সপ্তম অধ্যায় – তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে নববর্ষ

#সপ্তম_অধ্যায়

সেদিন সুবিশাল অতীত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গড়ে উঠেছিল এক একটি রাজ্য । সেই সব রাজ্যে কোথাও ছিল রাজতন্ত্র কোথাও বা গণতন্ত্র। প্রতিটি রাজ্যে প্রচলিত ছিল ভিন্ন ভিন্ন মতামত। তাদের নিয়ম কানুন, রীতি নীতি, আচার বিচার এক হয়েও কোথাও গিয়ে কিছু না কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্যের স্বীকার হত। শাসক বা রাজার পরিবর্তনের সঙ্গে সেসবও সূক্ষ্ম বা মোটা ভাবে পরিবর্তন হত। 


যস্মিন দেশে যদাচার ।


সেই কারণে রাজার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই পুরাতন সমস্ত নিয়ম এবং বছর গণনার হিসাব নিকাশ সমস্ত কিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়ে নতুন করে সব কিছুর সূচনা ঘটতো। নতুন সব কিছু সূচনা হত নতুন রাজার সাথে। ঠিক এরকম ভাবেই কোন পন্ডিতের গ্রন্থে যুক্ত হয়েছিল বিক্রম সংবৎ অথবা শক সংবৎ। আবার সুপ্রাচীন নিয়ম মেনে কেউ মানতেন কলিযুগ সংবৎ। বৌদ্ধ বিহার গুলি বুদ্ধের পরিনির্বাণের সঙ্গে মেনে চলতেন বৌদ্ধ পরিনির্বাণ সংবৎ।

 
একটা সময়ের পর প্রাচীন ঋকবৈদিক যুগের মুনিঋষিদের প্রচলিত বছর গণনা বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক , সামাজিক এবং লৌকিক ধারায় পড়ে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। এবং পূর্বেই আলোচনা করেছি অজস্র রকমের সংবৎ সৃষ্টি হয়েছিল। তাহলে সাধারণ মানুষ কি করত ? তাদের করণীয় কি ছিল ? কোনো নতুন রাজার নিজের ইচ্ছে ,খেয়াল খুশি মত বারবার নতুন নিয়ম, নতুন হিসাব, নতুন সংবৎ হবে আর সাধারণ মানুষ রোজ পঞ্জিকা ছিঁড়ে ফেলে নতুন একটা পঞ্জিকা জ্যোতিষ ঠাকুরের বাড়ি  থেকে আনতে যাবে? 


এমন অসম্ভবকে গ্রাহ্য না করে একটা সময় পরে সাধারণ মানুষ  বরাহমিহির ঘোষিত মেষ রাশির বৈশাখ মাস থেকেই বর্ষ গণনা করতে শুরু করলেন। বরাহমিহির যে এই বর্ষগণনা প্রচারক সেকথা বিক্ষিপ্তভাবে আলবেরুনি তাঁর ‘কিতাব উল হিন্দ’ গ্রন্থের বলেছেন। আলবেরুনির ভারত ভ্রমণ কালে মোট আটটি এরা বা বৎসর ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত ছিল।

উক্ত আটটি বৎসর হিসাবের মধ্যে একটি  শক কাল বা শকাব্দের ৫২৬ বছর পরে প্রতিষ্ঠিত।
“……the era of the canon Panchasiddhantika by Varahamihira …”

 যদিও ষষ্ঠাব্দ বা দু একটি সংবৎসর প্রসঙ্গে আলবেরুনি, যে বলেন বৈশাখ থেকেও বর্ষগণনা চালিত ছিল। যদিও এখানে তিনি বরাহমিহিরের নাম উল্লেখ করেননি । 


বেদাঙ্গ জ্যোতিষ ৩৬৬ দিনে বৎসর ঘোষণা করে। তাই সেই প্রাচীন কাল থেকেই সৌর বৎসর বিষয়টি তৎকালীন শিক্ষিত মানুষের মধ্যে জাগরিত ছিল ।আর্যভট্ট কিংবা তারপরে বরাহমিহির যখন মেষ থেকে মীন পর্যন্ত দ্বাদশ রাশির সৌর ভোগকালকে একটি সৌর বছর হিসাবে প্রচার করলেন তাতে জনসাধারণের সুবিধাই হলো । তাই রাজা বা সম্রাট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বারবার বদলে যাওয়া বর্ষপঞ্জিকা ঘোষণায় তাদের কোন অসুবিধা দেখা দেয় বা দেয় নি বিষয়টি তর্ক এবং অবশ্যই বিস্তর তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষ বিষয়। তবে বরাহমিহির যে সর্বজন গ্রাহ্য ছিলেন তার সব থেকে বড় প্রমান প্রতি ঘরে ঘরে আজও প্রাপ্ত ও রক্ষিত চৌদ্দ পুরুষের ঠিকুজি ব কোষ্ঠী। 

ঠিকুজি-কোষ্ঠি বিষয়টি বরাহমিহিরের #পঞ্চসিদ্ধান্তিকা #বৃহৎসংহিতা , #বৃহৎজাতক গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। বরাহমিহিরের হাতে জ্যোতির্বিদ্যা  ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল ফলিত জ্যোতিষ । সংহিতা এবং হোররার মিশ্রণ। 

গ্রহের গতি ও অবস্থানের কারণে ফলিত জ্যোতিষের বিষয় হয়ে উঠল মানুষ অর্থাৎ জাতকের জীবনের শুভাশুভ ফলের ঘোষণা। ইংরেজিতে একেই অ্যাস্ট্রোলজি বলা হয়। এবিষয়ে প্রাচীনকালের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ #বৃহৎসংহিতা। 

বৃহৎসংহিতা নামক সুবিশাল গ্রন্থটির ১০৭ টি অধ্যায় ।এই অধ্যায় গুলিকে সাধারণভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায় –  একভাগ মূলত প্রাকৃতিক বিবরণ । এই বিবরণের সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্রের কোন সম্পর্ক নেই। অন্যভাগে গ্রহ-নক্ষত্র যোগের ফলাফল বিচার বর্তমান। এই বিভাগটিই বিরাহমিহিরকে আজও বিশ্বব্যাপী অম্লান করে রেখেছে। এই বিভাগের প্রতিপত্তির কারণ ,অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম। এই সংগ্রামে জ্যোতিষ সম্প্রদায় উন্নতির কিছু পরামর্শ রাখেন। মানুষবা জাতকের ভূত এবং ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কে গণিতের সূত্রে গণকগণ গ্রহস্ফুট,নক্ষত্র, রাশি ও লগ্নে  বিচার করে থাকেন।
বৃহৎসংহিতাতে বরাহমিহির রবি, সোম ,মঙ্গল ,রাহু, বুধ ,বৃহস্পতি, শুক্র, শনি , ধুমকেতু, অগস্ত‍্য‍ ও সপ্তর্ষির রাশি সঞ্চারনের ফলে শুভাশুভ ফল গণনা করলেন। কেবল তাই নয়, বরাহমিহির ভারতবর্ষকে নয়টি ভাগে ভাগ করে প্রতি ভাগে যে নক্ষত্রের আধিপত্য তারও বিবরণ রাখলেন । এই বিভাগ #কূর্মবিভাগ নামে পরিচিত। 


 #নক্ষত্রব্যূহে তিনি জাতকের উপর এই নক্ষত্রের প্রভাব বর্ণনা করলেন এবং অনুরূপ #গ্রহভক্তি বিভাগও রাখলেন,  যেখানে জাতকের উপর পড়েছে গ্রহের প্রভাব বা গ্রহ সমাগমের ফল । গ্রহ বর্ষ ফলাফলও এর মধ্যে থাকে যা আজও কোন পঞ্জিকায় দৃশ্যমান । তাছাড়া চক্রাকারে, ধনুক আকারে, বা পানি ফলের মতো ত্রিকোণ আকারে গ্রহ সম্মিলনের ফলে জাতকের অবস্থাও বর্ণনা করেন। সেই সঙ্গে গ্রহের অবস্থান বিবেচনা করে ভাবি শস্য উৎপাদন কেমন হবে তারও শুভাশুভ নির্ণয় করেন #শস্যজাতকে। শস্য ছাড়া প্রাণ বাঁচে না – একথা অনুভব করছিলেন জ্যোতিষ গুরু। তাঁর রচনায় তাই স্থান পেয়েছিল শস্য রূপী জাতক। 

এই গ্রন্থের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী । ঘরে ঘরে তৈরি হল ঠিকুজি-কোষ্ঠি। যা নবজাতকের ভবিষ্যৎ গননা করে ।কিন্তু আমাদের সুপ্রাচীন ভারতবর্ষে অদৃশ্য চর্চা নতুন নয়। #কৌশিক_সূত্রে শুভদিন প্রসঙ্গ আছে । পুণ্যদিবস, পুণ্যরাত্রি , পুণ্যাহ ইত্যাদি শব্দগুলো #মহাভাষ্য গ্রন্থে বর্তমান। প্রাচীনকালে শুভাশুভ নির্ণয় করতেন যাঁরা তাদের বলা হতো #শকুনজ্ঞানবিদ্ বা  #নির্মিত্তজ্ঞ। বৃহৎসংহিতায় প্রাকৃতিক বিবরণ এর চাইতেও গ্রহ গোচার ফল অর্থাৎ জাতকের জন্মরাশি থেকে মৃত্যু অবধি শুভাশুভ নির্ণয় ইত্যাদিতে গুরুত্ব আরোপ হলো দৃঢ়তার সঙ্গে । আর এই ফল নির্ণয়ে বর্ষ সূচনার মেষ রাশি ও বৈশাখ মাস মান্য হয়ে উঠলো।


ভাবীকালে জ্যোতিষবিদদের যে ছবি দ্বিতীয় অধ্যায় বরাহমিহির অঙ্কন করেছিলেন তাঁর গ্রন্থে সেই জ্যোতিষগণই বরাহমিহিরকে বহন করে নিয়ে গেলেন দেশ থেকে দেশান্তরে। বরাহমিহির প্রবর্তিত অদৃষ্টতত্ত্ব এবং তার খন্ডনতত্ত্বকে ধ্রুপদীভারতীয় সনাতনী দর্শনের ছয়টি আস্তিক  শাখা ছিলেন তাঁরা কেউই এড়িয়ে যেতে পারেননি সেদিন আজও অনেকে হয়তো জ্ঞানে অজ্ঞানে এড়িয়ে যেতে পারেন না । 

গৃহ নির্মাণ বা ব্যবসা-বাণিজ্য সূচনা, বিবাহ কিংবা জন্ম মৃত্যু , অশৌ ইত্যাদিত জ্যোতিষ বিভাগের বিশাল প্রভাবকে আজও কোন ভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে আরও বলা যায় কোন জাতক মারা গেলে তার ঠিকুজি-কোষ্ঠি চিতায় অথবা নদীতে বিসর্জন দেওয়া নিয়ম  আজও প্রচলিত আছে । বিশেষ করে সনাতনী মানুষজন বরাহমিহিরের নির্দেশ অমান্য করার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। আজও অতীতের মতো গৃহস্থ বাড়িতে জাতক তথা রাষ্ট্রের বার্ষিক রাশিফল শুনিয়ে যান জ্যোতিষ ঠাকুর বর্ষ সূচনার প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখ। সুদূর অতীতকাল থেকে এই প্রথা চলে আসছে এবং পয়লা পহেলা বৈশাখেই নতুন বঙ্গাব্দের সূচনা।

#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ  ১ . লোকায়ত রাঢ় বঙ্গ     

     ২. বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন ভারত ও সমকালীন অন্যান্য দেশ   

       ৩. ঋগ্বেদ সংহিতা       

    ৪. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা     

      ৫. বঙ্গাব্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.