সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী যে দেশে শতকরা ৮০ জন হিন্দু, সেই সনাতনী ভারতে গণপিটুনিতে গেরুয়া বসনধারী সন্ন্যাসী হত্যা! তাও পুলিশের সামনে! এলাকার জনচরিত্র দেখে অনেকের ধারণা হয়েছে এই ঘটনার পিছনে খ্রিস্টানদের হাত আছে। এলাকার রাজনৈতিক বিন্যাস দেখে অনেকে এই ঘটনার পিছনে কমিউনিস্টদের যোগসূত্র খুঁজছেন। অনেকে আবার বলছেন, যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেই গ্রাম পঞ্চায়েত বিজেপির দখলে। কিন্তু এখনও সত্য অপ্রকাশিত। এখানে বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়, ঘটনা ঘটলো ১৬ এপ্রিল রাত ১১-৩০ মিনিট নাগাদ। থানায় জেনারেল ডায়েরি হলো ১৭ এপ্রিল রাত ১০- ৫৮ মিনিটে ! এফআইআর হলো ১৮ এপ্রিল। তিনদিন পরে সেই ঘটনার মিডিয়া কভারেজ শুরু! ঘটনার পাঁচদিন পরে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বয়ান এলো! এখানে কয়েকটা তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো যেগুলো থেকে কয়েকটা সম্ভাবনা সকলের সামনে হয়তো স্পষ্ট হবে।
প্রথমত, দেখা যাক ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছিল সেইরাতে। ৭০ বছরের মহন্ত কল্পবৃক্ষ গিরি এবং ৩৫ বছরের সুশীলগিরি মহারাজ নামের দুই সন্ন্যাসী কাভিলির এক আশ্রমে থাকতেন। তারা সুরাটে এক অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দেবেন বলে সেখানে যাবার মনস্থ করেন। দুজনে নীলেশ ইয়ালগাডে (৩০) নামের একজন গাড়িচালকের কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া করে কাণ্ডিভালি থেকে সুরাটের উদ্দেশে রওনা দেন। রাস্তায় যাতে আটকে পড়তে না হয় তার জন্য তারা মুম্বই-গুজরাট হাইওয়ের বদলে পালঘর জেলার পিছন দিকের রাস্তা নেন। গড়চিঞ্চলে গ্রামের কাছে বনবিভাগের পাহারাদার তাদের রাস্তা আটকায়। তারা যখন পাহারাদারের সঙ্গে কথা বলছিলেন সেই সময়ে একটি দল তাদের উপর হামলা করে। গত কয়েকদিন ধরে স্থানীয় গ্রামবাসীরা নজরদার বাহিনী তৈরি করেছিলেন। সেখানে গুজব রটেছিল মানবদেহের অংশ পাচারকারী ও ছেলেধরারা রাতে ওই এলাকায় সক্রিয় হয়। এর আগে ডক্টর বিশ্বাস ভালভি ও তাঁর দল বনবাসী অধ্যুষিত সারণি গ্রামে জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে যাবার সময়ে হামলার মুখে পড়েন। তাদের উদ্ধার করতে যাওয়া পুলিশবাহিনীর উপর পাথর ছোঁড়া হয়। এ ঘটনা ঘটে কাসা থানার এলাকায়, যেখানে এই গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। দিন দশেক আগে দাদরা ও নগর হাভেলি যাবার সময়ে এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে এক পুলিশ বাহিনীও স্থানীয় মানুষের হামলার মুখে পড়েছিল এই এলাকায়। দেখা যাচ্ছে গুজব রটিয়ে গণপিটুনির একটা ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। সাধারণত কোনও এলাকাকে স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে একটা মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এই ধরনের গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়। প্রশ্ন হলো, কারা এই এলাকাকে মুক্তাঞ্চলে পরিণত করতে চাইছে? কেনই বা চাইছে?
আসুন, এলাকা সম্পর্কে আরও কয়েকটি তথ্য নিয়ে আলোচনা করি। পরিসংখ্যান বলছে বেশ ভালো সংখ্যায় মিশনারি চার্চ এখানে সক্রিয় আছে। খ্রিস্টান মিশনারিদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা কাস্টকারী নামক একটি এনজিও-র। প্রধান সিরাজ বালসারা নামে এক মহিলা গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের আইনি। সহায়তা দিচ্ছেন। এই সিরাজ বালসারার স্বামী প্রদীপ দেশভক্ত প্রভুর নাম ছিল পিটার ডি মিলো। তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান পাদরি। পরে তিনি নাম পরিবর্তন করেন। আরও খবর, অভিযুক্তদের আইনজীবীও পালঘরের চার্চের সঙ্গে সম্পর্কিত। পালঘর জেলা হলো উত্তর পশ্চিম মহারাষ্ট্রের একটি জেলা যা দক্ষিণ গুজরাটের সুরাটের পাশের জেলা। মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের এই পুরো এলাকাটা বনবাসী অধ্যুষিত এলাকা এবং এই এলাকায় বহুদিন ধরেই খ্রিস্টান মিশনারি ও চার্চ গুলি ধর্মান্তরকরণের কাজে লেগে আছে। স্বামী অসীমানন্দজী গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারিরা কার্যত বিনা বাধায় তাদের ধর্মান্তরকরণের কাজ চালাতে থাকে। পরিণামে রাজনৈতিক বিন্যাসেরও পরিবর্তন হতে থাকে এলাকায়। মোটের উপর ভিডিয়ো দেখে যা বোঝা গেছে তা হলো এই মব লিংচিঙের পিছনে একটা বড়ো মোটিভ ছিল প্রচণ্ড রকমের গেরুয়া বিদ্বেষ।
পাশাপাশি এই অভিযোগও উঠেছে যে ,স্থানীয় সিপিএম বিধানসভা সদস্য কমরেড বিনোদ নিকোলাই এই ঘটনার পেছনের আসল মাথা। প্রসঙ্গত, এখানে ২০১৪-র নির্বাচন বাদ দিলে প্রায় দু’দশক ধরে স্থানীয় বিধানসভাটি সিপিএমের দখলে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড খ্রিস্টান মিশনারি এবং এদের মতদদাতা সোনিয়া গ্যাং, কমিউনিস্ট এবং অতিবাম গোষ্ঠীর সম্মিলিত ষড়যন্ত্রে সৃষ্টি হওয়া চূড়ান্ত হিন্দু বিদ্বেষেরই পরিণাম।
সন্ন্যাসীদের পিটিয়ে মারার প্রসঙ্গে ১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল কলকাতার বিজন সেতুর সেই কুখ্যাত ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। সেদিন আনন্দমার্গের ১৬ জন সন্ন্যাসী এবং একজন সন্ন্যাসিনীকে একইরকম ভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছিল পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্টরা। আধমরা দেহগুলোকে পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দিতেও এদের হাত কেঁপে ওঠেনি সেদিন। পালঘরের সন্ন্যাসী হত্যার ধরনও সেই একই রকম। কী অদ্ভুত মিল দুটো ঘটনার মধ্যে ! একই রকম ‘ছেলেধরা’ গুজব ছড়িয়ে দেওয়া, একইরকম গেরুয়া বিদ্বেষের মোটিভ। এখানেও তখন সিপিএমের এমএলএ। নাম শচিন সেন। ওখানেও এখন সিপিএমের এমএলএ। নাম বিনোদ নিকোলাই। তবে বিজন সেতুকাণ্ডে একজনও গ্রেপ্তার হয়নি আজ পর্যন্ত, যেখানে পালঘর কেসে ১১০ জনকে কমপক্ষে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিজন সেতুতে সন্ন্যাসীদের হত্যার বিরোধিতায় সেদিন রাস্তায় নেমেছিলেন এই বঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা, যেটা পালঘরের ক্ষেত্রে দেখা গেল না। হয়তো তখনও বুদ্ধিজীবীদের মেরুদণ্ড কিছুটা হলেও অবশিষ্ট ছিল যেটা আজ সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয়েছে।
আশার কথা, সনাতনী ভারতীয় সমাজ মেরুদণ্ডহীন হয়ে যায়নি। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। লকডাউন না থাকলে হয়তো এই প্রতিবাদের ঢেউ সুনামি হয়ে আছড়ে পড়তো রাজপথে।
দেবতনু ভট্টাচার্য
(লেখক হিন্দু সংহতির সভাপতি)