করোনাভাইরাস ও জৈব মারণাস্ত্র : একটি পর্যালোচনা

‘নতুন করোনাভাইরাস কোন কৃত্রিম উপায়ে না, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে’ — এই কথা আমরা কোভিড-১৯ বৈশ্বিকমারী শুরুর প্রথম দিন থেকেই শুনে আসছি। বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় স্ক্রিপ্স রিসার্চ ইন্সটীটিউটের (The Scripps Research Institute বা সংক্ষেপে Scripps Research) বরাতে একই শিরোনামে একটি খবরও ছাপা হয়েছে।

স্ক্রিপ ইন্সটিটিউট একটি অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বৈজ্ঞানিক মহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেউ কেউ দাবি করেছিল উহানের ল্যাবরেটরিতে জেনেটিক কারিগরির মাধ্যমে এই ভাইরাস চিনই তৈরি করেছে। দুর্ঘটনা বশে বেরিয়ে গিয়ে এই মহা বিপদ ঘটেছে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে শুরু থেকেই এই মতৈক্য ছিল যে কোভিড-১৯ কোন ল্যাবরেটরিতে তৈরি ভাইরাস না।

তবে তথ্য হিসাবে জানানোর চেয়েও কথাটা বারবার প্রচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জৈব মারণাস্ত্র সংক্রান্ত তর্ককে আড়াল করা, ধামাচাপা দেওয়া। প্রকারান্তরে দাবি করা যে যেহেতু রসায়নাগারে তৈরি হয়নি, অতএব কোভিড-১৯ জৈব মারণাস্ত্র নয়। অথচ এটি জৈব মারণাস্ত্র কিনা কিম্বা কোন দেশ থেকে এই ভাইরাসের উদ্ভব ঘটেছে সেই তর্ক বিশেষ ভাবে চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে তীব্র ভাবেই চলছে। কোভিড-১৯ বিজ্ঞানাগারের তৈরি না কথাটার প্রচার এই গুরুত্বপূর্ণ তর্ককেও আড়াল করছে।

সকল পক্ষের কথাই শুনতে হবে। ল্যাবরেটরির বানানো ভাইরাস নয় বলে কোভিড-১৯ জৈব মারণাস্ত্র নয় বলা যায় না। কিম্বা কোন দেশ থেকে এর উদ্ভব ঘটেছে সেই তর্ক আড়াল করাও ঠিক নয়। কোভিড-১৯ জৈব মারণাস্ত্র হওয়া না হওয়ার সঙ্গে ল্যাবরেটরিতে বানানো বা না বানানোর কোন সম্বন্ধ নাই। ঠিক যে আধুনিক কালে সমরাস্ত্র গবেষণায় ল্যাবরেটরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আজ অবধি যে সকল জৈব মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রায় সবই প্রাকৃতিক। তাই আমদের উচিত মার্কিনী প্রপাগান্ডার প্রচারপত্র না হয়ে চিন এবং ইরানের বক্তব্যও পাশাপাশি প্রকাশ করা। পাঠক তার নিজের মতো বুঝে নিক কি হচ্ছে। অনুমাননির্ভর হয়ে বা গালগল্প দিয়ে আমরা আমাদের জনগণকে রক্ষা করতে পারব না। এই ধারণা ঠিক না যে এটম বোমার মতো জৈব মারণাস্ত্রও শুধু ল্যাবরেটরিতেই বানানো হয়।

অনেকে কেন জৈব মারণাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে চান না, সেটা বুঝি। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আমি একমত নই। তাঁরা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে ঘটনাঘটনের ব্যাখ্যা করতে চান না, তাঁদের এই উৎকন্ঠার সঙ্গে আমরা একমত। জটিল বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে কিম্বা বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্য জনিত সস্তা অনুমানের কারনে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ পয়দা হয়।

কিন্তু অন্যদিক থেকে ভেবে দেখুন। জৈব মারণাস্ত্র নিয়ে নিরপেক্ষ আলোচনা পর্যালোচনার অনুপস্থিতিও চরম অজ্ঞতা তৈরি করতে পারে। এর ক্ষতি বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্যের চেয়েও শতগুণ বেশী ক্ষতিকর এবং বিপজ্জনক। তাই মনে রাখতে হবে এই পর্যন্ত ইতিহাসে আমরা যেসব জৈব মারণাস্ত্রের ব্যবহার দেখেছি তার অধিকাংশই প্রাকৃতিক। ল্যাবরেটরির পয়দা নয়। একটি খবর পাঠ করে কেউ যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে যেহেতু ল্যারেটরিতে তৈরি হয়নি অতএব কোভিড-১৯ জৈব মারণাস্ত্র না — তারা মহা ভুল করবেন। তথ্যটি জৈব মারণাস্ত্র সম্পর্ক অজ্ঞ ও অসচেতন থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল।

প্রাচীন কালের যুদ্ধের কথাই ধরুন। প্লেগ আক্রান্ত রোগীকে যুদ্ধে কূপে ফেলে প্রতিপক্ষকে বিষাক্ত জল খাইয়ে প্লেগ আক্রান্ত করা ও পরাজিত করার নজির আছে। প্রাচীন ইতিহাসে দেখা যায় সেটা ঘটেছে। এই ক্ষেত্রে প্লেগ আক্রান্ত লাশ জৈব মারণাস্ত্রের ভূমিকা পালন করেছে। সম্রাট বারবারোসা খ্রিস্টীয় ১১৫৫ সালে এই প্রকার জৈব মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। ১৩৪৬ সালে মোঙ্গলরাও প্লেগ আক্রান্ত শরীর দিয়ে প্রতিপক্ষের মধ্যে প্লেগ ছড়িয়ে পরাজিত করতে চেয়েছিল। স্পেনীয়রা তাদের শত্রু ফরাসিদের বিরুদ্ধে রক্তের সঙ্গে কুষ্ঠ রোগীর রক্ত মিশিয়ে তাদের কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত করতে চেয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সৈন্যরাও চিনা গ্রামগুলোতে কম পক্ষে এক হাজার কূপ দূষিত করেছে। তারা দেখতে চেয়েছিল কিভাবে কলেরা ও টাইফাস ছড়ায়।

(চিন্তা ডট অর্গ থেকে সংগৃহীত, সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত। মূল লেখা ফরহাদ মাজহার)

সম্পাদনা – শ্রী কৌশিক পাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.