দ্বিতীয় অধ্যায় – তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে নববর্ষ

#দ্বিতীয়_অধ্যায়

আমাদের দেশে যাঁরা প্রাচীন অধিবাসী তাঁরা মাঘ মাসের প্রথম দিবস বা ১ লা তারিখে #এখ্যান_যাত্রে।  ঐদিন তাঁরা বিভিন্ন রূপে গ্রামদেবতা বা দেবীর এবং #যাতারা দেবীর পূজা করেন। এই যাতারা দেবী যে দুটি মেয়ের উপর ভর করে সেই মেয়ে দুটি পয়লা মাঘ থেকে শুরু হওয়া নতুন কৃষি বর্ষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অর্থাৎ বৃষ্টি আর ফসল কেমন হবে , মানুষ এবং গবাদিপশু সুস্থ থাকবে কি না – তার আগাম ভাষ রাখেন । 

এই এখ্যান যাত্রাকে কেউ কেউ আখিয়ান যাত্রাও বলেন। যাত্রা অর্থে গমন , বলাবাহুল্য, দিবসের আঁখি সূর্যের গমন। সাধারণ মানুষের চোখ  সূর্যকে দিবস , আলোক রূপে কল্পনা করে থাকেন। 
খুব সহজ ভাষায় , সূর্যের অয়ন চলন। সূর্যপথকর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়ায় পৃথিবীর সৌরপাদ বিন্দু কর্কটক্রান্তি অতিক্রম করে যেমন অধিক উত্তরে যেতে পারে না তেমনি মকরক্রান্তি অতিক্রম করে অধিক দক্ষিণে যেতে পারে না। নিরক্ষরেখার উত্তরে কর্কটক্রান্তিতে এবং নিরক্ষরেখা দক্ষিণে মকরক্রান্তিতে সৌরপাদ বিন্দুর গমনের ঘটনাই অয়নান্ত। অর্থাৎ পৃথিবীর উপর দিয়ে সূর্যের ভ্রমণকালে পৃথিবীর ভৌগলিক নিরক্ষরেখা থেকে সর্বাধিক উত্তর ও দক্ষিণে সূর্যের গমনই অয়নান্ত। প্রতি বছর দুটি অয়নান্ত সংঘটিত হয়; জুন মাসে উত্তর অয়নান্ত এবং ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ অয়নান্ত। সঙ্গত কারণেই উত্তর অয়নান্ত হল উত্তরায়ন সংক্রান্তি বা কর্কট সংক্রান্তি এবং দক্ষিণ অয়নান্ত হল দক্ষিণায়ন সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। তবে বর্তমানে কর্কট সংক্রান্তি ও মকর সংক্রান্তি পালনের দিন প্রায় তিন সপ্তাহেরও বেশি পিছিয়ে পড়ার কারণ হল বাংলা পঞ্জিকার ঐতিহ্যগত ত্রুটি। তা যাই হোক, একটি বছরের ঋতুসমূহ পৃথিবীর অয়নান্ত ও বিষুব উভয়ের সাপেক্ষে তথা সৌরপাদ বিন্দুর অবস্থানের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়ে থাকে।

  মহাভারতের ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী গঙ্গা পুত্র দেবব্রত ভীষ্ম শর শয্যায় শায়িত বলেছিলেন – 
 ” উত্তরায়ণের আরম্ভ পর্যন্ত আমি এই শয্যায় শুয়ে থাকবো। সূর্য যখন উত্তর দিকে গিয়ে সর্বলোক প্ৰতপ্ত করবেন তখন আমার প্রিয় সুহৃৎ তুল্য প্রাণ ত্যাগ করব। “প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ শেষ হলে-যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভ করে অভিষিক্তহলেন। এই সময় কৃষ্ণেরপরামর্শে যুধিষ্ঠির শরশয্যায় শায়িতভীষ্মের কাছে আসেন।সেখানে কৃষ্ণের অনুরোধে ভীষ্মযুধিষ্ঠিরকে বিবিধ পরামর্শ দেন।শরশয্যায় মোট আটান্ন দিন থাকার পরভীষ্ম মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষেরঅষ্টমী তিথিতে যোগযুক্তহয়ে ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেন। এই দিনেরস্মরণে আমরা ভীষ্ম-তর্পণকরে থাকি ।


পিতামহ ভীষ্ম যে অয়ন চলনের কথা বলেন ” বেদাঙ্গ জ্যোতিষ ” গ্রন্থেও সেই অয়নের কথা বলা আছে । “বেদাঙ্গ জ্যোতিষ ” রচনার কালেও মাঘ মাস থেকে যুগের গণনা শুরু হতো।

 মহর্ষি লগধ প্রণীত যে জ্যোতিষ গ্রন্থটি পাওয়া যায়, সেখানে ঋগ্বেদীয় পাঠে ছত্তিরিশটি এবং যজুর্বেদীয় পাঠে তেতাল্লিশটি সিদ্ধান্ত শ্লোক বর্তমান। কিন্তু টি এস কুপান্না শাস্ত্রী (১৯৮৪ ) মহাশয়ের অনুবাদ এবং মূল রচনায় আমরা দেখি যজুর্বেদাঙ্গ জ্যোতিষের তেতাল্লিশটি শ্লোকের মধ্যে তিরিশটি ঋগ্বেদীয় জ্যোতিষের সিদ্ধান্ত শ্লোকের অবিকল অনুলিপি মাত্র। 


তবুও  আকর  হিসাবে যে সকল শ্লোক পাওয়া যায় তার মধ্যে  ঋগ্বেদীয় জ্যোতিষের পঞ্চম এবং যজুর্বেদীয় জ্যোতিষের ষষ্ঠ শ্লোকের অর্থ :

ধনিষ্ঠানক্ষত্রে চন্দ্রসূর্য অবস্থান করলে মাঘমাস, তপঃঋতু, শুক্লপক্ষে উত্তরায়ণ সূচনা এবং যুগের শুরু হয় ।

ঋগ্বেদীয় জ্যোতিষী ষষ্ঠ এবং যজুর্বেদ জ্যোতিষে  সপ্তম শ্লোকে বলা হয়েছেঃ 

ধনিষ্ঠা থেকে উত্তর দিকে এগিয়ে চন্দ্র সূর্য যখন অশ্লেষা নক্ষত্রে এক হবে তখন ঘটবে দক্ষিণায়ন এবং সেই মাসটি বলা বাহুল্য-  শ্রাবণ । সুতরাং, মহাভারতে পিতামহ ভীষ্ম যে কথাগুলি বলেন, বেদাঙ্গ জ্যোতিষ অয়ন সম্পর্কিত  তথ্য দিয়ে তার প্রমাণ রাখে।


 মাঘ মাসের যুগের সূচনা বা শুরু । এই কথাও ঋগ্বেদীয় জ্যোতিষ গ্রন্থে ঘোষিত হয়েছে পৃথকভাবে –

মাঘাশুক্লাপ্রাপান্নাসায়া পৌয়াকৃষ্ণাসমাপিনাঃ।

যুগস্যা পঞ্চাবর্ষায়া কালজনানাম প্রকাশতে।।


অর্থাৎ পাঁচ বছরের একটি যুগের সূচনা হতো মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে এবং এবং সমাপ্তি হতো পৌষ মাসের কৃষ্ণপক্ষে।  জৈন সাধু ভদ্রবাহু অনেক কাল পরে #সূর্যপ্রজ্ঞপ্তি রচনা করেছিলেন।সেই গ্রন্থেও পাঁচ বৎসরকে যুগের পরিবর্তে উল্লেখ করতে দেখা যায়।আসলে পাঁচ বৎসর যুগগণনার এক মাত্র কারণ, প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর কুম্ভরাশির অন্তর্গত ধনিষ্ঠা নক্ষত্রে চন্দ্র ও সূর্যের মিলন ঘটে। এই টুকুই পাঁচ বছরের যুগ গণনার ভিত্তি। 

 অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা এ প্রসঙ্গে আসে : প্রাচীন ঋষিগণ আকাশে চন্দ্র ও সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে খুঁজে পেয়েছিলেন , প্রতি পাঁচ বছর অন্তর , কুম্ভরাশির অন্তর্গত ধনিষ্ঠা নক্ষত্রে উভয়ের মিলন হয়। চন্দ্র সূর্যের এই মিলন বলা বাহুল্য যুগ গণনার মূল কারণ। প্রতি পাঁচ বছরে ফাল্গুন মাসের অমাবস্যার দিন এই মিলন ঘটে।

অবশ্য  ১২ বছরের যুগও আছে বা ছিল। এই যুগ বৃহস্পতির নামে চিহ্নিত। সূর্য যে রাশি চক্রকে এক বছরে অতিক্রম করে সেখানে বৃহস্পতি একেকটি রাশিকে অতিক্রম করতে এক বছর সময় নেয় । ১২ টি রাশি অতিক্রম করতে ১২ বছর লাগে। ১২ বছর পরে কুম্ভ রাশিতে বৃহস্পতি উপস্থিত হলে তখন হয়  #বার্হস্পত্য যুগ । সম্পূর্ণ হয় তখনই আমাদের দেশে কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয় ।প্রতি ১২ বছর অন্তর এই মেলার অনুষ্ঠান ।


আবার রাশি গুলিকে পাঁচবার অতিক্রম করতে বৃহস্পতির সময় লাগে ৬০ বছর।  এজন্য ৬০ বছরে  বার্হস্পত্য  যুগের বিচার হয়ে থাকে। 


 আলবেরুনী সহজ ভাবে লিখেছিলেন :
 বৃহস্পতির সৌর দল থেকে আরম্ভ করে সূর্য এবং বৃহস্পতির আবর্তনের ভিত্তিতে বর্ষের  যে যুগাবর্ তাকেই বলা হয় #সংবৎসর । এক পূর্ণ আবর্তনের সময়কাল  ষাট বর্ষ বলে সংবৎসরকে বলা হয় #ষষ্টাব্দ । এই যুগাবর্তের সূচনা হয় মাঘ মাসের প্রথম দিকে বহিষ্ঠা কক্ষে বৃহস্পতির সূর্য থেকে। 


 পাঁচ বছরের সমন্বয়ে একটি যুগ। পাঁচটি বছরের কথা বলা হলেও #শুক্লযজুর্বেদ আমাদের জানায় চারিটি বৎসরের নাম। পরবর্তী কালে রচিত শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে পাঁচটি বৎসরের নাম এরকম : সংবৎসর, পরিবৎসর, ইদাবৎসর, ইৎবৎসর, অনুবৎসর। 


যুগের সূচনা হত মাঘ মাস  থেকে সেই কথা মহর্ষি লগধ জানিয়েছেন। অনুরূপ শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে আছে :
 This Agni is Pragapati , and Pragapati is the year : the fifth layer is his head and dewy season is it’s head.

Dewy season অর্থাৎ শিশির ঋতু। এই ঋতু যথাক্রমে  মাঘ ও ফাল্গুন মাস। বৈদিক নাম হল তপঃ ও তপস্য। এই মাস দুটি প্রজাপতি অর্থাৎ প্রভুর মস্তক । আমাদের উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না , শিশির ঋতুর মাঘ মাস থেকে যেমন যুগের শুরু তেমনি বৎসরেরও সূচনা। 

বরাহমিহির লিখেছিলেন #পঞ্চসিদ্ধান্তিকা । ওই গ্রন্থে তিনি পূর্বে প্রচলিত পাঁচটি তিনি পূর্বে প্রচলিত পাঁচটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনায় #সূর্যসিদ্ধান্তকে শ্রেষ্ঠ মর্যাদা দেন। বরাহমিহির এরও অনেকেই পরে #সূর্যসিদ্ধান্ত নামক একটি পৃথক গ্রন্থ রচিত হয়ে। কিন্তু কে রচয়িতা জানা যায় না।প্রাচ্য তত্ত্ব বিশারদ পন্ডিত ই. বার্জেস মনে করেন , ৪৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে  ১০৯১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো একসময় উক্ত গ্রন্থটি পূর্নতা পায়। একে সকলেই আধুনিক সূর্য সিদ্ধান্ত মনে করেন। গ্রন্থটির চতুর্দশ অধ্যায়ের সপ্তম থেকে দশম অবধি সিদ্ধান্ত শ্লোকগুলিতে সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।


অর্থাৎ , খুব পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে বহু পূর্ব থেকেই ঋতুগুলি নির্ণয় করতে পেরেছিলেন প্রাচীন মুনি ঋষি এবং বনবাসীগন। তাঁরা শিশির ঋতু অর্থাৎ মাঘ মাস থেকেই গণনা করতেন যুগ বা বৎসর। মাঘ ও ফাল্গুন তাঁদের শীতকাল। চৈত্র বৈশাখ ছিল বসন্ত কাল ।জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় গ্রীষ্ম কাল।শ্রাবণ ভাদ্র বর্ষা কাল। আশ্বিন কার্তিক শরৎ এবং অগ্রহায়ণ পৌষ যথাক্রমে হেমন্ত কাল। 

#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ  ১ . লোকায়ত রাঢ় বঙ্গ   

       ২. বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন ভারত ও সমকালীন অন্যান্য দেশ   

       ৩. ঋগ্বেদ সংহিতা       

    ৪. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা         

  ৫. বঙ্গাব্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.