রামনবমী’ উৎসব হল ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক

‘রামনবমী’ হল ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক পবিত্র দিন। শ্রীরামচন্দ্র এই দিন পৃথিবীর বুকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাই ভগবান শ্রীরামের জন্মদিনটি হিন্দুরা ব্রত হিসেবে পালন করে থাকেন। রামনবমী ব্রত চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে পালন করা হয়। বিষ্ণুর সপ্তম অবতার হলেন শ্রীরামচন্দ্র। ত্রেতা যুগে অযোধ্যার রাজা দশরথ ও তাঁর প্রথম পত্নী কৌশল্যার গর্ভে শ্রীরামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীরামচন্দ্রের জন্মদিনটি ‘রামনবমী’ নামে পরিচিত। রামনবমী পালন করার মূল উদ্দেশ্য হল অধর্মকে নাশ বা ধ্বংস করে ধর্মকে স্থাপন করা, অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভশক্তি সূচনা করা।
প্রাচীন ভারতের হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মত অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণু হলেন বিশ্ব সংসারের পালক। বিভিন্ন যুগে তিনি নানা অবতার রূপে পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন। বিশ্ব সংসারের সকল মানুষকে ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যের পথ প্রদর্শন করতে এবং মিথ্যার উপর সত্যের জয় প্রতিষ্ঠা করতে শিখিয়েছেন।
‘রামনবমী’ মূলত হিন্দুদের উৎসব। ভগবান রামের জন্মদিনটি হিন্দুরা ‘রামনবমী’ উৎসব রূপে পালন করে। এই উৎসবটি চৈত্র মাসের নবম দিনে পালিত হয়। ত্রেতা যুগে ভগবান বিষ্ণুর দুষ্টুদের দমনের জন্য, সাধুদের পরিত্রাণের জন্য ও সমাজে ধর্ম স্থাপনের জন্য ‘রাম’ অবতার রূপে অযোধ্যার রাজা দশরথ ও রানি কৌশলার পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করেন। ভগবান রামের উল্লেখ যে শুধুমাত্র প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থে পাওয়া যায় তা নয়, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থেও শ্রীরামের উল্লেখ রয়েছে।

রামনবমী হিন্দুধর্মের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। মন, প্রাণ ও দেহকে পবিত্র করার জন্য এই উৎসবটি পালন করা হয়। অশুভ শক্তির অপসারণ ও ঐশ্বরিক শক্তির আগমনের জন্য রামনবমী উৎসব পালন করা হয়। ভগবান রাম অত্যাচারী রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করার বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শত্রুদের বিনাশ করে, অধর্মকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীরাম। তিনি তাঁর পিতার নির্দেশে রাজবাড়ির ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য ত্যাগ করে বনবাসী জীবনকে গ্রহণ করেছিলেন। পিতৃসত্য পালনের জন্য তিনি বনে যান। চোদ্দ বছর বনবাসে থেকে তিনি রাবণকে বধ করে অযোধ্যায় ফিরেছিলেন। এই চোদ্দ বছর শ্রীরামের জীবনে নানা ঝড়, বাধা, বিপত্তির, ঘাত-প্রতিঘাত সহ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও তিনি নিজ লক্ষ্যে স্থির ছিলেন। তাই শ্রীরামের জীবনকে হিন্দুরা আদর্শ হিসাবে মেনে চলেন। এই কারণে তাঁকে ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ বলা হয়। তাঁর রাজ্যে প্রজারা সুখে শান্তিতে বাস করত এবং সেই রাজ্যের সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার অব্যাহত ছিল। এই জন্য রামের শাসনের অনুসরণে সুশাসিত রাজ্যকে ‘রামরাজ্য’ বলা হয়। হিন্দুধর্মে রাম অন্তঃহীন প্রেম, সাহস, শান্তি, শক্তি, ভক্তি, কর্তব্য ও মূল্যবোধের দেবতা। ভগবান শ্রীরাম হলেন শ্রেষ্ঠ পুরুষ। যিনি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিপতি এবং গুণাধীশ।
ভারতবর্ষের সর্বত্রই ভগবান রাম বিরাজমান। সমগ্র ভারতে শ্রীরামকে আরাধ্য দেবতা হিসাবে আরাধনা করা হয়। শ্রীরাম ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক। কবি ইকবাল ১৯০৮ সালে শ্রীরামের গৌরবে একটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন। তিনি ভগবান রামকে ‘রাম-ই- হিন্দ’ বলতেন। তিনি কবিতায় লিখেছিলেন রামের অস্তিত্বে গর্বিত হিন্দুস্থান। গান্ধীজী ভারতে ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠা দেখতে চেয়েছিলেন। এই রামরাজ্য ন্যায়বিচার, সাম্য ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচিত হয়। এই রাজ্য পবিত্র ও সত্যনিষ্ঠার উপর প্রতিষ্ঠিত।
শ্রীরাম প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের ঈশ্বর। এক একটি পাথর যুক্ত করে ভারত ও লঙ্কার মধ্যে সেতু তৈরি করা হয়েছিল। সেই কাজে তাঁকে সকলে সাহায্য করেছিলেন। তিনি কঠোর পরিশ্রম নিজে করেছিলেন এবং অন্যকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মেরই ঈশ্বর নন। তিনি হলেন ভারতীয় ভূখণ্ডের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এই ঐতিহ্যকে ভাগ করা সম্ভব নয়। রামের নাম ভারতে বসবাসকারী কোটি কোটি নাগরিককে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করে। বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক চেতনার মহান দূত হলেন ‘শ্রীরাম’।
রামনবমী দিনটি ‘বসন্ত নবরাত্রি’র শেষ দিনে পালন করা হয়। এই নবরাত্রি চৈত্র মাসে হয় বলে একে ‘চৈত্র নবরাত্রি’ বলা হয়। আবার বসন্ত ঋতুতে এই উৎসব হয় বলে একে ‘বসন্ত নবরাত্রি’ও বলা হয়। চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথি থেকে শুরু হয়ে নবমী তিথি পর্যন্ত করা হয় দেবী দুর্গার নয়টি রূপের বন্দনা। হিন্দুশাস্ত্রে বলা আছে, নবম দিনে দেবী দুর্গা অশুভ শক্তিরূপী অসুরকে পরাজিত করে শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
রামনবমীর দিন সকালে আদি দেবতা সূর্যদেবকে জল প্রদান করা হয়। সূর্যদেবের আশীর্বাদ নিয়ে ধার্মিক ও সদাচারী ব্যক্তিরা সারাদিন বৈদিক মন্ত্র পাঠ করেন। এদিন রামায়ণ পাঠ ও ভক্তিমূলক গান গাওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই উৎসব উপলক্ষে মেলা বসে এবং পালিত হয় বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান। রামকথার বর্ণনা শুনে, রামকাহিনী পড়ে এই দিনটি পালন করা হয়। অনেকে মন্দিরে যান, অনেকে বাড়িতে রামের মূর্তি পূজা করেন, অনেকে শ্রীরাম বিজয়মন্ত্র ধ্যানের মাধ্যমে এদিন শুভশক্তির প্রার্থনা করে থাকেন।

শ্রীরাম বিষ্ণুর অবতার। কিন্তু মনুষ্য রূপে জন্ম নিয়ে মানব জাতিকে শিক্ষা প্রদানের জন্য তিনি মানবীয় আচরণই করেছেন। পুত্র হিসাবে পিতার প্রতি এবং রাজা হিসাবে প্রজাদের প্রতি কর্তব্য কী হওয়া উচিত, তাঁর চমৎকার উদাহরণ শ্রীরাম চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। রামায়ণ রচয়িতা বাল্মিকী রাম চরিত্রটিকে এমনভাবে নির্মাণ করেছেন যে, এর প্রভাব যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সমাজে অটুট রয়েছে। পিতৃভক্তি, প্রজাবাৎসল্য, পরোপকার, মানবপ্রেম, লোভহীনতা, সত্যপালন ইত্যাদি রামচরিত্রের আকর্ষণীয় দিক। শ্রীরাম চরিত্র সম্বন্ধে বঙ্গবাসীর শ্রদ্ধা যথার্থভাবে ফুটে উঠেছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায়। শ্রীরামচন্দ্র হিন্দুর মননে শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়। তাঁর রাজ্য ‘ধর্মরাজ্য’। তাই সেখানে মানুষের শোক, দুঃখ, গ্লানি কম।
রামরাজ্য কেমন তার বর্ণনা রয়েছে বাল্মীকি রামায়ণে। সেখানে বলা হয়েছে, শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যে সকলে আনন্দিত, সৎ ও ধর্মপরায়ণ ছিলেন। সকলে ছিলেন বিনয়ী ও কর্তব্যপরায়ণ। রামরাজ্যে কেউ দরিদ্র ও দুঃখী ছিল না। ছিল না বেকারত্ব, কর্মহীনতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা। ছিল না সৌজন্য বোধের অভাব ও ভাষা সন্ত্রাস। মানুষ পরস্পরের প্রতি সর্বপ্রকারের শত্রুতা ভুলে গিয়েছিল। ‘শ্রীরাম’ এর প্রভাবে অসাম্য ও বৈষম্য দূরীভূত হয়েছিল। নারীরা পেয়েছিল সম্মান। রামরাজ্যে নারীর নিরাপত্তা সুরক্ষিত ছিল। প্রজানুরঞ্জক রাজা হিসাবে প্রজাদের কাছে শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন কাছের মানুষ ও মনের মানুষ। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘রামচন্দ্র হলেন আদর্শ পুত্র, আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা সর্বোপরি আদর্শ নৃপতি’। তাই শ্রীরামচন্দ্রের জন্মদিনটি ভারতবাসী তথা হিন্দুদের কাছে পবিত্র দিন, শপথ নেওয়ার দিন। ‘রামনবমী’ উৎসব হল মিলনের উৎসব, ভালোবাসার উৎসব, পবিত্রতার উৎসব, সত্য ও ধর্মস্থাপনের উৎসব।

সরোজ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.