দত্তোপন্থ ঠেংড়ীর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে কিছু কথা

কে এই রাষ্ট্রঋষি?

রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ বাপুরাও ঠেংড়ী একজন হিন্দু-ভাববাদী দার্শনিক ও চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব। বহু প্রতিভার অধিকারী এই যুগদ্রষ্টা, তপস্বী মানুষটি ভারতের শ্রেষ্ঠ মজদুর ও কৃষক নেতা/কার্যকর্তা; এই বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ শুরু হয়েছে। তিনি চিন্তার খোরাক যুগিয়ে, রাষ্ট্রের কাজে নিয়োজিত হয়ে সমকালের গণ্ডি বহুদূর পেরিয়ে এসেছেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র সংগঠন যথাক্রমে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ, ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ এবং অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মৌলিক চিন্তার অনবদ্য প্রকাশ যে গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে তা হল ‘Third Way’, বইটির পরতে পরতে তাঁর ভারতবিকাশ ভাবনা আমাদের ঋদ্ধ করেছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে স্থিতপ্রজ্ঞা যুক্ত না হলে মানবসভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য। তারই প্রয়াসে ব্রতী হয়েছিলেন ঠেংড়ীজী। ভারতীয় দর্শন বিশ্বের দরবারে প্রচার করতে তিনি ৩৩ টি দেশে দীর্ঘ প্রবাস-যাপন করেছিলেন। এই অনন্য প্রতিভার অধিকারী রাষ্ট্র-ঋষির জন্মশতবর্ষ ভারত জুড়ে পালিত হচ্ছে।

রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়ীজীর সাংগঠনিক প্রতিভা

বহু প্রতিভার অধিকারী দত্তপন্থ ঠেংড়ীজীকে কেবল তাঁর সঙ্গেই তুলনা করা যায়। একজন মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় এত সংগঠনের প্রাণ-পুরুষ ছিলেন, তা না জানলে তাঁর অবদান আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাবে। তাঁর উদ্যোগে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (BMS) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালের ২৩ জুলাই ভোপালে এবং ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ (BKS) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ৪ মার্চ রাজস্থানের কোটা শহরে। এ ছাড়াও তিনি ১৯৮৩ সালের ১৪ এপ্রিল সামাজিক সমরসতা মঞ্চ, ১৯৯১ সালের ১৪ এপ্রিল মুম্বাই নগরে সর্বপন্থ সমাদর মঞ্চ এবং ১৯৯১ সালের ২২নভেম্বর নাগপুর শহরে স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের সংস্থাপনা করেন। পর্যাবরণ মঞ্চও তাঁরই প্রতিষ্ঠা। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা জীবনের প্রারম্ভ থেকেই লক্ষ্য করা যায়। ১৯৩৫ সালে তিনি জন্মস্থান আর্বি (ওয়ার্ধা জেলা, মহারাষ্ট্র) তালুকা-র বানর সেনা কমিটির অধ্যক্ষ হন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫ বছর। ১৯৩৫-৩৬ সালে আর্নী বিদ্যার্থী সঙ্ঘের মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল কমিটির অধ্যক্ষ হন। ঐ সময়েই তিনি মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলে গরিব ছাত্র ফান্ড সমিতির সচিব মনোনীত হন। ১৯৩৬ সালে তিনি আর্বী গোবারী ঝুগী ঝুপড়ী মণ্ডলের সংগঠক ছিলেন। এরপর নাগপুরে ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে হিন্দুস্তান সমাজবাদী রিপাবলিকান সেনার প্রোবেশনার হন। ১৯৪২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬২ বছর তিনি ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক। অখিল ভারতীয় অধিবক্তা পরিষদের এবং ভারতীয় বিচার কেন্দ্রমের (১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা)-ও তিনি ছিলেন মার্গদর্শক ও উদঘাটন কর্তা। তিনি অন্তত ১৭ টি সংগঠনের সংস্থাপক সদস্য ছিলেন। এরমধ্যে অন্যতম হল অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (প্রতিষ্ঠা ১৯৪৯ সালের ১৯ জুলাই), সহকার ভারতী, অখিল ভারতীয় গ্রাহক পঞ্চায়েত, ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল প্রভৃতি। বনবাসী কল্যাণ আশ্রম সহ ৭ টি সংগঠনে তিনি সহায়ক সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন অপর দুটি শ্রম-সংগঠনে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাঁর সফল পদচারণা। নানান সময়ে তিনি ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রদেশ সংগঠন মন্ত্রী হিসাবে কাজ করেছেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন, ছিলেন রাজ্যসভা উপাধ্যক্ষ মণ্ডলের সদস্যও। জনতা পার্টি গঠনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা চোখে পড়ে। অন্য নানান সংগঠনেরও তিনি সদস্য ছিলেন, যেমন — প্রজ্ঞাপ্রবাহ, বিজ্ঞান ভারতী, আরোগ্য ভারতী, বনবাসী কল্যাণ পরিষদ, ভারতীয় সাহিত্য পরিষদ, ভারতীয় বুদ্ধ মহাসভা প্রভৃতি।

রাষ্ট্রঋষির সংক্ষিপ্ত জীবনী ও কর্ম

দত্তপন্থের জন্ম ১৯২০ সালের ১০ ই নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা জেলার আর্বি গ্রামে। তাঁর পিতা শ্রীবাপুরাও দাজীবা ঠেংড়ী, মাতা জানকী দেবী। ১৯৩৬ সালে তিনি বাপুরাও পালধীকরজীর দ্বারা স্বয়ংসেবক হন এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক শ্রী মাধবরাও সদাশিবরাও গোলওয়ালকরের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। ১৯৪২ সালে সঙ্ঘের প্রচারক হিসাবে কেরলে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮-৪৯ সালে বাংলার প্রান্ত প্রচারক হিসাবে কাজ করেন। কর্মজীবনে বাবা সাহেব আম্বেদকর এবং পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ও তাঁর উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পূর্ণকালীন প্রচারক ছিলেন। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি ছিলেন কলা ও আইন বিষয়ে স্নাতক। তিনি ছিলেন ব্যাপক ভ্রমণশীল ব্যক্তি; সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে দেশের প্রায় সকল জেলা শহর এমনকি বহু তালুক ও গ্রাম ভ্রমণ করেন এবং নিবাসী-প্রবাস যাপন করেন। সাংসদ প্রতিনিধিরূপে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং হাঙ্গেরি (১৯৬৯) ভ্রমণ করেছিলেন; ১৯৭৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক Anti-Apartheid Conference-এ অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন ও যুগোস্লাভিয়া থেকে আমন্ত্রিত হয়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের উপর উদার অর্থনীতির প্রভাব সংক্রান্ত অনুধ্যান করেন। অসাধারণ বাগ্মিতার সুবাদে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি চীন, জাকার্তা, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কেনিয়া, উগান্ডা ও তাঞ্জানিয়ায় ভ্রমণ করেন। এছাড়া মিশর, মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, জার্মানী, লুক্সেমবার্গ, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল,ইজরায়েল, ফিজি, ত্রিনিদাদ, ওয়েস্ট ইন্ডিজও ভ্রমণ করেছেন। তিনি অসংখ্য পুস্তকের রচয়িতা, তাতে কেবল ভাবাদর্শ স্থান পেয়েছে তা নয়, তাতে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর অজস্র অভিজ্ঞতার উজ্জ্বল উদ্ধার। তাঁর বিখ্যাত বইগুলির মধ্যে ‘পার্সপেক্টিভ’, ‘থার্ড ওয়ে’, ‘ফোকাস অন সোশ্যাল ইকোনমিক প্রবলেম’, ‘কম্পিউটারাইজেশন’, ‘হোয়াই ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ’, ‘রাষ্ট্রীয় পুনর্নির্মাণ কা আধার’, ‘ধ্যেয় পথ পর কিসান’, ‘ভারতীয় কিসান’, ‘জাগৃত কিসান’, ‘অপনি রাষ্ট্রীয়তা’, ‘লোকতন্ত্র’, ‘রাষ্ট্রীয় পুরুষ ছত্রপতি শিবাজী’, ‘সঙ্কেত রেখা’, ‘কার্যকর্তা’ প্রভৃতি অন্যতম।

ঠেংড়ীজী ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা

ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা, পরিচিতি ও প্রচারে তাঁর অনবদ্য ভূমিকা; গ্রাম সংসদকে সমৃদ্ধ করে সমৃদ্ধশালী ও কুশলী রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখানোর তিনি অন্যতম কারিগর। তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে ও যোগ্য উত্তরসূরী নির্মাণের প্রেক্ষিতেই ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ কৃষক সংগঠনের অবয়ব লাভ করেছে। ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ একটি নিবন্ধীকৃত সংস্থা। এর সদস্যতা তিন বছরের জন্য বৈধ এবং কার্যকরী সমিতি গ্রামস্তর থেকে শুরু করে জাতীয় স্তর পর্যন্ত তিন বছরের জন্য বলবৎ থাকে। এখানে ‘কৃষি’ শব্দটির পরিধি বৃহৎ, তাতে ভৌম-কৃষি বা মাঠের ফসল, গো-পালন, উদ্যান পালন, রেশম চাষ, মৎস্য চাষ, বনসৃজন ছাড়াও কৃষি পণ্যের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবসা ও বাণিজ্যও তাতে সংযুক্ত। আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত অবস্থার উন্নতির জন্য কৃষকদের একত্রিত ও সংগঠিত করা এই সংগঠনের উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য কৃষি-শিল্পের সক্রিয়তা বৃদ্ধি করে উন্নয়নের স্থায়ীপথ খুলে দেওয়া। সনাতনী ও পুরাতনী কৃষি-কলাকৌশল ও পদ্ধতিগুলিকে গুরুত্ব আরোপ করে তারসঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে পরিবেশ নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। কৃষকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও হৃদ্যতা বাড়ানো। এই সংগঠনের তিন প্রকারের কাজ — সংগঠনাত্মক, আন্দোলনাত্মক এবং রচনাত্মক। জৈবিক গ্রাম নির্মাণ এবং গো-আধারিত কৃষি রচনাত্মক কাজের অন্তর্ভুক্ত। সারা ভারতবর্ষের নানান প্রান্তের সঙ্গে ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের পশ্চিমবঙ্গ প্রান্তও রাজ্যস্তর থেকে শুরু করে জেলা, ব্লক ও গ্রাম স্তরে ঠেংড়ীজীর জন্মশতবর্ষ উদযাপনে মনস্থ হয়েছে; নানান পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে — প্রতিটি জেলা ও রাজ্যে একটি করে বৃহত্তম মনোজ্ঞ আলোচনা সভা, বাংলাভাষায় ঠেংড়ীজীর কর্ম ও জীবনদর্শন সংক্রান্ত পুস্তক প্রকাশ; প্রতিটি জেলায় কৃষি বিশেষজ্ঞকে আহ্বান করে ‘Dattapanth Thengedi Memorial Lecture’ প্রদান করে কৃষিজীবী মানুষকে আধুনিক প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে অবহিত করা এবং রাজ্যের দু’একটি জেলায় ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের জেলা-করণের নাম ঠেংড়ীজীর নামে অভিহিতকরণ ইত্যাদি। এ রাজ্যে বর্ষব্যাপী নানান কার্যক্রম রূপায়ণ করে তাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.