মহানায়ক উত্তম কুমার দিব্যি ছিলেন তার ভদ্র, শান্ত, রোমান্টিক ইমেজ নিয়ে; তাকে ‘অমানুষ’ বানালেন পরিচালক শক্তি সামন্ত। তার হাত ধরেই হিন্দি সিনে পাড়ায় পায়ের তলায় মাটি খেুঁজে পেয়েছেন শর্মীলা ঠাকুর, শাম্মী কাপুর, রাজেশ খান্নারা। এভাবেই নতুন ইমেজ, নতুন ধারা, নতুন কাহিনি দিয়ে মুম্বাই সিনেজগতের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিলেন যে শক্তিশালী পরিচালক তার নাম শক্তি সামন্ত। বলিউডে রাজত্ব করা বাঙালি পরিচালকদের অন্যতম ছিলেন তিনি।
শক্তি সামন্তর জন্ম ১৯২৬ সালের ১৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। দেরাদুনে স্কুলের পাট চুকিয়ে ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন।
শক্তি সামন্তর ইচ্ছা ছিল অভিনেতা হওয়ার। তাই তিনি মুম্বাই চলে যান। ১৯৪৮ সালে তিনি সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। রাজকাপুর অভিনীত সতীশ নিগম পরিচালিত ‘সুনহেরে দিন’ ছবিতে তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি গণেষ মুখার্জি ও ফণি মজুমদারের মতো নামজাদা পরিচালকের সহকারি হিসেবে কাজ করেন।
১৯৫৪ সালে শক্তি সামন্ত পরিচালিত প্রথম ছবি ‘বহু’ মুক্তি পায়। ছবিটি ব্যবসা সফল হওয়ায় পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পথে দ্রুত এগিয়ে যান তিনি। একে একে মুক্তি পায় তার পরিচালিত ‘ইন্সপেকটর’, ‘শেরু’, ‘ডিটেকটিভ’ এবং ‘হিল স্টেশন’। প্রতিটি ছবিই ব্যবসা সফল হয়।
এরপর ১৯৫৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান- শক্তি ফিল্মস। শক্তি ফিল্মস থেকে মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমা- ‘হাওড়া ব্রিজ’। অশোক কুমার ও মধুবালা ছিলেন এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে। সিনেমার সংগীত পরিচালক ছিলেন ওপি নায়ার। আশা ভোঁশলের কণ্ঠে গানগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ব্যবসায়িক দিক থেকে ‘হাওড়া ব্রিজ’ রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করে। দারুণ বাণিজ্যিক সাফল্য, রহস্য রোমাঞ্চ, নতুন ধরণের গল্প, অসাধারণ অভিনয় আর দুর্দান্ত পরিচালনা- সব মিলিয়ে সিনেমাটি দর্শকদের মন জয় করে নেয় খুব সহজেই। এছাড়া, মধুবালার সৌন্দর্য দারুণ গ্ল্যামারাসভাবে ফুটে ওঠে পর্দায়। অন্যদিকে, গীতা দত্তের প্লেব্যাকে ‘মেরা নাম চিন চিন চু’ গানের সঙ্গে অসাধারণ নৃত্য ভঙ্গিমা প্রদর্শন করে আবেদনময়ীরূপে প্রতিষ্ঠা পান হেলেন।
সুনীল দত্ত-মধুবালা অভিনীত ‘ইনসান জাগ উঠা’ সিনেমায় শক্তি সামন্ত সমাজ পরিবর্তনের বক্তব্য তুলে ধরেন। কিন্তু সমালোচকদের প্রশংসা পেলেও ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য খুব একটা পায়নি। ফলে শক্তি সামন্ত আবার বাণিজ্যিক ধারার ছবি নির্মাণে মনোযোগী হন।
১৯৬২ সালে সুপার ডুপার হিট হয় ‘চায়না টাউন’। শাম্মি কাপুর অভিনীত ছবিটিকে বলা যায় হিন্দি ছবির এক ট্রেন্ডসেটার। নতুন ধারার এই ছবিতে খ্যাতির আলোয় চলে আসেন শাম্মীকাপুর।
১৯৬৪ সালে ‘কাশ্মির কি কলি’ ছবির মাধ্যমে বলিউডকে1 আবারও এক নতুন তারকা উপহার দেন শক্তি সামন্ত। তিনি হলেন বাঙালি মেয়ে শর্মিলা ঠাকুর। এর আগে শর্মিলা ঠাকুর সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসা ও সাফল্য পেয়েছেন । কিন্তু গ্ল্যামার, বাণিজ্যিক সফলতা ও চোখ ধাঁধানো বিনোদনের জগতে তাকে নিয়ে আসেন শক্তি সামন্ত।
‘কাশ্মির কি কালি’র জলপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় শর্মিলা ঠাকুরকে নিয়ে তিনি কাজ করেন ‘সাওয়ান কি ঘাটা’, ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’, ‘আরাধনা’র মতো সিনেমায়।
এরমধ্যে ১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া্ ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’-এ ছবিতে বিকিনি পরিহিতা শর্মিলা ঠাকুরের আবেদনময়ী রূপ প্রথমবারের মতো দেখে হিন্দি ছবির দর্শক। বাণিজ্যিক সাফল্য পাওয়া এই সিনেমার মাধ্যমেই শাম্মি কাপুরও গড়ে তোলেন তার আধুনিক ইমেজ।
১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় ‘আরাধনা’। রাজেশ খান্না-শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত অসামান্য প্রেমের ছবি।‘আরাধনা’কে বলা যায় রোমান্টিক ছবির জগতে এক মাইল ফলক। রাজেশ খান্নাকে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিতই করেন শক্তি সামন্ত। রাজেশ-শর্মিলা জনপ্রিয় জুটির যাত্রা শুরু হয় ‘আরাধনা’র মাধ্যমে। এ ছবির গানগুলো আজও চিরসবুজ প্রেমের গানের তালিকায় রয়েছে। ‘মেরে সপনে কি রাণী কাব আয়েগি তু’ গানটির সঙ্গে ট্রেনের কামরায় শর্মিলা ঠাকুর ও জিপ গাড়িতে রাজেশ খান্নার দৃশ্যায়ন ছিল দারুণ সুন্দর। পরিচালকের মুন্সিআনায় ‘আরাধনা’ হয়ে ওঠে সর্বকালের অন্যতম সেরা প্রেমের ছবি| বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষায় নির্মিত হয় সিনেমাটি।
রাজেশ খান্না-আশা পারেখ অভিনীত ‘কাটি পাতাং’ও শক্তি সামন্ত পরিচালিত একটি অসাধারণ প্রেমের ছবি। এ ছবির সংগীতও ছিল দুর্দান্ত। সুপার হিট হয় এ ছবিটিও।
‘চায়না টাউন’, ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস’, ‘কাশ্মির কি কলি’, ‘পাগলা কাহিকা’তে একদিকে যেমন শাম্মি কাপুরকে প্রতিষ্ঠিত করেন শক্তি সামন্ত তেমনি অন্যদিকে ‘আরাধনা’, ‘কাটি পাতাং’, ‘অমর প্রেম’ , ‘আজনবি’, ‘মেহেবুবা’র মাধ্যমে প্রেমিক রাজেশকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। প্রতিটি ছবিই বাণিজ্যিক ভাবে তুমুল সাফল্য পায়।
বিনোদ মেহরা-মৌসুমী চ্যাটার্জি অভিনীত ‘অনুরাগ’ সিনেমাটি ‘আরাধনা’র মতোই দ্বিভাষিক। এটিও বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল। সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ফিল্ম ফেয়ার আসরে পুরস্কৃত হয় ছবিটি। এটি পরে মালায়াম ও তেলেগু ভাষাতে রিমেইক হয়। তেলেগু ছবিতে অভিনয় করেন শ্রীদেবী।
১৯৭৫ সালে উত্তম কুমারকে নতুন ইমেজে উপস্থাপন করেন শক্তি সামন্ত ‘অমানুষ’ ছবির মাধ্যমে। সুন্দরবনের পটভূমিকায় ছবিটিতে উত্তম কুমার, শর্মিলা ঠাকুর ও উৎপল দত্ত অসাধারণ অভিনয় করেন। মারদাঙ্গা ছবিতে সেই প্রথম অভিনয় করেন উত্তম কুমার। নতুন ওই ভূমিকায় দিব্যি মানিয়েও যায় তাকে। এ ছবিটি দ্বিভাষিক ছিল। ‘অমানুষ’ দুর্দান্ত ব্যবসা করে। এ ছবির গান ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর’ বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।
১৯৭৭ সালে তার পরিচালিত উত্তমকুমার, শর্মিলা ঠাকুর ও উৎপল দত্ত অভিনীত ‘আনন্দ আশ্রম’ও দ্বিভাষিক ছবি। এ ছবিটিও সুপার হিট হয়। এ ছবির ‘আশা ছিল ভালোবাসা ছিল’, ‘পৃথিবী বদলে গেছে’, ‘আমার স্বপ্ন তুমি’ গানগুলো এখনও চিরসবুজ প্রেমের গান হিসেবে স্বীকৃত।
শক্তি সামন্ত পরিচালিত অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘দ্যা গ্রেট গ্যাম্বলার’ দারুণ সাফল্য পায়। অমিতাভ বচ্চনের অভিনয়ে আরেকটি দ্বিভাষিক ছবি নির্মাণ করেন শক্তি সামন্ত। ‘বারসাত কি এক রাত’ (বাংলায় ‘অনুসন্ধান’) ছবিতে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন, রাখি, উৎপল দত্ত। ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়।
১৯৮৫ সালে মিঠুন চক্রবর্তি, রোজিনা, উৎপল দত্ত, অমল বোস অভিনীত ‘অন্যায় অবিচার’ও দ্বিভাষিক ছবি। এটি বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার ছবি।বাংলাদেশে ও কলকাতায় দুর্দান্ত ব্যবসা করে ছবিটি।
শক্তি সামন্ত ছয়টি দ্বিভাষিক ছবি নির্মাণ করেন।
বাংলায় তিনি নির্মাণ করেন ‘দেবদাস’, ‘অন্ধবিচার’সহ কয়েকটি ছবি।
পরিচালক-প্রযোজক দুই ভূমিকাতেই অপরিসীম সাফল্য পান শক্তি সামন্ত। তার ছবি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি এমনটি খুব কমই হয়েছে।
সেরা চলচ্চিত্রের জন্য শক্তি সামন্ত ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার জয় করেছেন ‘আরাধনা’, ‘অনুরাগ’, ‘অমানুষ’ ছবির সুবাদে। বার্লিন, তাশখন্দ, মস্কো, কায়রো, বৈরুতসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসা কুড়িয়েছে তার ছবি।
তিনি ছিলেন পুরোপুরি বাণিজ্যিক ধারার পরিচালক। দর্শককে কিভাবে বিনোদন দিতে হয়, কিভাবে আবেগে আপ্লুত করতে হয় সেই শিল্প ছিল তার সম্পূর্ণ আয়ত্তে।
২০০৯ সালে ৯ এপ্রিল এই গুণী পরিচালক মুম্বাইতে মৃত্যুবরণ করেন। তবে প্রতিভাবান এই বাঙালি চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব বেঁচে আছেন তার পরিচালিত দর্শকনন্দিত অসংখ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।