মাননীয় অর্থমন্ত্রী শ্রী অমিত মিত্রের বাজেট বক্তৃতা পড়ার সৌভাগ্য হল। অমিত বাবু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আসার আগে অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান গুলির ছাত্র ছিলেন, স্বনামখ্যাত ডিউক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিস্টিঙ্গুইশড এলুমনির তালিকায় রেখেছে; এই বিষয় গুলি মাথায় রেখেই আমি কয়েকটি প্রশ্ন করা সমীচীন মনে করছি।
প্রারম্ভিক ভাষণে অমিতবাবু বলেছেন, বিগত ৮ বছরে বাংলায় ২২২৬৭ কোটি টাকার বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে। গড়ে প্রতি বছরে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২৭৮৪ কোটি টাকা। এই মুহুর্তে বাংলায় যদি জনসংখ্যা আনুমানিক ১০ কোটি হয়, জনপ্রতি বিনিয়োগের পরিমাণ ২৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। সেখানে গুজরাটে দেখতে পাচ্ছি জনপ্রতি ২০১৯ সালেই বিদেশী বিনিয়োগ ঘটেছে ৩৮৩০ টাকা। অর্থাৎ দশ গুণেরও বেশী।
অমিতবাবু এও বলেছেন, বাংলায় ৫ টি বিজনেস সামিট থেকে ৪.৪৫ লক্ষ বিনিয়োগের প্রস্তাব ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু এই তথ্যের কোন সূত্র অমিত বাবু কোথাও দেন নি।
অমিত বাবু চা শিল্পের বর্তমান দুরবস্থার পরিস্থিতে আগামী দুবছরের জন্য আয়কর ছাড় ঘোষণা করেছেন। যেখানে কৃষিজ আয় ভারতবর্ষে এমনিতেই সম্পূর্ণভাবে করমুক্ত। পাঠক, আপনার মনে কি সন্দেহ জাগছেনা যে এটি সম্পূর্ণ একটি লোকদেখানো তিলকসেবার বেশী কিছুই নয়?
মাননীয় অমিতবাবু বলেছেন, ৮ বছরে ৩০ টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক গুলির অস্তিত্ব কেবল মাত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নোটিফিকেশন পিডিএফেই পাওয়া যায়।
মাননীয় অমিতবাবু বলেছেন, রাজ্যের ১.৫ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকদের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্য, ছেলেমেয়ের শিক্ষার বিষয়ে সরকার এককালীন কিছু টাকা শ্রমিকদের হাতে তুলে দেবে। এই প্রকল্পের জন্য এই বছরে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন যা ১.৫ কোটি পরিবারের জন্য পরিবার পিছু ৩৫ টাকারও কম।
অমিতবাবু, রাজ্যে ব্যবসার প্রসারের জন্য প্রতি বছর ১ লক্ষ সহজ সুদে ঋণদানের ব্যবস্থা করেছেন, এর জন্য বরাদ্দ করেছেন ৫০০ কোটি টাকা। মাথাপিছু ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু এই প্রকল্প কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা বর্তমানে মুদ্রা লোন যোজনা নামে চালু রয়েছে।
প্রায় ৩ লক্ষ চা শ্রমিকদের বাড়ি করে দেওয়ার জন্য অমিতবাবু ৫০০ কোটিটাকা বরাদ্দ করেছেন। যা মাথাপিছু ১৬৬৫০ টাকার কিছু বেশী। আমি জানিনা এই টাকায় কি বাড়ি বানানো সম্ভব।
কৃষকবন্ধু যোজনার দ্বারা মন্ত্রী মহাশয় যে একর পিছু ৫০০০ টাকা সাহায্যের কথা বলেছেন, তার বাস্তবও ধোঁয়াশা যুক্ত। কারণ অধিকাংশ কৃষকের জমি ১৫-২০ ডেসিমাল এর মধ্যে। ডেসিমেল প্রতি ৫০ টাকা সাহায্য মানে একজন কৃষক বছরে কুড়ি ডেসিমেল জমির জন্য ১০০০ টাকা বা ৩ টাকা ৩৩ পয়সা প্রতি রোজ সাহায্য পাবেন। এটি কৃষকদারিদ্র্যের প্রতি উপহাস এবং অবমাননা সূচক।
কৃষি এবং কৃষি বিপণনের জন্য বরাদ্দ ২০১৯ সালের বরাদ্দ ৬০৮৬ ও ৩৫৯ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২০২০ সালে যথাক্রমে ৫৮৬০.৫৭ ও ৩৫০ কোটি টাকা করা হয়েছে। (সূত্র বাজেট বিবৃতি, wbfin.nic.in)
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ও উদ্যানপালন বিভাগে বরাদ্দ গতবারের ১৯০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১৮৫ কোটি করা হয়েছে এই বছর। যেখানে শুধুমাত্র সঠিক পরিকাঠামোর অভাবে প্রচুর ফসল নষ্ট ও প্রচুর কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
প্রাণীসম্পদ বিভাগের জন্য গতবছরের বরাদ্দ গতবারের ১১১৫ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫৬৫.৫ কোটি টাকা করা হয়েছে, যা প্রায় অর্ধেক।
মৎস দপ্তরের গতবছরের বরাদ্দ ৪৫২ কোটি থেকে কমিয়ে ৩৪০ কোটি টাকা করেছেন অমিত বাবু।
সেচ ও জলপথ পরিবহণ বিভাগে গতবছরের বরাদ্দ ৩১৮৫ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২৮২০ কোটি টাকা হয়েছে। আশঙ্কা, এর ফলে অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি সংক্রান্ত সঙ্কটের মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে উঠবে রাজ্যবাসীর কাছে।
জলসম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়ন বিভাগের বরাদ্দ ১৩০৭ কোটি টাকা থেকে কমে গিয়ে হয়েছে ৯২৫ কোটি টাকা মাত্র।
সমবায় ও স্বনির্ভর গোষ্ঠী বিভাগ মূলত গ্রামীণ এলাকা জুড়ে জনভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার একটি মূল বুনিয়াদ রূপে কাজ করে থাকে। সহায়ক মূল্যে ফসল ক্রয়, তাঁত শিল্প, বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজের বন্টন বিপণন ইত্যাদিও করে থাকে এই গোষ্ঠী গুলি। এই বিভাগের বরাদ্দ ৪২৪ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ২৯৫ কোটি টাকা। এর সাথে বনবিভাগের বরাদ্দ ৮৫০ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে মাত্র ৪১৫ কোটি টাকা।
জনজাতির প্রগতি বা উন্নতির মূল বিষয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল স্বাস্থ্য। শ্রী মিত্র স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বরাদ্দ ৯৫৫৬ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৪৬০৮ টাকা করেছেন। অর্থাৎ মাথাপিছু ৪৬১ টাকা মাত্র।
স্বাস্থ্যের পরেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শিক্ষা, শ্রী মিত্র বিদ্যালয় শিক্ষা বিভাগে গতবছরের বরাদ্দ ২৭৫৪০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে মাত্র ৮৭৫০ কোটি টাকা, উচ্চশিক্ষায় ৩৯৬৪ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে মাত্র ৭০০ কোটি টাকা, কারিগরী শিক্ষায় ১১০৬ কোটির জায়গায় ৯০০ কোটি টাকা, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগে ৬৩১ কোটির জায়গায় ৫২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন।
পরিবহণ বিভাগের অবস্থাও করুণ, গত বাজেটের ১৬১৩ কোটির জায়গায় এইবছর দেওয়া হয়েছে ৯৮৫ কোটি টাকা। পি ডাব্লু ডিকে দেওয়া হয়েছে ৫৩৩৬ কোটির জায়গায় ৪৪০০ কোটি টাকা।
ভূমিসংস্কার দপ্তরের বরাদ্দ ১২৪২ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে মাত্র ২৭০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিভাগের বরাদ্দ ২৪৭৪ কোটি থেকে কমে হয়েছে ১৮৫৫.৫ কোটি টাকা। নগরোন্নয়ন দপ্তরে বরাদ্দ ১০৯৩০ কোটি থেকে কমে ৮৪৩০ কোটি, আবাসনে ১৩০০ কোটি থেকে কমিয়ে মাত্র ১৬৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
জনসংখ্যার অর্ধেক অংশীদারত্ব যাঁদের অর্থাৎ মহিলা এবং রাজ্যের আগামী সুনাগরিক অর্থাৎ শিশু বিকাশে রাজ্যের বরাদ্দ ৫৫২২ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৫৪৮৬ কোটি টাকা।
সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর ও অনগ্রসর শ্রেণী দপ্তরের বরাদ্দ ৪০১৬ কোটি, ৯৬৬ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৩৬০০ কোটি ও ৮০৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ বিভাগে বরাদ্দ ৯৫৯ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৪২৫ কোটি টাকা করা হয়েছে।
শিল্প বাণিজ্য ও শিল্পোদ্যোগ উন্নয়ন বিভাগে বরাদ্দ ১৩০৪ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১১৫৮.৪ কোটি টাকা করা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে এই বিপুল পরিমাণে টাকার বরাদ্দের ঘাটতি আমাদের রাজ্যের সাধারণ মানুষের ইতিমধ্যেই পিছিয়ে পড়া জীবনযাত্রার মানকে আরও পিছিয়ে দেবে কিনা। রাজ্যের ধারের পরিমাণ বেড়ে প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা হয়েছে। ডেট টু জিডিপি রেশিও ৩৫ শতাংশের ওপরে। যেখানে আসামের মত রাজ্যের ডেট টু জিডিপি রেশিও ২০ শতাংশের তলায়। এই রাজ্যে সর্বসমক্ষে প্রশ্ন তোলার মত সাহস আমার নেই, কারণ তাতে আমার জীবন ও জীবিকা দুইই সংশয়াপন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা, এবং এটি আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। এই লেখা জনসমক্ষে এলে জনগণ আশা করি বিচার করতে পারবেন যে অমিত মিত্র প্রশাসনিক এবং বৌদ্ধিক নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করে কিভাবে এই বাজেটকে সাফল্য হিসেবে দাবী করছেন ও ততোধিক চাটুকারিতার প্রমাণ রাখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত ছড়া দিয়ে বাজেট বক্তৃতা শেষ করে। যেখানে গতবছরের বাজেট বক্তৃতা শেষ করা হয়েছিল অতুলপ্রসাদ বিরচিত বিখ্যাত পংক্তি ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ দিয়ে। আমাদের রাজ্য যে শুধু প্রশাসনিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক ভাবে তলিয়ে যাচ্ছে তাই নয়… আমাদের সাহিত্যের অবনমনও ঘটছে একই সাথে।জনগণেশের হাতে এই ক্ষুদ্র বিশ্লেষণ অর্পণ করে আমি একটি মানসিক দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পেলাম।
নমস্কারান্তে,
নীরব কবি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)