চোদ্দ বছরের বনবাসে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল শ্রীরামকে, কিন্তু অযোধ্যার রামলাল্লার বনবাস যে শেষ হওয়ার ছিল না। আর তাই মাঝেমধ্যেই ভীষণ যুদ্ধ বাঁধছিল। অগুণতি লড়াইয়ে কখনো রামভক্তেরা দখল নিচ্ছিল, কখনো তাদের প্রতিপক্ষ। ব্রিটিশ শাসনে ব্যাপারটা একটা ছন্দে চলতে থাকে। তবে তার মধ্যেও ঊনিশ – বিশ যে হয়নি এমনটা বললে মিথ্যাচার হয়। নির্মোহী আখড়া — একটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়। এই আখড়ার সদস্যরা নিজেদের রামজন্মভূমির সংরক্ষক বলে মানেন এবং দাবী করেন। তাঁরা ১৮৫৩ সালে সশস্ত্র অবস্থায় মসজিদের দখল নেয়। প্রায় একপ্রকারের অভ্যুত্থানই ছিল। তাঁদের সরানো গেলেও এর জের চলে টানা দুবছর। ব্যাপারটা সাম্প্রদায়িক হিংসার দিকে এগোয়। মসজিদের প্রাঙ্গনে আবার একটা পাঁচিল ওঠে। হিন্দু মুসলিম উভয়পক্ষের প্রার্থনার পৃথক ব্যবস্থা করা হয়।
১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর এক বিরল ঘটনার সাক্ষী হয় অযোধ্যাভূমি। পঁচিশ জন নিহাং শিখ বাবরি মসজিদের দখল নিয়ে নেন। এই নিয়ে আওয়াধের পুলিশ বিভাগে একটি এফ আই আর পর্যন্ত দাখিল করা হয়। এবং অযোধ্যা মামলায় এটাই ছিল প্রথম এফ আই আর।
এফ আই আর-এ স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে নিহাং শিখেরা মসজিদের মধ্যে ঢুকে যজ্ঞা, অর্চনাদি রীতিনীতি পালন করেন। যজ্ঞ শেষ হলে পরে মসজিদের ভেতরের দেওয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে লেখা হয় ‘রাম! রাম!’
১৮৫৩ সালে নির্মোহীদের মসজিদ দখলের পর ব্রিটিশরা নিয়ম করে দিয়েছিল যে, মসজিদের বাইরে শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান বলে চিহ্নিত জায়গাটিতে হিন্দুরা প্রবেশ তথা প্রার্থনা করতে পারবেন। মুসলিমরা মসজিদে প্রার্থনা জানাবেন। কিন্তু নিহাংদের মসজিদ দখলের পর থেকে হিন্দুরা মসজিদেও ঢুকে প্রার্থনা করতে শুরু করে দিল।
কারা এই নিহাং শিখ?
গুরু গোবিন্দ সিংহের ছোট ছেলে ফতেহ সিংহের সঙ্গে নিহাং শিখদের একটা সূত্র পাওয়া যায়। একটা গল্প খুব প্রচলিত আছে। ফতেহ সিংহ তাঁর দাদাদের সঙ্গে যুদ্ধবিদ্যা অভ্যাস করার বায়না ধরেছিলেন। বড়রা বললেন — ‘তুমি তো খুবই ছোট।’ ফতেহ সিংহ তখন ঘরে ফিরে এসে মাথায় একহাত উঁচু একটা পাগড়ি বাঁধলেন। গায়ে চাপালেন নীল কুর্তা। হাতে নিলেন চক্রম, কৃপাণ, বর্শা। বাইরে বেরিয়ে এসে দাদাদের বললেন — ‘আর আমাকে ছোট দেখাচ্ছে না, আশা করি।’ গুরু গোবিন্দ সিংহ ফতেহকে দেখে বলেছিলেন — ‘আজ তোমার এই যোদ্ধা বেশ থেকে নিহাং শিখদের জন্ম হল!’
‘নিহাং’ মানে ‘অমর কুমীর’। ভাবার মতো বিষয় যে জাতি কুমীরের মতো শক্তিশালী জীবের মতো লড়াই করার ক্ষমতা পোষণ করে এবং নিজেদের শৃঙ্খলাকে দীর্ঘ বলে দাবী করে অমরত্বের সঙ্গে তুলনা করে, তাঁদের ক্ষমতা কতখানি হতে পারে। সম্প্রতি সরগড়াহির যুদ্ধ নিয়ে বলিউডে একাধিক সিনেমা এসেছে। সেখানে মাথায় সুবিশাল পাগড়ি বাঁধা যে শিখ সমূহকে লড়াই করতে দেখা গেছে, তাঁরাই হলেন নিহাং শিখ। চক্রম, খণ্ড, করুদ, কৃপাণ, তির এই পঞ্চ শস্ত্র নিহাংদের জীবনের অঙ্গ। কোমরের ডানদিকে ঝুলবে দুটো তলোয়ার, বাম দিকে একটি কাটার বা ছোরা। সঙ্গে বাঘনখ। ত্রিশূলমুখ। পিঠে বাঁধা থাকে মোষের চামড়া দিয়ে তৈরি একটা ঢাল। এছাড়াও নানাবিধ অস্ত্র। একজন নিহাং একশো জনের সঙ্গে লড়তে সক্ষম এমনই তাঁদের প্রশিক্ষণ।
বাবরি মামলার রায়দানকালে নিহাংদের এই ঘটনাটা দারুণ রকমের গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। মসজিদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মসজিদের মূল স্থাপত্যের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনা করার সম্পূর্ণ অধিকারটা চিরকালই মুসলিম পক্ষের ছিল। কিন্তু নিহাংদের এই ঘটনা প্রমাণ করে দেয় যে, হিন্দুরা কেবল মসজিদ প্রাঙ্গনে রামলাল্লার জন্মস্থানে প্রার্থনা করারই অধিকারী ছিলেন এমনটা নয়, মসজিদের মধ্যে ঢুকেও প্রার্থনা করা হয়েছে। মসজিদে কখনো কোনো হিন্দু প্রবেশ করেনি এই যুক্তি এক্ষেত্রে নস্যাৎ হয়ে যায়।
১৮৮৩ সালে হিন্দুদের পক্ষ থেকে একটি মঞ্চ নির্মাণ করে অযোধ্যায় মন্দির তৈরি করার দাবী উঠতে থাকে। ১৮৮৫ সাল। এবারে মামলা গড়াল কোর্টে। মহন্ত রঘুবর দাসের নেতৃত্বে পিটিশন জমা করা হয় ফৈজাবাদের সাব – জাজের কাছে। কিন্তু ধাক্কা খায় মামলা। বলে দেওয়া হয়, অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এর নিদান দেওয়া এখন সম্ভব নয়। যে অবস্থায় আছে, সেভাবেই সব চলবে। মসজিদ প্রথমবারের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ হয় ১৯৩৪ সালে। একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মসজিদের একটি গম্বুজে এবং মসজিদের বহিঃপ্রাচীরে ক্ষতি হয়েছিল। তবে ব্রিটিশ প্রশাসন তার মেরামতি করে দেয়।
যুদ্ধে এবং প্রেমে নাকি সব চলে — ছল বল কৌশল স-বকিছু। রামজন্মভূমি নিয়ে অযোধ্যায় যুদ্ধ চলে এসেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এবারে একটু অন্য পথে ভাবলেন রামভক্তেরা। শ্রীরামচন্দ্রের মন্দির নিয়ে যখন এত কথা আসছে, তখন তো শ্রীরামকেই অযোধ্যায় অবতীর্ণ হতে হয়।
পক্ষ – বিপক্ষ সকলেই যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেন যে রামচন্দ্র একজন ইতিহাস – পুরুষ। তিনি একদা ছিলেন। বাবরি মসজিদের জায়গাতেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাহলেও কি তাঁদের কেউ এই কথাটা মানতে পারবেন যে আজকের রামলাল্লার বিগ্রহখানি ভোজবাজির মতো হাওয়া থেকেই জন্ম নিয়েছিল বাবরি মসজিদের গর্ভে?
আসলে রাজনীতিতে ভালো বা মন্দ বলে কিছু হয় না। যা কিছু হয়, তা হল উপযুক্ত। আইন কানুন দেখিয়ে যখন কিছুই করা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন হিন্দুত্বের মঠাধীশেরা শতরঞ্জের এই দানে ঘোড়ার আড়াই চাল দেবেন বলে ঠিক করলেন।
মন্দিরের ভুমিপূজার দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী উপস্থিত ছিলেন। আর ছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় যোগী আদিত্যনাথ। যোগী আদিত্যনাথের উপস্থিতি কিন্তু কেবলমাত্র একজন মুখ্যমন্ত্রী রূপে নয়, তাঁর উপস্থিতির এক আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। তিনি গুরু গোরখনাথের নাথ সম্প্রদায়ের পক্ষকে পেশ করেছেন রামরাজার দরবারে। নাথ যোগীদের সঙ্গে রামজন্মভূমির আন্দোলনটা একেবারে ওতপ্রত ভাবেই জড়িয়ে। এর জন্য ফিরে যেতে হবে আরেকটু আগে। যোগী আদিত্যনাথের আগে নাথগুরু ছিলেন গুরু অবৈদ্যনাথ। এবং তাঁর গুরু ছিলেন গুরু দিগ্বিজয় নাথ। এই দিগ্বিজয় নাথকে ছাড়া আজকের রামজন্মভূমি আন্দোলনের এই চেহারা, এই গতি, এই ফলাফল কার্যত অসম্ভব ছিল।
১৯৩৫ সালে দিগ্বিজয় নাথের গোরখমঠের মহন্ত রূপে স্বীকৃতি লাভের পর থেকেই গোরখনাথের মঠ – মন্দির দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে থাকে। বছর দুয়েকের মধ্যেই শ্রী দিগ্বিজয় নাথ হিন্দু মহাসভায় যোগ দিলেন। ধর্ম আর রাজনীতি কোনো কালেই আলাদা ছিল না এই ভারতের বুকে, এবারে তা অনুঘটক পেয়ে গেল দিগ্বিজয় নাথের রূপে। রামজন্মভূমি নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেন এই মহন্ত।
যারা রামজন্মভূমির বিপক্ষে, তাঁরা দলিল দেন যে গান্ধীজির হত্যার পর থেকেই উগ্র হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা রামমন্দির নিয়ে ষড়যন্ত্র বোনা আরম্ভ করেছিল। তাঁদের বক্তব্য মেনে নিলে সেই ষড়যন্ত্রের অঙ্গ স্বরূপ দিগ্বিজয় নাথ বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে এক রাজার শরণাপন্ন হন।
কোন রাজা?
অযোধ্যার নিকটস্থ বলরামপুরের রাজা পাটেশ্বরী প্রসাদ সিংহ।
রাজা রামজন্মভূমির পক্ষে ছিলেন। তাঁর দ্বারা আয়োজিত একটি যজ্ঞে দিগ্বিজয় নাথ আরেক সন্ত করপাত্রী মহারাজকে নিয়ে নিজের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উপস্থিতিতে রাজার সঙ্গে মোলাকাত করেন। রাজা রামজন্মভূমি আন্দোলনকে গতিশীল করে তুলতে আর্থিক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপরের ঘটনা লৌকিক অলৌকিকের মিশেলে যে কোনো থ্রিলার নভেলকে হার মানিয়ে দিতে পারে। সালটা ১৯৪৯। পৌষ মাসের হাড় কাঁপানো রাত। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে তারিখ বলছে, ২২শে ডিসেম্বর।
অভীক মুখোপাধ্যায়