সেই ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি— ‘সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার’। গঙ্গাসাগর একবার কেন? কেননা খুব দুর্গম। সাগর পেরিয়ে সে তীর্থে যেতে হয়। স্কুলের শেষসীমায় পৌঁছে যখন রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ বা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’র নবকুমারের কাহিনি পড়েছি, তখন কেমন যেন গঙ্গাসাগর নিয়ে একটা সমীহ ভাব। ওই বয়েসে তীর্থ মাহাত্ম্যের থেকে তীর্থে পৌঁছোনোটাই বড়ো কথা। একটু বড়ো হয়ে সেই ভয়মিশ্রিত ভক্তি আর থাকেনি। যত দিন গড়িয়েছে, যাতায়াতের সুবিধাও অনেক বেড়েছে। মেলার সময় বার দুয়েক গিয়েছি, অন্য সময়ে বেশ কয়েকবার। মেলার সময়কার কথাটাই বলি। কাকদ্বীপ হয়েও গঙ্গাসাগর যাওয়া যায়, আবার নামখানা দিয়েও যাওয়া যায়। দু’বার দুদিক দিয়েই গিয়েছি। তবে ভিড় দুদিকেই। একবার বাসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এরকম— ডায়মন্ডহারবার থেকে বাসে উঠেছি। প্রচণ্ড ভিড়, দাঁড়ানো যায় না। এর মধ্যে বাস কন্ডাকটার বেশি ভাড়া চাইছে। মেলার জন্য যে বাসে বেশি ভাড়া দিতে হবে, বেশিরভাগ যাত্রীই তা জানে না। তাই নিয়েই বচসা শুরু হয়েছে। উপায়ন্তর না দেখে বোধহয় বাস একটা পুলিশ চৌকির সামনে এসে থামল। দু’জন পুলিশ এসে কয়েকজন যাত্রীকে ধরে নিয়ে গেল। তাদের মধ্যে আমিও আছি। তা কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ চলল। প্রেস কার্ডটা দেখাতে অবশ্য ছেড়ে দিল। এমন হ্যাপা পেরিয়ে যখন নামখানায় পৌঁছালাম, তখন লঞ্চের জন্য দীর্ঘ লাইন। শীতকাল। রাত প্রায় ৯টা। শেষমেশ যখন সাগরে পৌঁছলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা এগারোটার আশেপাশে। তবে আলোর অভাব নেই—ফ্লাডলাইটের আলোয় ঝলমল করছে। সারি সারি চট দিয়ে ঘেরা ছাউনি। নীচে খড় পাতা। তীর্থযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা। তবে পয়সা ফেললে হোটেলও আছে। হাল আমলের কথা বলতে পারব না, বছর পনেরো-কুড়ি আগে হোটেলের সংখ্যাও বেশি ছিল না। আমি অবশ্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ডেরাতেই মাথা গুঁজলাম। তা, ওই রাতেই অরবিন্দদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি তার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন। ভোরবেলা একসঙ্গেই সাগর-স্নানে যাওয়া স্থির হলো। একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, অত রাতেও তীর্থযাত্রীদের আসার বিরাম নাই। বেশির ভাগই বয়স্ক। পাঁচ-ছয়জনের এক একটা গ্রুপ। সঙ্গে ব্যাগপত্তর, পোঁটলা। সে বছর কুম্ভমেলা ছিল না।তাই ভিন রাজ্যের মানুষরাও এসেছেন, বিশেষত উত্তর ভারত থেকে। তারা দলবেঁধে এক একটা ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছেন।

রাতের অন্ধকারটা সবে ফিকে হতে শুরু করেছে। তখন থেকেই কানে আসছে—হর হর গঙ্গে, গঙ্গা মাঈ কী, কপিল বাবা কী…। বাংলার এই একটাই তীর্থক্ষেত্র যেখানে একটা বিশেষ তিথিতে হলেও ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের মানুষ পুণ্য স্নানের জন্য এসে উপস্থিত হন। কতকাল আগে থেকে পুণ্যার্থীরা যে এখানে আসছেন তা জানি না, তবে যে ঘটনাকে স্মরণ করে তাঁরা আসছেন, তা অতি প্রাচীন। মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজা সগর। তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের সংকল্প করেন। সেই যুগের নিয়ম অনুসারে একটি অশ্বকে যজ্ঞের জন্য উৎসর্গীকৃত হিসেবে চিহ্নিত করে ছেড়ে দেওয়া হতো। কেউ সেই অশ্বের গতি রোধ করলে তাকে যুদ্ধে পরাজিত বা হত্যা করে অশ্বকে যজ্ঞস্থলে ফিরিয়ে পূর্ণাহুতি দেওয়া হতো। যুদ্ধে জয়ী রাজা রাজচক্রবর্তী বা সম্রাট হিসাবে যশস্বী হতেন। সিংহাসন চ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় স্বর্গের রাজা ইন্দ্র সেই অশ্বকে কপিল মুনির আশ্রমে বেঁধে রেখে আসেন। সেই অশ্বের সন্ধানে রাজা সগর সৈন্যসামন্ত-সহ পুত্র-পৌত্রদের পাঠিয়েছিলেন। সংখ্যাটা নাকি যাট হাজার। কপিলমুনির আশ্রমে সেই অশ্বের সন্ধান পেয়ে সগরের পুত্র-পৌত্ররা মুনিকেই অপহরণকারী হিসেবে তিরস্কার করতে থাকেন। তপস্যায় বাধা সৃষ্টির জন্য ক্ষুব্ধ মুনির দৃষ্টিপাত মাত্র সগরের পুত্র-পৌত্ররা ভস্ম হয়ে যান। যজ্ঞ থেকে যায় অসম্পূর্ণ। সগরের উত্তরপুরুষ ভগীরথ তপস্যা করে গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নিয়ে আসেন। গঙ্গা যেখানে সাগরে মিলিত হয়েছেন, সেখানেই কপিল মুনির আশ্রম। গঙ্গার পবিত্র স্পর্শে ভগীরথের পূর্বপুরুষেরা পৌষ মাসের মকর সংক্রান্তি তিথিতে এই পবিত্র সঙ্গমে মুক্তি পেয়েছিলেন বলে নিজেদের মুক্তি কামনায় প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী গঙ্গাসাগরে সমবেত হন। এবারে আমরাও যেমন এসেছি। এভাবে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থীদের সমাগমে সাগর সঙ্গম এ সময় হয়ে ওঠে এক ক্ষুদ্র ভারত, পুণ্য ভারত।

আদি কপিলমুনি মন্দির সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। বর্তমান মন্দিরটি নবনির্মিত। তিনটি চূড়াবিশিষ্ট এই মন্দিরে রয়েছে সাধক তপস্বী কপিলমুনির বিগ্রহ। বেদের উপনিষদ ভাগে কপিলের নাম পাওয়া যায়। ঋষি কর্দম ও দেবহুতির পুত্র কপিল সিদ্ধপুরুষ। গীতার দশম অধ্যায়েও শ্রীভগবান বলেছেন, সিদ্ধপুরুষদের মধ্যে তিনি হলেন কপিল— ‘সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ। সাংখ্যদর্শনের তিনি প্রণেতা।

কপিলমুনির প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল। কর্মসূত্রে তখন আরামবাগে রয়েছি। এক বন্ধুর বাবা তখন আরামবাগ কলেজের দর্শনের অধ্যাপক। একদিন তাদের বাড়িতে যেতে বন্ধুর বাবা হাসতে হাসতে বললেন, আজ কী পড়াবো জানো বিজয়? আমি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে তিনি বললেন, ‘প্রমাণা ভাবাৎ ঈশ্বর নাস্তি’— প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর নেই। আর কথাটা বলেই তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, যিনি বলেছেন ঈশ্বর নেই, তাকেই ঈশ্বর বানিয়ে লক্ষ লক্ষ লোক এখন পূজা করছে। বুঝলে, এটা ভারতবর্ষ। এখানকার মানুষ সর্বভূতে ঈশ্বর দেখে। এখানে তোমার কমিউনিজম চলবে? তা গঙ্গাসাগর মেলায় এসে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল।

গঙ্গাসাগরের জল গঙ্গার মতোই অনেকটা ঘোলাটে। সমুদ্রের নীলবর্ণ সেখানে নেই। ঢেউও পুরী বা দীঘার মতো অতটা উত্তাল নয়। তা উত্তাল না হলে কী হবে। আমরা একাত্মতা যজ্ঞের রথযাত্রার সময় এই এখানে দাঁড়িয়েই একসঙ্গে গেয়েছিলাম— ‘উত্তাল তরঙ্গ বেষ্টিত বক্ষে দক্ষিণে জলধি নাহি ভয়…’। সেই ১৯৮৩ সালে গঙ্গাবারি নিয়ে। সারাদেশে যে জাগরণ দেখা গিয়েছিল, তা আজও অনেকের স্মরণে আছে। তারই একটি রথযাত্রার সূচনা হয়েছিল এই গঙ্গাসাগরে। সেই যাত্রার সূচনা পর্বের দায়িত্ব ছিল আমাদের কয়েকজন বন্ধুর ঘাড়ে।

সেই কাকভোর থেকেই স্নানের জন্য সমুদ্রে মানুষের ঢল নেমেছে। তবে এখন ভাটার টান। অনেকটা হেঁটে যেতে হচ্ছে। শীত যে কাউকে কাবু করতে পারেনি, তা তাদের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সবার মুখেই এক তৃপ্তির ছোঁয়া। আগে শুনেছি, এখন দেখলাম বাছুরের লেজ ধরে বৈতরণী পার হওয়ার দৃশ্য। দেখলাম সাধুদের ছাউনি। সারিবদ্ধ ছোটো ছোটো কুঠরি। তার এক একটিতে কয়েকজন সাধু। অনেকের গায়ে ভস্ম মাখা। পরনে সামান্য একটা কৌপীন, কারও বা তাও নেই। কেউ প্রসাদ চাইলে চিমটি দিয়ে একটা অঙ্গারের টুকরো তুলে দিচ্ছেন। ঈদানীং এঁদের সংখ্যা বাড়াতে নানা সংস্থার পক্ষ থেকে কলকাতার বাবুঘাটের কাছে অস্থায়ী শিবির করা হচ্ছে। গঙ্গাসাগর যাত্রীদের বিশেষত সাধু-সন্তদের কষ্ট যাতে লাঘব হয়, সেইজন্যই এই ব্যবস্থা। স্থানীয় প্রশাসনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

স্বামীজী এই দেশের নার্ভটা ঠিকই বুঝেছিলেন। যতই স্মার্ট সিটি, ডিজিটাল ইন্ডিয়া হোক না কেন, এদেশে মা-কালী পাঁঠা খাবেন, কৃষ্ণ বাঁশী বাজাবেন আর যাঁড়ে চেপে শিব ডমরু বাজাবেন। সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষে এই জীবন প্রবাহ নিরন্তর চলে আসছে। এই যে জীবন প্রবাহ, যা শুধু সর্বজীবে নয়, সর্বভূতে ঈশ্বর দর্শন করে। এদেশের মানুষ যাকে ধর্ম বলে, যা এই জাতির নিজস্ব সত্তা—তা কখনও বিসর্জন দেয়নি। সাগরসঙ্গমেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সংবিধানের ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’-এর ভারত রূপটিই এই মেলায় মূর্ত হয়ে উঠে।

বিজয় আঢ্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.