ব্রাত্য এক বঙ্গসন্তান…….

বহরমপুর স্টেশনে নেমে কোনদিন কাউকে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখেছেন…….. ?
ওঁর জন্মস্থান তো শুনেছি এখানে, কোথায় বলতে পারেন? দেখবেন লোকজন আপনার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে। মহেঞ্জোদাড়োর আবিষ্কর্তা বললে অনেকে বুঝতে পারবে হয়তো কিন্তু বাড়ির খোঁজ দিতে পারবে না। অথচ এই শহরেই জন্মেছিলেন তিনি আজকের দিনে (১২ই এপ্রিল) ১৮৮৫ সালে।

বহরমপুরে ভাগীরথী সেতুর নাম প্রবন্ধকার রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর নামে। মুর্শিদাবাদের আরেক গর্ব, যদিও তিনি খাস বহরমপুরের লোক নন। তাঁর জন্ম কান্দি মহকুমার জেমো গ্রামে। সেখানে ভূমিপুত্র রাখালদাসকে নিয়ে এক অদ্ভুত উপেক্ষা তাঁর শহরে। সারা শহর ঘুরে একটা স্ট্যচুও চোখে পড়বে না, নেই কোন রাস্তার নাম।

রাখালদাসের মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কারের কৃতিত্ব চুরি করেছিলেন সে আমলের বিশিষ্ট ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ জন মার্শাল, এমন অভিযোগ রয়েছে। রাখালদাসকে নিয়ে সাম্প্রতিক বই, ‘রাখালদাস ব্যানার্জি: দ্য ফরগটন আর্কিওলজিস্ট’ এ এমনই অভিযোগ লেখক পিকে মিশ্রর। মার্শাল ছিলেন ওই সময় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার জাঁদরেল ডিরেক্টর জেনারেল। ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনিই দাবি করতে থাকেন, আবিষ্কার তাঁর। অথচ ১৯১৮ থেকে ১৯২২, ওখানে পড়ে থাকতেন রাখালদাস। মার্শাল ১৯২৪ সালের মে মাসের আগে জায়গাটা নিয়ে কিছু জানতেনই না। ওখানে প্রথম যান ১৯২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ততক্ষণে রাখালদাসের সব কাজ সারা। তিনি প্রথম রিপোর্ট দেন ১৯২০ সালে। সব চেপে রাখা হয়। ১৯২২ সালে সেই রিপোর্ট নিজের নামে চালিয়ে দেন তাঁর ‘বস’ মার্শাল। আমাদের বাপ-দাদারাও সবাই ছোটবেলায় পড়েছেন, মহেন্জোদড়োর আবিষ্কারক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ বহির্বিশ্বে মার্শালের নামই চালু এখনও।

পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয়দের কৃতিত্বকে চেপে দেওয়ার ঘটনা কম নেই। সেদিক থেকে রাখালদাসের ঘটনা সত্যি না হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু এর পরে যা হল, তা অবিশ্বাস্য। যিনি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক কাজকর্মে এত সাফল্য এনে দিলেন, সেই কাজকর্ম থেকেই সরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে ১৯২৬ সালে। সোজা কথায় চাকরি গেল রাখালদাসের। অপ্রমাণিত একটি চুরির অভিযোগে।

চাকরি যেতে রাখালদাস আর্থিক প্রতিকূলতায় পড়লেন। বিষয়সম্পত্তি কম ছিল না, বেতনও পেতেন প্রচুর। কিন্তু এ সবের সঙ্গে তাঁর খরচের বহরও ছিল দেখার মতো। বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে আড্ডা খানাপিনা বাড়িতে লেগেই থাকত। আর চালচলনে তো ছোটবেলা থেকেই নবাবিয়ানা। যে সময় টাকায় এক মণ চাল, সে সময় রেলস্টেশনে কুলিকে তিনি অবলীলায় দশ টাকা বখশিস দিয়ে দেন।

মহেঞ্জোদাড়োর আবিষ্কারক রাখালদাসের মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ৪৫-এ। ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন তার ওপরে কার্বাঙ্কল জাতীয় কিছু একটা হয়েছিল। অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে গেলেন। তবে যা করে গেলেন সেটাও কিছু কম নয়…… মহেঞ্জাদারো-সহ নানা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে অংশগ্রহণ করা তো আছেই সেই সঙ্গে লিখে গেছেন প্রচুর গবেষণামূলক বইপত্র, ঐতিহাসিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটে উপন্যাস। দুখণ্ডে রচনা করেছেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’। কুষান আমলের উপর লেখেন পাষাণের কথা, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় নিয়ে লেখা শশাঙ্ক, ধ্রুব এবং করুণা, পাল সাম্রাজ্য নিয়ে ধর্মপাল (১৯১৭)। ময়ুখ উপন্যাস লিখেছিলেন শাহজানের আমলে বাংলায় পর্তুগিজ রমরমা নিয়ে। বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের অন্যতম শরিক তিনি। মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কারের পরও নাদির শাহ বা ফারুখশীয়ারের আমল নিয়ে দুটো বই লিখেছিলেন।

ছানাবড়ার পেটেন্ট নেওয়ার জন্য যে শহরে এতো আকুতি বিকুতি, সেখানে রাখালদাসের এত বড় স্বীকৃতির জন্য দাবি ওঠে না কেন, এটাই প্রশ্ন। অবশ্য প্রশ্ন তুলবেন কারা? বহরমপুরবাসী তো মনেই রাখেনি তাঁকে।
জন্মভূমিতেই তাই ব্রাত্য রয়ে গেলেন মহেঞ্জোদাড়োর বাঙালি আবিষ্কারক! জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ‌🌹
‌🌲 সংকলনে ✍🏻 স্বপন সেন 🌲

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.