদ্রলোক কোনোমতে বললেন, “আমাদের ফলতায় কোনো ভোট হবে না। জাহাঙ্গীর ঠিক করবে কে ভোট দেবে আর কে দেবে না। ফলতার অধিকাংশ হিন্দু বুথেই যাবে না”। কে জাহাঙ্গীর? ফলতায় অভিষেক ব্যানার্জীর ডান হাত তথা যুবাতৃণমূলের প্রধান সেনাপতি, যার বিরুদ্ধে মার্ডার চার্জ-সংক্রান্ত কোর্ট অর্ডার থাকা সত্ত্বেও এলাকার বোমা ও অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে যে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সোশ্যাল মিডিয়ার একটি ভাইরাল ভিডিও থেকে বোঝা গিয়েছিল যে জাহাঙ্গীর শুধু ভাইপোর নয়, পিসিরও প্রিয় পাত্র কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছিলেন ফলতার পাশাপাশি জাহাঙ্গীর ‘অপারেশন’ চালাক ক্যানিং-এও। ফলতার আর এক পুরোনো তৃণমূল নেতা ভক্তরাম মণ্ডল ফোনে জবাব দিলেন না আমার কোনো প্রশ্নেরই। এতখানিই সন্ত্রস্ত তিনি। এই মানুষগুলো কোনোপ্রকার নির্বাচনী পরিবর্তনের আশা রাখেন না। ডায়মণ্ডহারবারের একজন বলছিলেন, “আমরা চোর (সিপিএম) তাড়িয়ে ডাকাত (টিএমসি) এনেছি, এদের হাত থেকে আমাদের রেহাই নেই”। হতাশা গ্রাস করেছে ওঁদের। সূত্রের খবর— দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বহু মানুষকে ইতিমধ্যেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের নিজেদের বাড়ি থেকে অন্যত্র, যাতে ভোটের দিন তাঁরা হাজির হতে না পারেন বুথে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, একবিংশ শতাব্দীর পশ্চিমবঙ্গেও নির্বাচনী পরিবেশ এমনই।
৪ঠা এপ্রিল ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রে CRPF বাহিনী পৌঁছনোর পর তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী তাদেরকে ‘মার মার’ রবে লাঠি, পাথর নিয়ে আক্রমণ করে। ক্যানিং পূর্ব একটি সীমান্ত-নিকটবর্তী, অনুপ্রবেশ-দীর্ণ বিধানসভা, যার বিধায়ক তৃণমূলের শওকত মোল্লা, যেখানকার ৮২% ভোটই তৃণমূলের। শওকত মোল্লা সেই ব্যক্তি ১০ই ডিসেম্বর ডায়মণ্ডহারবার রোডে নড্ডার মিছিলে পাথরবাজি-হামলার সমর্থনে যে বলেছিল, “শুধু গাড়িতে হামলা হয়েছে, এরপর বিজেপির লোক রাস্তায় দেখলেই মানুষ পেটাবে”। এরাই রক্ষা করছে তৃণমূলের ক্ষমতার দুর্গ। এবারও ক্যানিং পূর্ব আসনে তৃণমূলের প্রার্থী শওকত মোল্লা, বিজেপির কালীপদ নস্কর আর আব্বাস সিদ্দিকি দাঁড় করিয়েছে গাজী সাহাবুদ্দিন সিরাজকে। পার্টিশন-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে মোল্লা-গাজীদের নির্বাচনী রমরমা কোন্ বার্তা বহন করে?
ফেব্রুয়ারী মাসে পৈলানের সভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন—“আগে আমার ভাইপোর সঙ্গে লড়াই করুন, তারপর আসবেন আমার কাছে”, তখন বোঝা গিয়েছিল অভিষেক-বাহিনীর দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের রাজত্বের প্রতি পূর্ণ সমর্থন আছে মুখ্যমন্ত্রীরও।
গত ২৮শে মার্চ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল একটি ভিডিওয় শোনা যায় মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ চৌধুরী মোহন জাটুয়ার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ফোনালাপ। মহিলা কণ্ঠটি অবিকল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত। তিনি সাংসদকে নির্দেশ দিলেন মন্দিরবাজারের বিজেপি প্রার্থী দিলীপ জাটুয়াকে মাটিতে পুঁতে দিতে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই কি ঘাতক হিংসায় লিপ্ত হওয়ার নির্দেশ দিলেন সাংসদকে? এমত ফোনালাপের পাঁচ দিনের মধ্যেই আক্রমণ হল ডায়মণ্ডহারবারের বিজেপি প্রার্থী দীপক হালদারের ওপর, গত ২রা এপ্রিল। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হল শ্রী হালদারকে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় নির্বাচন পরিচালনার্থে যে কোনো কিছুর জন্য আশা করি প্রস্তুত থাকবে নির্বাচন কমিশন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী নিরাপত্তা কর্মীরা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাতটি স্থান থেকে বোমা উদ্ধার করেছেন শুধুমাত্র মার্চ মাসে।
বারুইপুর পূর্ব বিধানসভা অঞ্চলে রয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ভারত সরকারের তরফ থেকে রোহিঙ্গাদের এদেশে প্রবেশের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও জলপথে বাংলাদেশ থেকে এদেশে বেআইনিভাবে তারা প্রবেশ করে পূর্ব বারুইপুরের হাড়দহ গ্রাম দিয়ে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী মহম্মদ কামরুজ্জামান দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ‘ইন-চার্জ’। ২০১৮ সালের ২০শে মার্চ তাঁর হুমকি ছিল—রোহিঙ্গাদের গায়ের লোমটুকু পর্যন্ত স্পর্শ করলে গোটা পশ্চিমবঙ্গকে স্তব্ধ করে দেওয়া হবে। এমত হুমকির ন’দিন পর ২৯শে মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকা রিপোর্ট করেছিল হাড়দহের বাইরে পশ্চিমবঙ্গের জলসীমান্তে এদেশে প্রবেশের জন্য অপেক্ষারত ৬০,০০০ রোহিঙ্গা। মহম্মদ কামরুজ্জামান এখন এরাজ্যের এক ‘মুসলিম-ইন্টেলেকচুয়াল’। নির্বাচনী প্রচারে সিপিএমের সুজন চক্রবর্তীকে তার সঙ্গে একই টেবিলে ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ আলোচনায় রত থাকতে দেখা গিয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী বারুইপুর পুলিশ বিভাগের অন্তর্গত নরেন্দ্রপুর থানার কান্তিপোতায় খেয়াদহ ভেড়ির পাশে টালির চালের এক বেড়ার ঘরে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর তাজা বোমা। এই স্থানটি রোহিঙ্গাদের অবস্থানক্ষেত্রের মধ্যে পড়ছে।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের দিন ডায়মণ্ডহারবারে তৃণমূলের মুসলিম ও অমুসলিম লবির মধ্যে সংঘাত বাঁধার পর স্থানীয় মসজিদ থেকে হাঁকা হয় হিন্দুবিরোধী যুদ্ধবার্তা। ফলতঃ শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাধারণ মানুষ চান গুণ্ডারা উচিত শিক্ষা পাক, কিন্তু আশাবাদী হতে পারেন না।
তৃণমূলের অক্ষয়-দুর্গ হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রতিটি বিধানসভায়ই বিজেপির ভোট বেড়েছে তাৎপর্যপূর্ণভাবে।
বিধানসভা ২০১৬’র বিধানসভার তুলনায় ২০১৯’র লোকসভায় BJP’র ভোটের % বৃদ্ধি
কিন্তু ২০১৬’র তুলনায় ২০১৯ এ বিজেপির ভোট বাড়লেও কেবলমাত্র রায়দীঘি ছাড়া উক্ত বিধানসভাগুলির অন্য সবকটিতেই শতকরা ভোটের হিসাবে বিজেপির চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে এগিয়ে আছে তৃণমূল। ২০১৯ লোকসভায় রায়দীঘি বিধানসভা অঞ্চলেও লিড নিয়েছিল তৃণমূলই, কিন্তু মার্জিন বেশি ছিল না। ২০১৯’র লোকসভায় উক্ত বিধানসভাগুলিতে বিজেপির ভোট বেড়েছিল মূলতঃ সিপিএম বা কংগ্রেসের ভোট কেটে। কেবলমাত্র বারুইপুর পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির বাক্সে এসেছে এমনকি তৃণমূলেরও ৫.৪৪% ভোট।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় নির্বাচন পরিচালনা করতে গিয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে যাতে জেলার সর্বত্র অমুসলিম ভোটাররা নির্ভয়ে, ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতি-সম্পর্কে আতঙ্কিত না হয়েই ভোটদান করতে আসতে পারেন। তার জন্য স্থানীয় গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
হাওড়া
উলুবেড়িয়া উত্তর ও দক্ষিণ দুই বিধানসভাতেই ২০১৯ এর লোকসভায় বিজেপির ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে তাৎপর্যপূর্ণভাবে। দুইটি বিধানসভাই তপশীলি জাতি ও উপজাতি-প্রধান এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ মূলতঃ কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির অর্থমূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এবং তৃণমূলের নেতা কর্মীদের অযথা আর্থিক বাড়বাড়ন্ত দেখে। দুর্নীতিগ্রস্ত (SSKM হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস খ্যাত)চিকিৎসক প্রার্থী তৃণমূলের নির্মল মাঝি এবার উলুবেড়িয়া উত্তর থেকে হারবেন— এমন কথাই ভাসছে হাওয়ায়। উলুবেড়িয়া দক্ষিণে ২০১৯ এর লোকসভায় তৃণমূলের ভোট কমেছিল ২০১৬য় তাদের নিজেদের ভোটের তুলনায়। মানুষের ক্ষোভ এলাকায় স্পষ্ট। বাগনান, আমতা, উদয়নারায়ণপুরে বিজেপি তার শক্তিবৃদ্ধি করলেও এই তিনটি বিধানসভায় বৃদ্ধি পেয়েছে তৃণমূলের ভোটও। বাগনান, আমতা ও উদয়নারায়ণপুরের এবার তৃণমূলের কাছে থাকার সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে, শ্যামপুর ও জগতবল্লভপুর যেতে চলেছে বিজেপির সঙ্গে।
হুগলী
হুগলী হয়ত সামগ্রিকভাবেই নির্বাচন করতে চলেছে বিজেপিকে। তৃণমূলের ওপর মানুষের ক্ষোভ ও বিরক্তি লক্ষ্য করে হুগলী জেলায় নিজেদের জমি বিজেপি প্রস্তুত করেছিল লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই। তৈরি জমিতে এই নির্বাচনে সেই জেলায় বিজেপির বড় বড় সমাবেশ, প্রধানমন্ত্রী মোদীর বক্তৃতা, বিশেষতঃ তারকেশ্বরে, এবং যে ধরণের নির্বাচনী সংকল্প বিজেপির তরফ থেকে নেওয়া হয়েছে, তারপর হুগলী জেলায় গৈরিক অভ্যুত্থান প্রত্যাশিত।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য