তৃতীয় অধ্যায় – তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে নববর্ষ

#তৃতীয়_অধ্যায়

মহর্ষি লগধ প্রণোদিত বেদান্ত জ্যোতিষ , শতপথ ব্রাহ্মণ, সূর্যসিদ্ধান্ত রচনার বহু পূর্বে গড়ে উঠেছিল বেদ। সেই বৈদিক ঋষিগনও সকল কিছু গণনা করে ছয়টি ঋতু র সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। #কৃষ্ণযজুর্বেদসংহিতার চতুর্থ কান্ড , চতুর্থ প্রপাঠকের একটি মন্ত্রে যজমানের  উৎকর্ষের জন্য ঋতু ও মাসগুলিকে আহ্বান জানান যাজক  :


মধুশ্চ মাধবশ্চ বাসন্তিকাবৃতু শুক্রশ্চ শুচিশ্চ গ্ৰৈষ্মাবৃতুনভশ্চ নভস্যশ্চ বার্ষিকাবৃতু ইষশ্চজ্জর্শ্চ শারদাবৃতু সহশ্চ সহস্যশ্চ হৈমন্তিকাবৃতু তপশ্চ তপস্যশ্চ শৈশিরাবৃতু….


বিজনবিহারী গোস্বামী এর ব্যাখ্যায় বলেছেন :
মধু মাধব চৈত্র ও বৈশাখ বসন্ত ঋতু । শুক্র শুচি জ্যেষ্ঠ আষাঢ় গ্রীষ্ম ঋতু , নভঃ নভশ্চ শ্রাবণ ও ভাদ্র বর্ষা ঋতু , ইষঃ ঊর্য আশ্বিন এবং কার্তিক শারদ ঋতু , সহঃ সহস্য অগ্রহায়ণ ও পৌষ হেমন্ত ঋতু, তপঃ তপস্য মাঘ ফাল্গুন শিশির ঋতু। 
কেবল মাত্র কৃষ্ণযজুর্বেদ নয়, গোটা বৈদিক সাহিত্য মধু ও মাধব অর্থাৎ চৈত্র বৈশাখ মাসের জয়গানে মুখরিত। 


বেদে এমন মন্ত্রও পাওয়া যায়  যেখানে ছয় ঋতুকে একটি পক্ষীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। 


প্রজাপতিরগ্নিমচিনুতর্ত্তুভিঃ সমবৎসরং বসন্তনৈবোস্য পূর্ব্বা চিনুতগ্রীষ্মেণ দক্ষিণং পক্ষং বর্ষাভিঃ পুচ্ছং শরদোত্তরং পক্ষং হেমন্তন মধ্যং
অর্থাৎ, ঋতুর দ্বারা যেমন বৎসর হয় , সেরূপ প্রজাপতি ঋতুর দ্বারা অগ্নি চয়ন করেছিলেন । ঋতুময় এ যজ্ঞ এ সংকল্প হচ্ছে চয়ন। বসন্ত ঋতু এর শিরোভাগ, গ্রীষ্ম দক্ষিণ পক্ষ , বর্ষা পুচ্ছ ও হেমন্ত মধ্যদেশ। 


এখানে পাঁচটি ঋতুর কথা বলা হলেও বসন্ত ঋতুকে স্থাপন করা হয়েছে শিরোদেশ হিসাবে।যেমন – শতপথ ব্রাহ্মনে শিশির ঋতুকে কল্পনা করা হয়েছে প্রজাপতির মস্তক হিসাবে।
প্রথম পর্বেই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার গীতার একটি শ্লোক উল্লেখ করেছিলাম  , সেটি ছিল : 

বৃহৎ সাম তথা সাম্নাং গায়ত্রীছন্দসামহম।

 মাসানাং মার্গশীর্ষোহহম্তুনাংকুসুমাকরঃ ।।

অর্থঃআমি সামবেদের মধ্যে বৃহৎ সাম,সমস্ত ছন্দের মধ্যে গায়ত্রী,মাস সমুহের মধ্যে অগ্রাহায়ন,এবং ঋতুদের মধ্যে পুষ্প সমরোহময় বসন্ত।

রাজশেখর  বসু মহাশয়ের মতে এই মার্গশীর্ষ হল মাঘ মাস। কিন্তু ম্যাকসমুলার সম্পাদিত ‘স্যাক্রেড বুক অফ ইস্ট ” নামক গ্রন্থমালায় গীতা অনুবাদক কাশীনাথ ত্র‍্য‍ম্বক তেলঙ্গ একটি টীকায় মার্গশীর্ষ বলতে বোঝাতে চেয়েছেন :
Margasirsha is November – December . Madhusudana says this is best month , as being neither too hot nor too cold.
আমরা বুঝতে পারি নভেম্বর ডিসেম্বর অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাস। এক্ষেত্রে তেলঙ্গ ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রসঙ্গকে উল্লেখ করেছেন। 


যাই হোক , বৈষ্ণব সম্প্রদায় মার্গশীর্ষ অর্থাৎ অঘ্রহায়ন মাস থেকে বর্ষ গণনা করে আসছেন আজও। আসলে মৃগশিরা একটি নক্ষত্র । সেই নক্ষত্রের নামানুসারে মার্গশীর্ষ  অর্থাৎ অগ্রহায়ন।মার্গ অর্থাৎ পথ । সেই পথের সবোর্চ্চ শীর্ষে অবস্থান করে মার্গশীর্ষ। অগ্রহায়ণ অর্থাৎ অগ্রে বা আগে। তার সঙ্গে হায়ন অর্থাৎ বৎসর। বৎসরের আগে অবস্থিত প্রথম মাস। 


 ঐতরেয় ব্রাহ্মণে উল্লেখ্য একটি কাহিনী বলি  :

রোহিনীর রূপে প্রজাপতি আসক্ত হয়ে তাঁকে অনুসরণ করলেন। রোহিনী তখন হরিণীর ছদ্মবেশ ধারন করে বনের মধ্যে অন্তর্ধান করলেন। এই অনাচার ও পদস্খলন দেখে দেব্যাগন  এক ভূতবান পুরুষ সৃষ্টি করে প্রজাপতিকে হত্যার আদেশ দিলেন। সেই ভূতবান প্রজাপতিকে তীর বিদ্ধ করলে প্রজাপতি আকাশের বুকে মৃগশিরা নক্ষত্র হয়ে রইলেন। সেই হরিণী রূপী রোহিনী তাঁর পাশে স্থান পেলেন। এত সেই ভূতবান হলেন মৃগব্যাধ বা #কালপুরুষ। 


উক্ত কাহিনী থেকে মহামান্য তিলক মনে করেন , যীশুর জন্মের প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বিষুবন মৃগশিরা নক্ষত্রে ছিল। পরবর্তী সময়ে সেটি সরে যায় রোহিনী নক্ষত্রের দিকে । সেই কারণেই হয়ত মার্গশীর্ষ থেকে পরে বা ভারতের অধিকাংশ স্থানে বৎসর গণনা হয় নি। 


এই প্রসঙ্গে অতিরিক্ত কিছু কৌতূহল আমাদের মনে দানা বাঁধে । ঋক্ এবং যজুর্বেদ একই ভাষার স্তরও কালের অন্তর্ভুক্ত । প্রাচ্যবিদ্যা – বিশারদ পন্ডিত সমাজ ব্যাকরণগত প্রয়োগ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন , খ্রিস্টের জন্মের বহু বহু আগেই – প্রায় বারোশো থেকে হাজার বছর আগে এগুলি রচিত হয়েছিল। 
এই সব গণনা রীতির একটি অন্যতম কারণ ছিল আবহাওয়া। উত্তর পশ্চিম ভারতে শীতের আধিক্য । তাঁরা শীত ঋতুকে প্রায় চার মাস ধরে ভোগ করতেন। অগ্রহায়ণ – পৌষ এবং মাঘ – ফাল্গুন দুটি শীতের মধ্যে কিছু পার্থক্য বর্তমান। তাই শিশির ঋতু হিসাবে চিহ্নিত হয় শেষ দুইটি মাস। আর কুসুমাকর বসন্ত ঋতু থেকে সূচিত হয় নতুন বৎসর। জরা গ্রস্থ ধূসর শীত থেকে মুক্তি মেলে। 


আরো একটি কারণ ছিল অয়ন চলন। এখানেই অয়ন বিষয়টিকে জেনে নেওয়া প্রয়োজন ?  কেন না প্রাচীন বর্ষ গণনা ছিল অয়ন কেন্দ্রিক এবং মাঘ মাস থেকে তার সূচনা হত । সেই রীতিকে মেনে নিয়েছে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ ও সূর্যসিদ্ধান্ত। সে কথা আমি আগেই বিশদে ব্যাখ্যা করেছি। এর পরের পর্বে আমি অয়ন চলন নিয়ে আলোচনা করব।

#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ  ১ . লোকায়ত রাঢ় বঙ্গ       

   ২. বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন ভারত ও সমকালীন অন্যান্য দেশ         

 ৩. ঋগ্বেদ সংহিতা           

৪. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা         

  ৫. বঙ্গাব্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.