ভগিনী নিবেদিতা, ‘দ্য মাস্টার অ্যাজ আই স হিম’ গ্রন্থে শ্রীমা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তারই কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলাে :
“অদ্ভুত এক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হলাম। আমাদের ক্ষুদ্র গােষ্ঠীর যিনি কর্ত্রী—তাঁর বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়া ধৃষ্টতা। তাঁর জীবনের ইতিহাস সর্ববিদিত। পাঁচ বছর বয়সে পরিণয়, আঠারাে বছর বয়স পর্যন্ত তাঁকে স্বামীর বিস্মরণ, তারপরে মায়ের অনুমতি নিয়ে গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে গঙ্গাতীরে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে স্বামী সমীপে গমন, বিবাহবন্ধনের কথা স্বামীর স্মরণে আসা, কিন্তু যে জীবন বরণ করেছেন, তারই আদর্শের কথা পত্নীকে শােনানাে। উত্তরে, ওই জীবনপথের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণকামনা করে স্বামীকে গুরুরূপে বরণ করে পত্নী কর্তৃক শিক্ষা প্রার্থনা—এ সমস্ত কথাই বহু কথিত। তারপর থেকে তিনি বহু বছর পরম আনুগত্যের সঙ্গে স্বামীর কাছে বাস করেছেন, দক্ষিণেশ্বরের বাগানেরই একটি কক্ষে থাকতেন,—একই সঙ্গে সহধর্মিণী ও সন্ন্যাসিনী এবং শিষ্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিষ্যা। তরুণ বয়সেই শিক্ষার সূচনা হয়েছিল।”
..“অথচ মায়ের চরিত্রের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য, আরাধ্য স্বামীর বিষয়ে কথা বলবার সময়ে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের আভাস কখনাে ফোটে না। স্বামীর প্রতিটি কথাকে সফল করবার জন্য তিনি সর্বাবস্থায়, বিপদে বা সম্পদে সুমেরুবৎ অটল, কিন্তু সেই স্বামীকে তিনি ‘ঠাকুর’ বা ‘গুরুদেব’ ছাড়া কিছু বলেন না, কখনাে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কসূচক আত্মগরিমাযুক্ত একটি কথাও তাঁকে বলতে শােনা যায়নি। তাঁকে জানে না এমন কারাে পক্ষে তাঁর কথাবার্তা থেকে কোনওমতে অনুমান করা সম্ভব নয় যে, চারপাশের অন্য কারও থেকে শ্রীরামকৃষ্ণের ওপর তাঁর দাবি অধিকতর বা তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর! শিষ্যার মধ্যে পত্নী হারিয়ে গেছে দীর্ঘদিন আগে, যদিও পত্নীর পরম বিশ্বস্ততাটুকু রয়ে গেছে। তথাপি, তাঁর প্রতি সকলের ভক্তির সীমা নেই, প্রতি ক্ষেত্রে তা প্রকাশ পায় যেমন দৃষ্টান্তরূপে বলা হয়, তাঁর সঙ্গে ট্রেনে- ভ্রমণকালে তিনি তলার বেঞ্চে থাকলে উপরের বাঙ্কে উঠবার কথা কেউ ভাবতেই পারে না। তাঁর উপস্থিতিই যে একটা দিব্য ব্যাপার।”
…“সারদাদেবী ভারতীয় নারীত্বের আদর্শ সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের চরম বাণী-এই কথাই সবসময় আমার মনে হয়েছে। কিন্তু তিনি কি প্রাচীন আদর্শের শেষ কথা, না নতুন আদর্শের প্রথম প্রকাশ? প্রজ্ঞা ও মাধুর্যের সমন্বয় সরলতম নারীজীবনেও কীভাবে করা সম্ভবপর তাঁকে দেখলে তা বােঝা যায়। …এক দীর্ঘ নীরব প্রার্থনার মতাে তাঁর সমগ্র জীবন।”
“শ্রীমা পড়তে পারেন। রামায়ণ পাঠে অনেক সময় কাটে। কিন্তু লিখতে পারেন না। তবু মনে করার কারণ নেই তিনি অশিক্ষিতা নারী। সাংসারিক অথবা ধর্মীয় বিষয় পরিচালনায় দীর্ঘ কঠিন অভিজ্ঞতাই তাঁর নেই শুধু, অধিকন্তু ভারতের নানাস্থানে ভ্রমণ ও প্রধান প্রধান তীর্থস্থানগুলি দর্শনের অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। সর্বোপরি, শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণীরূপে মানবের পক্ষে সর্বোচ্চ-সম্ভব আত্মবিকাশের সৌভাগ্য তিনি পেয়েছেন। বিরাটের সঙ্গী ও সাক্ষী হবার মহিমাকে তিনি প্রতি মুহূর্তে অসচেতনে বহন করেছেন। তাঁর গরিমাকে পূর্ণোচ্চারিত হয়ে উঠতে দেখা যায়, যখন তিনি যে কোনও নতুন ভাব বা অনুভূতির মর্মভেদ করেন অবিলম্বে, অব্যর্থভাবে।”
…“শ্রীমায়ের আবাসে দিনগুলি শান্তি ও মাধুর্যে ভরা। প্রত্যুষের অনেক আগেই সকলে একে একে নিঃশব্দে শয্যাত্যাগ করে, বিছানা মাদুরের উপর থেকে চাদর ও বালিশ সরিয়ে, তার উপরে স্থির হয়ে বসেন, মুখ ঘােরানাে থাকে দেওয়ালের দিকে, হাতে ঘুরতে থাকে জপের মালা।
তারপরে ঘর পরিষ্কারের ও স্নানাদির সময় আসে। পর্বের দিনে শ্রীমা এক সঙ্গিনীর সঙ্গে পালকিতে গঙ্গাস্নানে যান। তার পূর্ব পর্যন্ত রামায়ণ পড়েন। তার পরে নিজের ঘরে মা পুজোয় বসেন।
অল্পবয়সীরা প্রদীপ জ্বালায়, ধূপ-ধুনা দেয়, গঙ্গাজল, ফুল ও পূজার জোগাড় করে। এই সময়ে গােপালের মাও এসে নৈবেদ্য তৈরিতে সাহায্য করেন। তারপর দুপুরের আহার ও বিকালের বিশ্রাম; সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, ঝি লণ্ঠন জ্বালিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়ায় আমাদের বাক্যালাপের মধ্যে; সকলে উঠে পড়ে; পট বা বিগ্রহের সামনে আমরা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি, গােপালের মা ও শ্রীমায়ের পদধূলি নিই, কিংবা বাধ্য মেয়ের মতাে সঙ্গে ছাতে উঠে গিয়ে, তুলসীতলায় যেখানে প্রদীপ দেওয়া হয়েছে, সেখানে গিয়ে বসি, বহুভাগ্য তার যে মায়ের পাশে তাঁর সান্ধ্য ধ্যানের সময়ে বসবার অনুমতি পায়,–মায়ের সব পূজার শুরু ও শেষ যে গুরু প্রণামে, সেই প্রণাম করতে শেখে স্বয়ং মায়ের কাছ থেকে!”
সুতপা বসাক ভড়