রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা পরম পূজনীয় আদ্য সরসঙ্ঘচালক কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার জনা বারো জন শিশু, বালক, যুবক,ও তরুণদের একত্রিত করে দেশপ্রেমের মাতৃ মন্ত্রে দীক্ষিত করে ১৯২৫ সালে যে চারাগাছের বীজ রোপণ করেছিলেন তা আজ দেখতে দেখতে বিশাল এক বট বৃক্ষের মহীরুহ তে পরিণত হয়েছে।
যখনেই দেশে ঘোর সংকটের অন্ধকারময় কালো ছায়া দেখা দিয়েছে, তখনেই বটবৃক্ষের মতন তার শাখা-প্রশাখায় আগলে রেখেছে দেশের মানুষকে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা প্রেম,বন্ধুভাব ও নম্রতার সহিত সমাজের সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে একত্রিত করে সমাজ জীবনের ঊর্ধগামী পরিবর্তন গড়ায় নিজের অবদান রেখে চলেছে আজও।
সঙ্ঘ শুধু নিত্য শাখায় শারীরিক অনুশীলনের মাধ্যেমে নিজের পরিধি বেঁধে রাখে নি, নিত্য শাখার জাঁতাকলে নির্মল চরিত্র,সেবা মনোভাবাপন্ন,ও দেশের প্রতি কর্তব্যরত এক সুস্থ্য-সবল চরিত্রের ব্যক্তি নির্মাণ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।যাদের কে দেশের যে কোন বিপদে নিমন্ত্রণ জানিয়ে আহ্বান দিতে হয় না,
“দুর্গম পথে দুর্যোগ রাতে আমাদের অভিযান/আমরা মায়ের দুর্জয় সেনা নির্ভীক কোটি প্রাণ”।
এই মনে করে,যখনেই বিপদের এতটুকু আঁচ এসেছে দেশের ওপর তখনই কর্তব্যরত অবস্থায় সিংহ বিক্রমের দুর্জয় শক্তি নিয়ে স্বয়ংসেবকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সেই ঘোর অন্ধকার সংকটে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়,বন্যা, ভূমিকম্প, সমাজসেবা থেকে শুধু সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা বিরত থাকেন নি। স্বামী বিবেকানন্দ ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যেও তাদের অবদান রেখে গেছে।
দেশভাগের সময় অসহায় মানুষের রক্ষায় ১৯৪৭ সালে ভারতমাতার অঙ্গচ্ছেদ করে, ভারত ভেঙে যখন পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল।সরকারীর সাহায্যে মুসলীম লীগ হিন্দু সংহার শুরু করেছিল পাঞ্জাব,ও সিন্ধু অঞ্চলে।যে সকল স্থানে সঙ্ঘ সিংহভাগের অধিকারী ও শক্তিশালী ছিল, সেখানে স্বয়ংসেবকরা প্রাণের মায়া না করেই রক্তপিশাচদের হাতে আটকে পড়া মহিলা,শিশু ও বৃদ্ধাদের ভারতে পৌঁছানোর কাজে লেগে পড়েছিল।এই প্রচেষ্টার সময় অনেক স্বয়ংসেবক নিজের জীবনও পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু নিজের কর্তব্য ভুলে পরিস্থিতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে পালিয়ে যায় নি।
দেশভাগ হয়ে যখন ভারতমাতা খন্ডিত হয় তখন ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনের সময় জম্বু-কাশ্মীরের কিছু স্থানে পাকিস্তান সমর্থকদের ওড়ানো পাকিস্তানী পতাকা সরিয়ে দিয়ে সেখানে ভারতের জাতীয় পতাকা তেরাঙ্গা উড়িয়ে মানুষের মনোবল অক্ষুন্ন রেখেছিল একমাত্র সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরাই।
১৯৬২সালে চীন আক্রমনের সময় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তৎকালীন সরকারের সঙ্গে দেশের একতা ও অখন্ডতা রক্ষার জন্য সব ধরণের প্রচেষ্টাকে পুর্ণ সমর্থন জানিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। সঙ্ঘের এহেন এই ব্যবহার দেশের রাষ্ট্রপ্রেমী জনগণ কে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, সঙ্ঘ বিরোধী জওহরলাল নেহেরুও ১৯৬৩ সালের ২৬জানুয়ারীর প্রজাতন্ত্র দিবসে সঙ্ঘকে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন।
সাল,১৯৬৪-১৯৬৫ পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বিচার বিবেচনা করার জন্য সর্বদলীয় বৈঠকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রীগুরুজীকে আমন্ত্রণ করেন।পরে দিল্লীর পুলিশকে অন্যান্য কাজে নিযুক্ত করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের দিনগুলিতে রাজধানীর যাতায়াত ব্যবস্থার ভার স্বয়ংসেবকদের হাতে তুলে দেন।যুদ্ধক্ষেত্রে স্বয়ংসেবকরা গোলা বারুদের পরোয়া না করে যুদ্ধরত দেশের সৈনিকদের কাছে খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছিলেন।হঠাৎ একদিন মধ্যরাতে দিল্লীর সঙ্ঘ কার্যালয়ে সেনা আধিকারিকের ফোন আসে- ” আহত সৈনিকদের জন্য রক্তের প্রয়োজন”।পরদিন সকালেই পাঁচশোর বেশি স্বয়ংসেবক রক্ত দেওয়ার উদ্দেশ্যে হাসপাতালে পৌঁছান।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেনা বাহিনীর গোলা বারুদ বহন করতে গিয়ে পশ্চিম দিনাজপুরের চকরাম গ্ৰামের সঙ্ঘের নিত্য শাখার মুখ্য শিক্ষক চূরকা মুর্মু শক্রু গুলিতে প্রাণ হারিয়ে নিঃসার্থ আত্মবলিদান ও দেশভক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশী শরণার্থী দের জন্য ১৯৪৮সালে সঙ্ঘ তৈরি করেছিলেন বাস্তুহারা সমিতি। কয়েক কোটি মানুষ আজও নিজের জন্মভিটা ছেড়ে ভিখারি হয়ে এদেশে পালিয়ে আসছেন তাঁদের সেবা প্রদান করে চলেছেন এই সমিতি।
সঙ্ঘের ভালো, মন্দ সমালোচনা সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন মানুষের মুখেই শোনা যায় , কেউ বলেন, সঙ্ঘ সাম্প্রদায়িক ও কট্টরপন্থী।কেউ বা বলেন, সঙ্ঘ সম্পূর্ণ দেশ ও সমাজের লক্ষ্যে কাজ করেন।
কিন্তু সঙ্ঘ যদি সাম্প্রদায়িক ও কট্টরপন্থী হতো, তাহলে দেশের ঘোর বিপদের দুর্দিনে জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষের সেবায় কর্তব্যরত অবস্থায় সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের দেখা যেত না।
আজ বিগত এক বছর ধরে দেশে যে ভয়ঙ্কর মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রভাব আছড়ে পড়েছে জনমানসে। সেখানেও সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা ত্রাণ বিলি থেকে শুরু করে, জীবনের বাজি রেখে নিজের শরীরে সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাসের অ্যান্টি বডি প্রবেশ করিয়ে দেশের প্রতি, ও সমাজের সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের প্রতি তাদের অগ্ৰনী ভূমিকা রেখেছিল। কারণ সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠায় হয়েছিল দেশকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে নিয়ে।
আজ যখন করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এসে উজাড় করে দিচ্ছে অসংখ্য মায়ের কোল। যার অতল সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে শতশত তরতাজা যুবকের প্রাণ।
সেখানেও আমরা দেখতে পেয়েছি আজ স্বয়ংসেবকদের নিঃসার্থ আত্মবলিদান। নাম, শ্রী নারায়ণ দাভোড়করজী। যিনি মহারাষ্ট্রের নাগপুর নিবাসী,ও ৮৫ বছর বয়স্ক আর.এস.এস প্রবীণ স্বয়ংসেবক। যিনি নাগপুরের এক ছোট্ট হাসপাতালে করোনা চিকিৎসাধীন ছিলেন। সম্প্রতি তিনি করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ এর কবলে পরেন। তাঁর অক্সিজেন মাত্রা ৬০% পর্যন্ত নেমে আসে। তাঁর মেয়ে তাঁর জন্য শহর জুড়ে হাসপাতাল বেড খুঁজে বেড়ান, অনেক চেষ্টার পরে ইন্দিরা গান্ধী হাসপাতালে একটি বেড জোগাড় করতে পেরেছিলেন। দাভোড়করজী কে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তখন তাঁর শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো। হাসপাতালে দাভোড়করজীর হঠাৎই চোখ পরে ৪০ বছরের এক মহিলা এবং তার ছোট্ট দুধের শিশু গুলির দিকে, মহিলাটি হাসপাতাল কতৃপক্ষের কাছে একটি বেডের জন্য কান্নাকাটি করছিলেন, কেনো না তার স্বামী কোভিড আক্রান্ত, এবং অবস্থা সংকটজনক।দাভোড়করজী হাসপাতালের মেডিকেল টিমকে তার ঐ বেডটি যুবককে দিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন ।
” I have lived my life, a young patient’s need is greater than that of mine !”
আমি আমার জীবন অতিবাহিত করেছি, একজন তরুণ রোগীর চাহিদা আমার চেয়ে অনেক বেশি বলে, যুবকের প্রাণ বাঁচাতে নিজের বেড ছেড়ে দিলেন এবং বাড়ি গিয়ে তিনদিন পর করোনা যুদ্ধে নিজের প্রাণ হারালেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের এই প্রবীণ স্বয়ংসেবক।
(১)দেশের প্রায় সমস্ত প্রান্তে আর.এস.এসের স্বয়ংসেবক দ্বারা তৈরি হচ্ছে আইসোলেসন সেন্টার।
(২)জয়পুরের,প্রতাপ নগরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা কোভিড কেয়ার সেন্টারে সাহায্য করছে। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া ও হাসপাতাল চত্বর পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা থেকে শুরু করে অন্যান্য সহায়তাও প্রদান করছে।
(৩)গুজরাটের কর্ণবতীতে ১২০০শয্যা বিশিষ্ট সিভিল হাসপাতালে রোগীদের সমস্ত রকম সহায়তার জন্য তিনটে শিফটে কর্তব্যরত অবস্থায় থাকছে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা।
(৪)গোরখপুর মহানগর দ্বারা সুভাষ চন্দ্র বোস নগর স্থিত ভাউরাও দেবরস ছাত্র নিলয়মে ৫০টি বেডের আইসোলেশন সেন্টার বানানো হয়েছে। যেখানে নরমাল কোভিড রোগীরা নিজেদেরকে আইসোলেট করতে পারবেন। তাছাড়াও এখানে সমস্ত সুবিধা দেওয়া হবে। যা সম্পূর্ণ নিঃশুল্ক থাকবে।
(৫)দিল্লীর অক্ষরধাম মন্দিরে তৈরী করোনা কেয়ার সেন্টারে অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সেবা ভারতীর স্বয়ংসেবক।
(৬)মধ্যপ্রদেশের ইন্দৌরে রাধাস্বামী সৎসঙ্গ ব্যাস মন্দির পরিসরকে দেবী অহল্যা কোভিড কেয়ার সেন্টার বদলে ফেলা হচ্ছে। সেখানে চিকিৎসা ব্যতীত সব ধরনের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থা সম্পর্কিত কাজ করবেন স্বয়ংসেবকরা।২৪×৭ পরিষেবা দেওয়ার জন্য তিন শিফটে মোট পঁচাত্তর জন স্বয়ংসেবক এই কাজে নিযুক্ত থাকবেন।মন্দির পরিসরের স্বচ্ছতাও বজায় রাখবেন স্বয়ংসেবকগণ।
(৭) এছাড়াও, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের স্বয়ংসেবকদের উদ্যোগে বিদ্যালয়,থানা সহ অন্যান্য স্থান স্যানিটাইজ করা, মাস্ক বিতরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি সহ অন্যান্য সেবাকাজও করে চলেছে।
(৮) দেশ জুড়ে করোনা সংক্রম ব্যাপক ভাবে ছড়িয়েছে যার দরুন অক্সিজেনের হাহাকার দেখা দিয়েছে।তাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও বিশ্বহিন্দু পরিষদের সহায়তায় অযোধ্যায় শ্রীরাম জন্মভূমি ট্রাস্টের পক্ষে রাম মন্দির নির্মাণ কল্পে সমগ্ৰ দেশ জুড়ে যে আড়াই হাজার কোটি টাকা অর্থ সংগ্রহ হয়েছিল,সেই নিধি সমর্পণ থেকে ৫৫ লক্ষ টাকা ব্যায়ে তৈরি করা হচ্ছে অক্সিজেন প্ল্যান্ট।
(৯)এছাড়াও আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শাখা সংগঠন বিশ্বহিন্দু পরিষদের স্বয়ংসেবকরা দেশ ও রাষ্ট্রহিতে তীব্র গরমে রক্তের সংকট মেটাতে সাস্থ্য, সচেতনতা ও দূরত্ব বিধি মেনে সামাজিক কর্তব্য পালনে শ্রীরাম নবমীর পদযাত্রাকে বানচাল করে বহু জায়গায় আয়োজন করেছে রক্তদান শিবির।
এভাবেই দেশে যখনেই সঙ্কট এসেছে, সেই সঙ্কট থেকে ভারতমাকে রক্ষা করতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা তৎপরতার সহিত সেবাদূত হয়ে “সেবায় পরম ধর্ম” মন্ত্র নিয়ে রাষ্ট্রহিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এবং দেশকে সমস্ত বিপদের শক্তি থেকে রক্ষা করে ভারত মাতার মান রেখে চলেছেন আজও।
*সমাপ্ত*
কলমে : কৌশিক দাস
তারিখ : ২৯/০৪/২০২১