আমেরিকার সাম্প্রতিক উথাল পাথালে ক্যালিফোর্নিয়ার ভারতীয় বংশোদ্ভুত ছাত্রদের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা

এক কৃষ্ণকায় ব্যক্তির পুলিশি অত্যাচারে মৃত্যুর প্রতিবাদে উত্তাল সারা আমেরিকা. সেই আন্দোলনের প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, উপরে ফেলা হচ্ছে – অনেক প্রতিষ্ঠিত নায়কদের মূর্তি. হাত পরেছে গান্ধী মূর্তির ওপর – আমেরিকার রাজধানী ও বিভিন্ন শহরে. একই ভাবে আশঙ্কার কালো ছায়া ঘনাচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার ভারতীয় বংশোদ্ভুত ছাত্রদের ভবিষ্যতের উপর.
ভারতে চাকরি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন বর্গকে বিভিন্ন ধরণের বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে. এই সুযোগ সুবিধার চরিত্র ও বিস্তার নিয়ে অভিযোগ অনুযোগ ও বিস্তর. একই চিত্র আমেরিকাতেও. ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে এই সুযোগ সুবিধায় পার্থক্য থাকে, আমেরিকাতেও. এখানেও সুযোগ সুবিধার ছবি রাজ্যে রজ্যে বিভিন্ন. এই ক্ষেত্রে ক্যালিফোর্নিয়ার চিত্র অন্যান্য রাজ্যের চাইতে আলাদা.
পঁচিশ বছর আগে (1996) ক্যালিফোর্নিয়ার নাগরিকরা ভোটের মাধ্যমে রাজ্যের সংবিধান সংশোধন করে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত (Proposition 209 বা Prop 209) নেন: সরকারী সংস্থাগুলিতে, বিশেষ করে চাকরি, ব্যবসা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতি (Race), লিঙ্গ (sex) এবং গোষ্ঠী (ethnicity) কে প্রাধান্য (consider করা) দেওয়া চলবে না.
জাতি ও বর্গ ভিত্তিক সংরক্ষণের সমর্থকরা Prop 209 কে শুরু থেকেই মেনে নিতে নারাজ. এই সিদ্ধান্ত কৃষ্ণকায়, লাতিনো এবং অন্যান্য পিছিয়ে থাকা মানুষের স্বার্থ বিরোধী এই আওয়াজ তুলে আদালতের কড়া নারিয়েছেন বার বার. সেই দাবী প্রতিবার নাকচ করেছে আদাদালত. 2010 সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সুপ্রিম কোর্ট Prop 209 কে সংবিধান সম্মত ঘোষণা করে. 2014 সালে ডেমোক্রাট সংখ্যা গরিষ্ঠ ক্যালিফোর্নিয়া সেনেট সংবিধান সংশোধন করে Prop 209 কে বাতিল করার প্রস্তাব পাশ করে. কিন্তু চীন বংশদ্ভুত আমেরিকান (চাইনিজ-আমেরিকান)সেনেট সদস্য ও সংগঠনগুলির বিরোধিতায় সেই সংশোধনী কার্য্যকর করা হয় নি.
কোন বর্গের বিশেষ সুবিধা না থাকায় খুশি এশিয়ান-আমেরিকানরা. এশিয়ান-আমেরিকান বলতে এক কথায় চীন, জাপান, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের বোঝায়. ক্যালিফোর্নিয়ার জনসংখ্যার পনেরো শতাংশ এই জনগোষ্ঠীর ছাত্ররা(এবং ছাত্রীরা) ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার কলেজগুলিতে ভর্তির প্রতিযোগিতায় তিরিশ থেকে পয়ত্রিশ শতাংশ আসন লাভ করে থাকে.
জনসংখ্যার পনেরো শতাংশ এই জনগোষ্ঠীর ছাত্ররা কেন তিরিশ থেকে পয়ত্রিশ শতাংশ দখল করবে এই হয়েছে তথাকথিত প্রগতিশীলদের মাথা ব্যথা. অথচ,অন্যান্য জনগোষ্টির(কালোরা ছাড়া) মতন এরাও ইমিগ্রান্ট বা অভিবাসী এবং বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত. কোন বিশেষ সুবিধাভোগী নয়.
জনসংখ্যার এবং স্কুল পাশ করা ছাত্রদের জাতি/বর্ণ অনুপাত উচ্চশিক্ষার ছাত্র বিন্যাসেও প্রতিফলিত হওয়া উচিত এই বদ্ধ চিন্তার লক্ষ্য পূরণে Prop 209 কে এড়াতে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া পরীক্ষার নম্বর ছাড়াও এক ডজনেরও বেশি মানদন্ড (criteria) চালু করেছে. যেমন, আর্থসামাজিক ভিত্তি, বিদ্যালয়ে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা, পারিবারিক অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি. সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হল, সমস্ত হাইস্কুলের প্রথম 4% ছাত্র ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার কলেজগুলিতে ভর্তির সুযোগ পাবে. এর ফলে পিছিয়ে পরা স্কুলের ছাত্ররা প্রথম সারির স্কুলের ছাত্রদের চাইতে অনেক কম নম্বর পেয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে. ক্ষতিগৃস্থ হবে প্রথম সারির স্কুলের অনেক মেধাবী ছাত্র, যাদের সিংহ ভাগ এশিয়ান আমেরিকান.
এই নতুন মানদন্ডগুলির প্রভাবে গত দশ বছরে ছাত্র সংখ্যায় কালোদের অনুপাত 4.3% থেকে বেড়ে হয়েছে 4.7%, লাতিনোরা লক্ষ্যনীয় ভাবে বেড়েছে 23% থেকে 34.3%. এশিয়ানরাও এগিয়েছে, 33.9% থেকে 35.7%. সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সাদারা, তাদের অনুপাত কমেছে 32% থেকে 22%.
আপাত: দৃষ্টিতে এশিয়ানরা অক্ষত এটা মেনে নিতে নারাজ ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলেসের অধ্যাপক রিচার্ড স্যান্ডার. ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ভর্তির মানদন্ড Prop 209 এর উদ্দেশ্য কে লঙ্ঘন করছে এই অভিযোগ নিয়ে 2018 সালে দ্বারস্থ হয়েছেন আদালতের. একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে দাবী করেছেন যে নতুন নতুন মানদন্ডের ফলে গত পাঁচ বছরে 1300 এশিয়ান ছাত্র ছাত্রী ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় ভর্তির সুযোগ হারিয়েছে. মামলা চলছে.
সাদাদের বড় দুরবস্থা. তাদের হয়ে বলাটা পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট. সুতরাং ওদের ভাবনা (কেন ওরা কমছে) ওরা ভাবুক. কিন্তু এশিয়ান ছাত্রদের অনুপাত কমেনি. বরং অতি সামান্য হলেও বেড়েছে. তাই আরো কিছু করা প্রয়োজন যাতে ওদেরও কমানো যায়.
অতএব আবার আক্রমণের লক্ষ্য Prop 209. বারবার আদালতে হার, ক্যালিফোর্নিয়া সেনেটে প্রস্তাব পাস করিয়েও কার্য্যকর করা গেল না. ‘প্রগতিশীল’রা একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন. সাম্প্রতিক ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার ও সহযোগী বিপ্লবীদের আমেরিকাব্যাপী আন্দোলন এনে দিল সেই সুযোগ. গত 15ই জুন, 2020 ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার নিয়ন্ত্রক কমিটি (Regent) জাতি-বর্ণ ভিত্তিক সুবিধা বিরোধী Prop 209 কে বাতিল করার সমর্থনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে.
একই সঙ্গে 24শে জুন, 2020 ক্যালিফোর্নিয়া সেনেট 30-10 ভোটে Prop 209 বাতিল করার প্রস্তাব পাস করেছে. তবে, আইনত: Prop 209 বাতিল করার একটি ধাপ এখনো বাকি. আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে Prop 209 বাতিল করার প্রস্তাবকে জনসাধারণের ভোট জিততে হবে.
স্বাভাবিক ভাবেই আফ্রিকান-আমেরিকান ও লাতিনো সংগঠনগুলি Prop 209 বাতিল করার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়াছে. অন্য দিকে বিরোধিতা করেছে চীন বংশদ্ভুতদের সংগঠন The Asian American Coalition for Education (AACE) এবং (Silicon Valley Chinese Association Foundation (SVCAF).
শুধু ক্যালিফোর্নিয়া নয়, এশিয়ান আমেরিকান ছাত্রদের বিরুদ্ধে এই অভিযানের অভিযোগে অভিযুক্ত খোদ হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়. 60 টি আমেরিকান-চাইনিজ সংগঠন মামলা করেছে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে. একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, এশিয়ান আমেরিকান ছাত্রকে ভর্তির জন্য ভর্তির পরীক্ষায় গড়ে একটি সাদা ছাত্রের চাইতে 140 নম্বর, লাতিনো ছাত্রের চাইতে 270 নম্বর এবং কালো ছাত্রের চাইতে 450 নম্বর বেশি পেতে হয়.
আশ্চর্য্যজনক ভাবে নীরব ভারতীয়-আমেরিকান সংগঠন ও প্রতিনিধিরা.
ক্যালিফোর্নিয়ায় (California) উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী ভারতীয়-আমেরিকান ছাত্রদের দুর্দশার দিন শুরু?

স্যাক্রামেন্টো, ক্যালিফোর্নিয়া

মানস রায় (Manas Roy)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.