ছোটবেলা মায়ের হাত ধরে হাটতে শেখা থেকে প্রবীণ বয়সে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হওয়া অব্দি পুরো জীবনটাই আমরা কিছু না কিছু শিখি। আর এই প্রতিদিনের শিক্ষাই মানুষ হিসাবে আমাদের করে তোলে উন্নত থেকে উন্নততর এবং বিকাশ হয় আমাদের ব্যক্তিত্বের।একটি বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন তার মজবুত ভিতটাই নিশ্চিত করে বহুতলটির স্থায়িত্ব, ঠিক সেরকম ভাবেই আমাদের ছাত্রজীবন বা শৈশব, কৈশোরের শিক্ষাটাই আমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করে। আজ শিক্ষক দিবসে সর্বাগ্রে বিনম্র প্রণাম জানাই আমার সমস্ত শিক্ষক এবং শিক্ষিকাদের, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যই আমি আজ মাথা তুলে এই সমাজে দাড়িয়ে আছি। বিশেষ ভাবে স্মরণ করতে চাই আমার (এবং সবার) জীবনের প্রথম শিক্ষক আমার মা কে।
“আকাশ থেকে কেন বৃস্টি পরে?”, “পাখি উরতে পারে আমি কেন পারিনা?”, “দুর্গা ঠাকুর সরস্বতী ঠাকুরকে সুন্দর হাঁস দিল, তাহলে গনেশ ঠাকুর কে ওই ছোট্ট ইঁদুর কেন?” আমার এইসব অজস্র প্রশ্নের উত্তর ক্লান্তিহীনভাবে যিনি হাসি মুখে দিয়েছেন উনি আমার মা। ছোটবেলার বর্ণপরিচয় থেকে প্রবাস জীবনে রান্নার ফোঁড়ন সব কিছুই আজও ক্লান্তিহীন ভাবে শিখিয়ে চলেছেন আমার মা। আজও জীবনে কোন ওঠাপড়া এলেই মনে হয়ে ইসশ! সেই দিন গুলো কত্ত ভাল ছিল যেদিন মায়ের কাছে আমার সমস্ত সমস্যার সমাধান ছিল।
মা ছিলেন আমার খেলার সাথী, আমার শিক্ষিকা, আমার চিকিৎসক, আমার বন্ধু। আজকাল সমাজে প্রবীণদের অপমান করাটাই সবথেকে ‘Cool’ আচরণ আর মহিষীদের অপমান করার মধ্যেই যেন আধুনিকতার পরিচয়। সেটা দোলের সময় রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের অভব্য আচরণ হোক বা stand up comedy- এর নামে নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতিকে বার বার অপমান করাই হোক। খবরে দেখি স্কুলে গিয়ে অভিভাবিকগন শিক্ষক- শিক্ষিকাদের ঘেরাও করে তাদের অকৃতকার্য সন্তানদের জোর করে পাশ করানোর অন্যায় আবদার নিয়ে। আমায় তো আমার মা এমন শিক্ষা কখনও দেননি যেখানে শিক্ষককে সন্দেহ করা যায় তার পরীক্ষা নেওয়ার যোগ্যতা নিয়ে।
কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে শিক্ষক তার সবটুকু দিয়ে তার ছাত্রছাত্রী দের পড়ান, সেই সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়াকে শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেদের ব্যর্থতা বলেই মনে করেন। কলেজ ছাত্রদের দ্বারা অধ্যাপকের নিগৃহীত হওয়ার মত ঘটনা আজকাল আমাদের কাছে যেন জলভাত। এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে? ডিগ্রি, চাকুরী এগুলোতো অনেক দুরের কথা, আমরা তো বারবার এটাই প্রমাণ করছি যে মানুষ হিসাবে আমরা সবাই ডাহা ফেল, তাই এইসব নাক্কারজনক ঘটনাকে আমরা স্বাভাবিক মনে করি।আবার পাশাপাশি এটাও দেখি আজকাল শিক্ষা প্রদানের নামে কোচিং সেন্টার গুলোর রমরমা ব্যাবসা।
স্কুলে, কলেজে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক অত্যাচার করা হয় শিক্ষকদের কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্য। সম্প্রতি খবরে দেখলাম দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে গবেষণা করার পরও একজন ছাত্রীকে তার PhD Guide গবেষণা পত্র উপস্থাপন করতে বাধা দিলে, ছাত্রীটি মানসিক অবসাদের কারণে আত্মাহত্যা করে। এই শিক্ষক দিবসের পুণ্য দিনে আমার মনে হয় আমাদের একটু ভেবে দেখা দরকার আমাদের কি ধরণের শিক্ষার প্রয়োজন। ডিগ্রি বা চাকরীর তুলনায় মানবিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আজ অনেক বেশী। নাহলে শিক্ষিত হয়ে আমরা অনেক পুঁথিগত জ্ঞান আমরা অবশ্যই অর্জন করব কিন্তু সেই জ্ঞান আমরা মানব কল্যানে ব্যবহার না করে বরঞ্চ নাৎসি বাহিনির মত গ্যাস চেম্বার তৈরি করার কাজে লাগাব।
রচনায় : শতাব্দী ভট্টাচার্য