রামরাজ্য ও সোনার বাংলা

‘রাম’ শব্দের অর্থ বহুবিধ – কল্যাণ, মঙ্গল, শান্তি প্রভৃতি। বিপরীতে ‘রাবণ’ শব্দের অর্থ – বীভৎস ও ভয়ঙ্কর। রামায়ণে দেখা যায় নানা দুর্যোগ ও বীভৎসতা অতিক্রম করে শ্রীরামচন্দ্র শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কাজেই ‘শ্রীরাম’ শব্দটি কখনোই অন্যায়, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতির পক্ষপাতী নয়। ‘শ্রীরাম’ হলো চিরকালীন, কল্যাণকর ও কালজয়ী। ফলে এমন একটা নাম বা চরিত্র যিনি কেবলমাত্র বাংলায় নয়, সমগ্র ভারতবর্ষ এবং বহির্ভারতেও পরম শ্রদ্ধেয় ও আদর্শের আধার। এহেন ‘শ্রীরাম’ ধ্বনি উচ্চারণে মানুষের পাপ ক্ষয় হয় পাশাপাশি মানুষ আনন্দে ও শান্তিতে থাকতে পারে। ‘শ্রীরামচন্দ্র’ একজন সংস্কারমুক্ত সত্ত্বা। তাই তাঁর কাছ থেকে, তাঁর আদর্শ থেকে সংস্কার মুক্তির পাঠ নিতে হয়। এক্ষেত্রে মানুষ যদি জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারতো তাহলে সমাজে, সংসারে এত অশান্তি থাকত না। খন্ড থেকে অখন্ডে হাজির হওয়ার জন্য যে বোধ, যে ভাবনা — তাই ‘শ্রীরাম’এর কাছ থেকে শিখতে হবে। এনিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক করা কোনও সুস্থ মানসিকতার লক্ষণ নয়।
‘শ্রীরাম’ বিষ্ণুর অবতার, কিন্তু মনুষ্য রূপে জন্ম নিয়ে সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি মানবীয় আচরণই করেছেন। পুত্র হিসাবে পিতার প্রতি এবং রাজা হিসেবে প্রজাদের প্রতি কর্তব্য কী হওয়া উচিত তার চমৎকার দৃষ্টান্ত রাম চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। রামায়ণ রচয়িতা বাল্মিকী ‘রাম’ চরিত্রটিকে এমনভাবে নির্মাণ করেছেন যে, এর প্রভাব যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সমাজে অটুট রয়েছে। পিতৃ ভক্তি, প্রজাবাৎসল্য, পরোপকার, মানবপ্রেম, লোভহীনতা, সত্যপালন ইত্যাদি রাম চরিত্রের আকর্ষণীয় দিক।
রামমন্দির, রামরাজ্য ইত্যাদি রামের ঐতিহাসিক সত্যতা সেই ত্রেতাযুগ থেকে। আলোচনা-সমালোচনা তথা তর্ক-বিতর্ক বিগত প্রায় ৫০০ বছর ধরে এই ‘রাম’ শব্দ বা ভাব নিয়ে ঘাত-প্রতিঘাত চলছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই প্রায় ৫০০ বছর আগেই এই ‘রাম’ নামে বঙ্গ ভূমিতে এক বিশাল জনজাগরণ হয়েছিল। বাংলার অস্মিতা, বাঙালির বাঙালিত্বকে সেদিন এই ‘রাম’ নামের জন আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিমী ইসলামিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন নদীয়ার নিমাই। “হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে” – এই মহামন্ত্রের মাধ্যমে উন্মাদনা তৈরি করে, চাঁদ কাজিকে সংহারের মাধ্যমে বাংলাকে রক্ষা করেছিলেন তিনি।
আজকের বাংলায় সেই ‘রাম’ কে ব্রাত্য করতে বাংলার প্রচার মাধ্যমে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা মা লক্ষীকে ঢাল করেছেন। কখনো কখনো রামকে হিন্দিভাষী উত্তর ভারতীয় বলে আখ্যা দিতেও ছাড়ছেন না। এই বিভ্রান্তিকর বিকৃত আচরণ বাঙালির সামগ্রিকতার ক্ষেত্রে শুধু বিস্ময়েরই নয়, বিপদজনকও। বিশেষ করে যখন গণমাধ্যমে বা প্রচার মাধ্যমে এই বিকৃতি বারবার প্রচারিত হয়। দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দী পর সর্বোচ্চ আদালতের মধ্যস্থতায় ও নির্দেশে সর্বসম্মতিক্রমে সুষ্ঠু মীমাংসার মাধ্যমে অযোধ্যায় সুদীর্ঘ যবনিকার নিষ্পত্তি হল।
ব্রিটিশ শাসনে বঙ্গজীবনে আধ্যাত্বিকতার প্রতি তৎকালীন শিক্ষিত সমাজে যে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল, তা নস্যাৎ করে আধ্যাত্বিক নবজাগরণের আর এক ধারার যিনি জন্ম দিয়েছিলেন তিনি হলেন ‘পরমহংস শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব’। বাংলার ঘরে ঘরে আদর্শ, সত্যপরায়ণতা এবং নৈতিকতার প্রতিমূর্তি হলেন ‘শ্রীরামচন্দ্র’। স্বামী বিবেকানন্দ রাম-সীতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “রামচন্দ্র হলেন আদর্শ পুত্র, আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা সর্বোপরি আদর্শ রাজা”। সীতা পবিত্র, বিশুদ্ধ এবং সহিষ্ণুতার চূড়ান্ত প্রতিমূর্তি। ভারতবর্ষে যা কিছু কল্যাণকর সীতা বলতে তাই বোঝায়। নারীর মধ্যে নারীত্ব বলতে যা বোঝায়, সীতা তাই। নারী চরিত্রের যত রকম ভারতীয় আদর্শ আছে সবই সীতা চরিত্র থেকে উদ্ভূত। আর ভারতবর্ষ হল ‘রাম’ কে নিয়ে, রামের জন্য, রামময়।
পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতি এবার যেন ‘রাম’ কেন্দ্রিক। অন্য সব ইস্যুকে ছাপিয়ে দশরথ পুত্র ‘শ্রীরামচন্দ্র’ই রাজনীতির সবচেয়ে আলোচ্য চরিত্র। বাংলার হিন্দুরা ‘শ্রীরামের’ নাম মন্দিরে বসে করতেন, রাম নামের আসরে হতো প্রভু ‘শ্রীরামচন্দ্রের’ চর্চা। কিন্তু এখন বাংলা রাজনীতিতে শ্রীরাম নিয়ে আলোচনা চলেছে মন্দির থেকে ময়দানে, চায়ের ঠেক থেকে বারোয়ারি আড্ডায়, গৃহস্থের বৈঠকখানা থেকে জনবহুল বাজারে, ট্রেনে, বাসে সর্বত্র। যে বাঙালি হিন্দুরা শ্রীরামের নাম – মন্দিরের পূজা অর্চনায় বা হরিনাম সংকীর্তনে বা রামনামের আসরে অথবা রামযাত্রার মাধ্যমে ভক্তিভরে স্মরণ করত, সেইরামই এখন বাংলার ঘরে-ঘরে চর্চার মূল বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। তাই বাংলার রাজনীতিতে শ্রীরামই একমাত্র আলোচ্য চরিত্র।
‘শ্রীরামের’ চরিত্র সম্বন্ধে বঙ্গবাসীর ধারণা যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায়। ‘শ্রীরামচন্দ্র’ হিন্দুর মননে শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়। তিনি ‘বিষ্ণু’র অবতার। তাঁর রাজ্য ‘ধর্মরাজ্য’। তাই সেখানে মানুষের শোক, দুঃখ, গ্লানি কম। ‘রামরাজ্য’ কেমন তার বর্ণনা রয়েছে বাল্মীকি রামায়ণে।
রাঘবশ্চাপি ধর্মাত্মা প্রাপ্য রাজ্যমনুত্তমম্।
ঈজে বহুবিধৈর্যজ্ঞৈঃ সসুহৃজজ্ঞাতি বান্ধবঃ।।
……………………………………………………
রামো রামো রাম ইতি প্রজ্ঞানামভবন্ কথাঃ
রামভুতং জগদভূদ রামে রাজ্যং প্রশাসতি।।

‘শ্রীরামচন্দ্রে’র রাজ্যে সকলে আনন্দিত, সৎ ও ধর্মপরায়ণ ছিল। রামকে অনুসরণ করে কেউই পরস্পরকে হিংসা করত না। রাজ্যে কোনও দস্যু ছিল না, কোথাও কোনো অনর্থ চোখে পড়তো না। সকলে ছিলেন বিনয়ী ও কর্তব্যপরায়ণ। বুদ্ধিমান ও গুণবান। সবাই গুণের সমাদর করত এবং পুণ্যময় জীবন অতিবাহিত করত। রামরাজ্যে সকল ব্যক্তি পরোপকারী ও ভক্তিপরায়ণ ছিলেন। রামরাজ্যের অতি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে তুলসীদাস রচিত ‘রামচরিত মানসেও’। রামরাজ্যে কোথাও অকাল মৃত্যু ও রোগ-ব্যাধি ছিল না। সকলে সুন্দর দেহ ও স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল। কেউ দরিদ্র বা দুঃখী ছিল না। কেউ অবুঝ বা কুলক্ষণযুক্ত ছিল না। ছিল না বেকারত্ব। ছিল না কর্মহীনতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা দুর্নীতি। ছিল না সৌজন্যবোধের অভাব। ত্রিলোকে ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সকলের মন আনন্দে পরিপূর্ণ থাকত ও যাবতীয় শোক, দুঃখ, যন্ত্রণা থেকে রাজ্যবাসী মুক্তি পেয়েছিল। মানুষ পরস্পরের প্রতি সর্বপ্রকার শত্রুতা ভুলে গিয়েছিল। এবং ‘শ্রীরাম’-এর প্রভাবে সমাজে অসাম্য ও বৈষম্য দূরীভূত হয়েছিল।
সোনার বাঙলার যে স্বপ্ন রয়েছে তার সবই ছিল রামরাজ্যে। তাই পশ্চিমবঙ্গে রামরাজ্য চালু হলেই বাংলা ‘সোনার বাংলা’য় রুপান্তরিত হবে। যে ‘সোনার বাঙলা’র কথা বঙ্গভঙ্গের সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় উল্লেখ করেছিলেন। যে ‘সোনার বাংলা’র কথা স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর রচনায়, বক্তৃতায় ও বিভিন্ন আলোচনায় উল্লেখ করেছিলেন, যে ‘সোনার বাংলা’র কথা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, সেই ‘সোনার বাংলা’ই হল প্রভু রামচন্দ্রের ‘রামরাজ্য’। যে ‘সোনার বাংলা’য় অতীত ঐতিহ্য ফিরে আসবে, শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা কাজ পাবে, মা-বোনেরা নিরাপত্তা পাবেন, দোষীর শাস্তি পাবে, সৎ-জ্ঞানী-গুণীরা সম্মান পাবেন যে সোনার বাংলায় পুনরায় সমগ্র ভারতবর্ষকে পথ দেখাবে এবং বিশ্বের সমগ্র মানব কল্যাণে আত্মনিয়োগ করবে। যে সোনার বাংলার বীর সন্তানদের চিন্তাভাবনা, ধ্যান-ধারনায়, জ্ঞান ও দূরদর্শিতায় ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন’ লাভ করবে। বাংলার বাসিন্দারা সেই সোনার বাংলা চায় – যার মধ্যে ‘রামরাজ্যে’র সমস্ত গুণ বিদ্যমান থাকবে, মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।

সরোজ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.