সম্প্রতি সাহসিনী এই আমলাকে নিয়ে বলিউডে বায়োপিক তৈরি হতে চলেছে – সম্ভবত তিনিই হবেন দেশের প্রথম আমলা, জীবিত অবস্থাতেই যাকে নিয়ে চলচ্চিত্রায়ন হবে

নারীশক্তি …… 🏵️🏵️

ছোট্ট মেয়েটা তখন প্রাইমারি সেকশনে পড়ে। একদিন স্কুলে এলেন ইন্সপেক্টর। ঘুরতে ঘুরতে ওর ক্লাসে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলেন, বড় হয়ে কি হতে চাও ? প্রায় সবাই যখন জবাব দিচ্ছে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সায়েন্টিস্ট, তখনই রিনরিনে গলায় মেয়েটি জবাব দিলো আমি সরকারি অফিসার হতে চাই ! বিস্মিত পরিদর্শক খোঁজ নিয়ে জানলেন মেয়েটি এসেছে এমন এক পরিবার থেকে যেখানে রয়েছে সরকারি চাকরি করার সম্মানীয় ঐতিহ্য। ঠাকুরদা ছিলেন ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার, ১৯৫৪ সালে দিল্লির এক দাঙ্গায় নিহত হন। বাবা দিল্লি প্রশাসনে অভূতপূর্ব ভুমিকায পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পদক।

বাবা মায়ের এক সন্তান মেয়েটি পড়াশোনায় ছিল অত্যন্ত মেধাবী, রাজধানীর এক প্রখ্যাত কলেজ থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক হয়ে বেরুলো একদিন। ক্যামপাস থেকে ভালো চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকলো স্বপ্নপূরণে। প্রথম সুযোগেই পাশ করলো IRS, কিন্তু কন্যার নাপসন্দ। পরের বছর আবার বসলো UPSC পরীক্ষায় আর এবার পাশ করে বেরুলো IAS. মেরিট অনুসারে সারাদেশের মধ্যে তাঁর স্থান ছিল কুড়ি নম্বরে! বয়স তখন মাত্র চব্বিশ।

২০১০- ব্যাচের পাঞ্জাব ক্যাডারের এই অফিসার মোহালি জেলা প্রশাসনে চোদ্দ মাসের প্রশিক্ষণ নিলেন আর সেখানেই তার নজরে এলো জমি মাফিয়াদের কার্যকলাপ। তবে সেদিন স্বপ্নেও ভাবেননি একদিন তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে এই মাফিয়াদেরই আর সেই কাহিনী ছড়িয়ে পড়বে দেশের কোনায় কোনায়, অনুপ্রাণিত করবে আগামী প্রজন্মকে!

সন ২০১২, উত্তরপ্রদেশ সরকার তাঁকে গৌতম বুদ্ধ নগরের মহকুমা শাসক রূপে নিয়োগ করলো। ইতিমধ্যে তিনি বিয়ে করেছেন ব্যাচমেট অভিষেক সিং কে, যিনি তখন মথুরার একজন অতিরিক্ত জেলাশাসক।
চাকরির ঠিক দুমাসের মাথায় ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। সকাল দশটা নাগাদ বাংলো থেকে বেরিয়ে অফিস যাবার সময় দেখেন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একদল মানুষ। তারা ম্যাডামের সাথে দেখা করতে চায় কিন্তু বাদ সেধেছে গেটের সশস্ত্র প্রহরী। নেমে এলেন গাড়ি থেকে আর যে কাহিনী শুনলেন তাতে তার সামনে খুলে গেল রাজ্যের নেতা পুলিশ ও মাফিয়াদের এক অশুভ আঁতাতের ইতিহাস।

নয়ডা এলাকায় যমুনা নদীর বন্যা হয়ে যাবার পরে তীরের উর্বর জমিতে দীর্ঘদিন ধরে চাষ করে আসছে এলাকার কৃষিজীবী মানুষ। সম্প্রতি সেখানে নজর পড়েছে বালি মাফিয়াদের। জেসিবি মেশিন চালিয়ে রোজ নদীতীর থেকে তুলে নিচ্ছে টনটন বালি। অবৈধভাবে এই খননের ফলে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে চাষের জমি অন্যদিকে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙ্গন। থানা বা সরকারি অফিসে অভিযোগ জানিয়ে কোন লাভ হয়নি, কেননা এদের হাত অনেক লম্বা। নিরুপায় চাষীরা তাই আজ SDO ম্যাডামের দ্বারস্থ !

হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি ম্যাডাম, অফিসে গিয়েই ডেকে পাঠালেন থানার বড়বাবু থেকে অধস্তন অফিসারদের। প্রথমে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেও তাঁর অনমনীয় জেদের কাছে হার মানলো সবাই। টাস্ক ফোর্স তৈরি করে রোজ মাঝরাতে হানা দিতে লাগলেন যমুনা পাড়ে। বাজেয়াপ্ত করলেন শয়ে শয়ে বালিবোঝাই ট্রাক, জেসিবি মেশিন। দিনের বেলা নদীর ধারের গ্রাম গুলিতে গিয়ে আবেদন করতেন অবৈধ খননের খবর তাঁকে জানানোর জন্য।

কাজ হয়েছিল তাঁর এই সাহসী পদক্ষেপে। মাত্র দুসপ্তাহের মধ্যে প্রায় নব্বই জনা বালি মাফিয়া গ্রেফতার হয়, ফাইন বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে দেড়শো কোটি টাকা! প্রথমে অনুনয় বিনয় পরে রাজ্যের শাসক পার্টির নেতারা একাজ বন্ধ করার আদেশ দেন। তাতেও যখন কাজ হলোনা তখন তিন তিনবার তাঁর ওপরে প্রাণঘাতী হামলা হয়। রাজপথে নম্বর বিহীন এক ভারী ট্রাক ধাক্কা মারে তাঁর গাড়িতে। ঈশ্বরও সহায় ছিলেন তাই সেযাত্রা কোনক্রমে প্রাণে বাঁচলেন তবে শেষরক্ষা হলো না।

জুলাই ২০১৩, অফিসে বসেই খবর পেলেন গ্রেটার নয়ডার এক গ্রামে সরকারি জমিতে এক মসজিদে পাঁচিল দেয়া হচ্ছে। দফতরের লোক পাঠিয়ে নিষেধ করলেন তাদের। তারা অবশ্য শোনেনি কারণ স্থানীয় বিধায়কের মদত ছিল। পরদিন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভেঙে দেন ঐ পাঁচিল , আর তখনই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পেয়ে যায় শাসক দল, সংখ্যালঘু নির্যাতনের দোহাই দিয়ে সাসপেন্ড করা হলো তাঁকে। কেড়ে নেয়া হলো দেহরক্ষী থেকে সবরকম সুযোগ সুবিধা।

টেলিফোনে রোজ হুমকি শোনা থেকে তাঁর বাংলোর সামনে বিক্ষোভ গালিগালাজ তখন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু সাসপেন্ড হবার ঘটনা মিডিয়া প্রকাশ্যে আনতেই দেশজুড়ে IAS অফিসারদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিলো। পাশে দাঁড়ালো National Green tribunal. ঘরে বাইরে প্রবল চাপের মুখে মুখ্যমন্ত্রী মাত্র দেড় মাসের মধ্যে সাসপেনসন উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কানপুরে মহাকুমা শাসক রূপে পুনর্বহাল করা হয় তাঁকে। তবে পুরানো চেয়ারে না বসতে পারলেও ঐ এলাকার নেতা পুলিশ মাফিয়াদের চক্র তিনি চিরস্থায়ী ভাবে ভেঙে দিতে পেরেছিলেন। পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে যায় বালির অবৈধ খনন। প্রসঙ্গত এক বছরের মাথায় তাঁর স্বামী অভিষেক সিংকেও এক দলিত শিক্ষক কে নিগৃহীত করার অভিযোগে সাসপেন্ড করে উত্তর প্রদেশ সরকার।

সম্প্রতি সাহসিনী এই আমলাকে নিয়ে বলিউডে বায়োপিক তৈরি হতে চলেছে। সম্ভবত তিনিই হবেন দেশের প্রথম আমলা, জীবিত অবস্থাতেই যাকে নিয়ে চলচ্চিত্রায়ন হবে।
আমাদের বাংলায় দুর্নীতি গ্রস্ত নেতা – মন্ত্রী – পুলিশ আছে, আছে কয়লা ও বালি মাফিয়া। কিন্তু আফশোষ #দূর্গাশক্তি_নাগপাল এর মতো শক্ত মেরুদন্ডের আমলা একজনও নেই ! স্যালুট ম্যাডাম ‌🌹
কলমে ✍🏻 স্বপন সেন 🌲

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.