দ্বিতীয় পর্যায়
নানা কারণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের সমঝোতায় চিড় ধরে। প্রায় সাড়ে তিন বছর বাদে কেন্দ্রীয় পরিষেবায় চলে যান সঞ্জয়বাবু।
পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োজনের তুলনায় আইএএসের সংখ্যা কম। তাই কেন্দ্র আগে নানা সময়ে রাজ্যের কাছে আমলা চেয়ে পাঠালেও আপত্তি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নের একটি সূত্রের বক্তব্য, সঞ্জয়বাবুর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্ক অম্লমধুর হওয়ায় দিল্লি যেতে চাইলে তাঁকে বাধা দেননি মমতা। ২০১৬-র ১ জানুয়ারি সড়ক পরিবহণ সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন সঞ্জয়বাবু। সেই কাজে সাফল্যই তাঁর নয়া পদপ্রাপ্তির নেপথ্য কারণ বলে মনে করেন অনেকে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর স্বপ্ন ছিল প্রতিদিন ৩০ কিমি রাস্তা তৈরি। তা বাস্তবে করে দেখান সঞ্জয়বাবু। ২০১৭ সালের ২৪ মে দু-বছরের মেয়াদের জন্য তিনি প্রতিরক্ষা সচিব পদে যোগ দেন। মন্ত্রিসভার নিয়োগ কমিটি তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। নির্দেশিকা অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৩ অগস্ট পর্যন্ত তিনি ওই পদেই ছিলেন।
সঞ্জয় মিত্রের আগেই রাজ্যের আর এক গুরুত্বপূর্ণ আমলার ওপর অখুশি হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি হলেন রাজ্যের পরিবহণ দফতরের প্রধান সচিব সুব্রত গুপ্ত। দীর্ঘ সমীক্ষার পর শুরু হয়েছিল সল্ট লেক সেক্টর ফাইভ থেকে হাওড়া পর্যন্ত ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প। পদ্ধতি মেনে কেন্দ্রীয় সহায়তায় প্রকল্প রূপায়ণের কাজও শুরু হয়। বৌবাজারের ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৃণমূলের প্রভাব ছিল। ওই বিধানসভায় তৃণমূলকে জেতানোর ব্যাপারে ওই অংশের ব্যবসায়ীদের অবদান স্বীকার করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই ব্যবসায়ীরা দাবি করলেন, প্রকল্পের পথ বদলাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীও সেই দাবিকে মান্যতা দিয়ে চিঠি দিলেন রেলমন্ত্রকে।
এটা ২০১২-র জুন মাসের কথা। এমনিতেই নানা কারণে ওই প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়সূচি থেকে পিছিয়ে গিয়েছিল ৬০০ দিন। নয়া নকশার দাবিতে কাজ আটকে গেল। দিল্লি থেকে বোঝানো হল নকশা বদল মানে ১.৭ কিলোমিটার বাড়তি নির্মাণ, ৪ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ এবং অনেকটা বাড়তি সময়। পরিবহণ সচিব হিসাবে কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করছিলেন সুব্রত গুপ্ত। তিনি নয়া মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করলেন। মুখ্যমন্ত্রী রাজি হলেন না, উল্টে রুষ্ট হলেন সুব্রতবাবুর ওপর। শেষ পর্যন্ত গোঁ ধরে বসে থাকলেন মুখ্যমন্ত্রী। ’১২-র অক্টোবরে তিনি পরিবহণ সচিব হিসাবে নিয়ে আসেন বিপি গোপালিকাকে। সুব্রতবাবু রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন কেন্দ্রীয় পরিষেবায়। জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান হিসাবে। এবং, ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর জন্য খরচ হল অনেক বেশি অর্থ ও সময়। ওই নকশা বদল না করলে অনেক আগে শেষ হয়ে যেত প্রকল্পটি।
প্রসঙ্গত, উন্নত প্রশাসনে রাজনীতিকদের হস্তক্ষেপের প্রবণতা বরাবরই কম হয়। বাম আমলে আইএএস অ্যাসোসিয়েশনের গুরুত্ব রাজ্যের শাসক দল স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সিপিএম নেতা প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় কলকাতা পুরসভার মেয়র হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে পুরসভার কমিশনার অসীম বর্মণের ব্যক্তিত্বের সংঘাত শুরু হয়। অসীমবাবু মেয়রের ‘দূর্ব্যবহারের’ অভিযোগ করেন আইএএস অ্যাসোসিয়েশনে। সংগঠনের তরফে অভিযোগ করা হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। এর পর আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয় প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়কে। অর্থাৎ প্রাধান্য পেত আমলার অধিকারের প্রশ্ন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের বরিষ্ঠ সাংবাদিক হিসাবে দীর্ঘদিন প্রশাসনের খবরের জন্য মহাকরণে গিয়েছেন সব্যসাচী বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রসঙ্গে তিনি জানান, প্রধান সচিব থাকাকালীন কল্যাণী চৌধুরী একবার কড়া প্রতিবাদ করেছিলেন পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামীর। সমবায়সচিব থাকাকালীন নীহাররঞ্জন ব্যানার্জী একবার বিভাগীয় মন্ত্রীর সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হন। মহাকরণেই নিজের ঘরে নীহারবাবু সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দাগেন। পরক্ষণেই মন্ত্রীও সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সচিব অর্থাৎ ওই বরিষ্ঠ আমলার বিরুদ্ধে তোপ দাগেন। অস্বস্তিকর ওই পরিস্থিতির সামাল দিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। বুদ্ধবাবুর সহযোগিতায় নীহারবাবু কলকাতায় একটি কেন্দ্রীয় সংস্থায় চেয়ারম্যানের পদে যোগ দেন। তারও আগে বুদ্ধবাবু স্বরাষ্ট্র দফতরের দায়িত্বে থাকাকালীন মহাকরণে তাঁর ঘরে এক আমলার মুখে ফাইল ছুঁড়ে মেরেছিলেন। ওই আমলা অভিযোগ করেন খোদ মুখ্যসচিবকে। মুখ্যসচিবের কাছে বিষয়টি শুনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সতর্ক করে দেন বুদ্ধবাবুকে। তৃণমূল আমলে কোনও আমলা মন্ত্রীর বিরুদ্ধাচারণ তো দূরের কথা, প্রকাশ্যে মন্তব্যও করার সাহস পান না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার কিছুকালের মধ্যেই আইএএস অ্যাসোসিয়েশনকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার কথা লিখেছি আগের সংখ্যার শেষ লাইনে। বস্তুত এই প্রতিবেদক দীর্ঘদিন বাম আমলে মহাকরণ যাওয়ার সুবাদে দেখেছেন, নামী সংস্থার সাংবাদিকরা আমলাদের কাছে পৌঁছোতে পারতেন। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর সেরকম নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দায়িত্ব নেওয়ার কিছুকাল পর থেকেই সংবাদ সংগ্রহের ওপর জারি হতে লাগল অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। আমলারাও নিজেদের স্বার্থে প্রচারমাধ্যম থেকে গুটিয়ে নিতে লাগলেন নিজেদের।
২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর রাজ্যের মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মুখ্যসচিব পদে সঞ্জয় মিত্রের স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর আগে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব পদে ছিলেন বাসুদেববাবু। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— উভয়ের খুব পছন্দের আমলা ছিলেন। জেলায় জেলায় প্রতি প্রশাসনিক বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
২০১৬-র বিধানসভা ভোটের প্রচার-সভায় আসানসোলকে আলাদা জেলা করার প্রতিশ্রতি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আচরণবিধি ভেঙেছেন — এই যুক্তিতে তাঁকে শো-কজ করে কমিশন। কিন্তু মমতার নির্দেশে সেই চিঠির জবাব দেন মুখ্যসচিব বাসুদেববাবু। তাতে তিনি জানান, ডিসেম্বরে মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী আচরণবিধি ভাঙেননি। বাসুদেববাবু ওই চিঠিতে লেখেন, কমিশনের উচিত শো-কজ করার আগে ভাল করে সব দিক খতিয়ে দেখা।
’১৬-র ভোটের মুখে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে সরিয়ে দেয় কমিশন। এর পরে কমিশনকে একটি চিঠি পাঠান মুখ্যসচিব। এই ধরনের পদক্ষেপে বাহিনীর মনোবল ভেঙে যেতে পারে বলে ওই চিঠিতে জানান মুখ্যসচিব। এর পরে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে রাজ্যের দায় থাকবে না বলেও জানান তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে মুখ্যসচিবের জবাব দেওয়া নিয়ে সরব হয় বিরোধী দলগুলি। কমিশনের কাছে বাসুদেববাবুকে শাস্তি দেওয়ার দাবিও জানানো হয়।
এর পরেই কমিশন মমতার বাড়িতে ফের শোকজের চিঠি পাঠিয়ে তাঁকেই জবাব দিতে বলে। জানিয়ে দেয় মুখ্যমন্ত্রী নয়, চিঠি পাঠানো হয়েছে তৃণমূলের চেয়ারপার্সনকে। একই সঙ্গে মুখ্যসচিবকে দু’টি চিঠি পাঠায় কমিশন। একটিতে বলা হয়, মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো ওই চিঠির জবাব মুখ্যসচিব দিতে পারেন না। কমিশন সম্পর্কে কড়া শব্দ ব্যবহার করাটাও যে নির্বাচন সদন ভাল চোখে দেখছে না তাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় চিঠিতে রাজীব কুমারের অপসারণ নিয়ে তাঁর মন্তব্যের জন্য বাসুদেববাবুকে ভৎর্সনা করে কমিশন। নির্বাচন সদনের পক্ষে জানানো হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সব সময়েই রাজ্যের দায়। ভোটের কিছুকাল বাদে, ২০১৭-তে তিনি অবসর নেন।
২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয় নিয়ে আসেন মুখ্যমন্ত্রী। এর পর প্রথম বড় রদবদল হয় ২০১৭-র ১ জুলাই। রাজ্যের নতুন স্বরাষ্ট্রসচিব হন অত্রি ভট্টাচার্য। ওই দিনই মুখ্যসচিব হিসেবে মেয়াদ শেষ হয় বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর জায়গায় নতুন মুখ্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন ১৯৮৫ ব্যাচের আইএএস, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে।
চলবে..
হিন্দুস্থান সমাচার
অশোক সেনগুপ্ত