নীতি প্রণয়ন করেন রাজনীতিকরা। উন্নত গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় তার রূপায়ণের মূল দায়িত্ব আমলাদের। বুদ্ধবাবুর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর তৈরি হল ভিন্ন ঘরানার আমলাতন্ত্র। নিত্য মহাকরণে যাওয়ার সুবাদে সংবাদ সংগ্রহের সূত্রে কাছ থেকে দেখার কিছুটা সুযোগ হয়েছে। আরও একটা নতুন সরকার তৈরি হতে চলেছে। তার প্রাক্কালে আট কিস্তিতে এই ধারাবাহিক পর্যালোচনা। উপলব্ধি, তথ্য ও প্রতিক্রিয়া সহযোগে। শব্দসংখ্যা প্রায় ৫,৫০০।
— অশোক সেনগুপ্ত।
প্রথম পর্যায়
কলকাতা, ২০ এপ্রিল (হি. স.) : গুড গভর্নেন্স বা উত্তম প্রশাসন যে কোনও সরকারের সাফল্যের চাবিকাঠি।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এদিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে টিঁকে গিয়েছে আমলাদের সঙ্গে তাঁর আস্থার পারস্পরিক সম্পর্ক। কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে ছন্দপতন। অনেক কিছুর মত বদলে গিয়েছে তাঁর আমলারাজও। কিন্তু গত এক দশকে কীরকম ছিল তাঁর প্রশাসনের শীর্ষতম স্তর? ২০২১-এ কী করছেন ২০১৬-র মমতার আস্থাভাজন আমলা-একাদশ? তার ওপর আলোকপাত এই ধারাবাহিকে।
বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের জন্য রাজ্যগুলোয় আইএএসের নির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকে। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাটা ৩৭৯। এর মধ্যে এখন আছেন ৩০৭ জন। আইএএস অফিসারদের নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ঠান্ডা লড়াই রয়েছে। এ রাজ্যে আইপিএস ও আইএএস অফিসারের সংখ্যা কম। তাই কেন্দ্র চাইলেও আমলাদের কেন্দ্র পায় না। নিয়ম অনুযায়ী কোনও আইএএস বা আইপিএসকে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে ডেকে নিতে পারে কেন্দ্র। তবে সেক্ষেত্রে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজ্য সরকার না চাইলে সাধারণভাবে ডেপুটেশনে তাদের নেওয়া হয় না। এতে আদতে পশ্চিমবঙ্গেরই ক্ষতি হচ্ছে বলে প্রশাসন মহলের অভিজ্ঞদের অনুমান।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে আসা ২০১৩ ব্যাচের ১২ জন আইএএস অফিসারকে গত ফেফ্রুয়ারি মাসে ‘ফিল্ড পোস্টিং’ দেয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। নবান্নের একটি সূত্রের অভিযোগ, ওই জুনিয়র আমলাদের মগজ ধোলাই করেছে দিল্লি। অপর সূত্রের মতে, বিধানসভা ভোটের আগে যাঁদের ‘ফিল্ড পোস্টিং’ দেওয়া হবে, তাঁদের মূলত ভোটের কাজই করতে হবে। নতুন অফিসাররা একেবারেই অভিজ্ঞ নন। বিশেষ করে ভোট করানোর অভিজ্ঞতা তো তাঁদের একেবারেই নেই। এই অবস্থায় তাঁদের বিভিন্ন মহকুমার দায়িত্বে পাঠিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তার চেয়ে ওই সব জায়গায় অভিজ্ঞ অফিসারদের পাঠানোর সিদ্ধান্তই সঠিক।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন রেলমন্ত্রী। ১৯৯৯ সালে মমতা রেলমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তাঁর নেকনজরে ছিলেন ওই মন্ত্রকের আধিকারিক গৌতম সান্যাল। এখনও অটুট রয়েছে তাঁদের সেই আস্থার সম্পর্ক। সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং ইউকে-র এমবিএ গৌতমবাবুর জন্ম ১৯৫১-তে। ২০০৯ থেকে ’১১ ছিলেন রেলমন্ত্রীর ওএসডি। সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট সার্ভিসের এই অফিসার অবসরের পর ’১১-তে হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সচিব।
মমতা চেয়েছিলেন সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েটের এই আমলাকে তাঁর প্রধান সচিব, কার্যত মুখ্যসচিবের সমতুল করতে। আপত্তি জানান পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যসচিব সমর ঘোষ এবং আইএএস অ্যাসোসিয়েশন। সমরবাবু বলেন, পরিষেবা আইন মেনে তা করা যায় না। সমরবাবুর আপত্তি এবং যুক্তিকে মান্যতা দিতে বাধ্য হন মুখ্যমন্ত্রী। গৌতমবাবুকে মুখ্যমন্ত্রীর সচিব পদে নিয়োগ করা হয়।
২০১৫-র ২৭ জুন নবান্ন-র প্রশাসনিক বৈঠকে প্রধান সচিব করা হয় গৌতমবাবুকে। ঠিক হয়, পদোন্নতি হলেও গৌতমবাবুর বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে আগের মতোই থাকবে। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতি এড়িয়ে যে-ভাবে এবং যে-দ্রুততায় ওই পদোন্নতি দেওয়া হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নবান্নের খবর, পদোন্নতির প্রস্তাব থেকে আদেশনামা জারি করা পর্যন্ত গোটা পর্বটি সারা হয় মাত্র তিন ঘণ্টায়! কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের তরফে পদোন্নতির আদেশনামা দ্রুততার সঙ্গে গৌতমবাবুর হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। ২০১৮-তে ইন্ডিয়া টুডে ‘টপ টেন হিডন করিডর পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’ তালিকায় স্থান দেয় গৌতম সান্যালকে।
পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে অমিক কিরণ দেব মুখ্যসচিব পদে সবচেয়ে বেশিদিন ছিলেন— সাড়ে তিন বছর। এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার সময় মুখ্যসচিব ছিলেন ১৯৭৭ ব্যাচের আইএএস অফিসার সমর ঘোষ। ১৭ বছর তিনি অর্থসচিব থাকার পর মুখ্যসচিব হন। আইননিষ্ঠ সমরবাবু একাধিক ক্ষেত্রে রাজ্যের বিভিন্ন ভাবনার রূপায়ণে বাধা দিয়েছিলেন। এর অন্যতম ছিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের রাজ্যের কর্মীদের ডিএ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত।
২০১১-তে পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের খোলনলচে বদলে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিশেষ সচিব সৈয়দ নাসিরুদ্দিন, যুগ্ম সচিব ডিপি ব্যানার্জী— এই দুই আমলাকে সরিয়ে দেন। নিয়ে আসেন শান্তনু বসুকে। ওই নবীন আমলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন ছিলেন প্রাইভেট সেক্রেটারি। বামেদের অত্যন্ত আস্থাভাজন মুখ্যসচিব সমর ঘোষকে কোনঠাসা করার চেষ্টা করেননি নয়া মুখ্যমন্ত্রী। সমরবাবুর অবসরের সময় হয়ে এসেছিল। এক্সটেনশনের পর ক্যাবিনেট সেক্রেটারির মর্যাদা দিয়ে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষে রেখে দিতে আগ্রহী হন।
রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ আমলাদের আবশ্যিকভাবে কর্মরত আইএএস হতে হয়। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী বৈমানিক শশাঙ্ক শেখর সিংকে ক্যাবিনেট সেক্রেটারির পদে নিয়োগ করেছিলেন। এটা নিয়ে ওই রাজ্যের আমলা মহলে প্রবল অসন্তোষ হয়। এর পর অখিলেশ যাদব ক্ষমতায় এসে সার্ভিস ম্যানুয়েল বদল করেন। পশ্চিমবঙ্গে সে সময়ে সেই ‘উত্তরপ্রদেশ মডেল’ অনুসরণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১২-র ৩০ সেপ্টেম্বর মুখ্যসচিব পদ থেকে অবসর নেন সমরবাবু। তার পরেও সমরবাবুকে তাঁর ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত রেখে দেন পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসাবে।
গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তৈরির জন্য গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে সমরবাবুকেই মূল দায়িত্ব দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। খর্বাকৃতি, মৃদুভাষি সমরবাবু বছর চার ছিলেন মমতা প্রশাসনের শীর্ষে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে প্রশাসনে আরও সঙ্গ দেওয়ার অনুরোধ করেন। রাজি হননি সমরবাবু।
ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে ‘বঙ্গবিভূষণ’ দিতে শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী। ২০১৭ সালের ১৩ মে তিনি সমরবাবুকে এই সম্মান দিতে চান। সমরবাবু প্রত্যাখ্যান করেন। গণিতের মেধাবী ছাত্র সমরবাবু বেছে নেন সরল অনারম্বর জীবন ও নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষকতা। দক্ষিণ শহরতলীর পঞ্চশায়রে থাকেন। এখন অতীতের কর্মজীবনের ওপর আলোকপাতে আগ্রহী নন একদম।
এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনের সর্বোচ্চ আসন অর্থাৎ মুখ্যসচিব পদে নিয়োগ করেন সঞ্জয় মিত্রকে। ২০০৩ সালে সঞ্জয়বাবু কলকাতা থেকে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন। সঞ্জয়বাবু পরিবহণ ও হাইওয়ে মন্ত্রকের সচিব হিসেবে, তিন বছর পিএমও-তে কাজ করেছেন। ক্ষমতায় আসার পর মমতা চেয়েছিলেন দক্ষ আমলাবৃত্ত তৈরি করতে। সঞ্জয়বাবুকে তাই দিল্লি থেকে নিয়ে আসেন রাজ্যে। ২০১১-র ৬ জুলাই তিনি আসেন কলকাতায়। তাঁকে স্বাস্থ্যসচিবের দায়িত্ব দেন মুখ্যমন্ত্রী। বাম আমলের শেষদিকে বেশ ক’বছর ওই দায়িত্বে ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রশাসনিক প্রশিক্রণ কেন্দ্রে।
’১২-র ২৮ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী ১৯৮২-র সঞ্জয়বাবুর নাম ঘোষণা করেন মুখ্যসচিব হিসাবে। ওই পদে তিনি ছিলেন সবচেয়ে নবীন অফিসার। কাজের মেয়াদ ছিল প্রায় ১০ বছর। সঞ্জয়বাবুকে মুখ্যসচিব করতে প্রথমে তাঁকে অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পদে উন্নীত করতে হয়। আইন মেনে এর জন্য প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতরের তৎকালীন প্রধান সচিব অনিল অগ্রবালকেও অতিরিক্ত মুখ্যসচিব করতে হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। জয়া দাশগুপ্ত, অনুপ চন্দ্র, টুকটুক কুমার, নুরূল হক, রাঘবেন্দ্র সিং প্রমুখ বেশ কয়েকজন সিনিয়র আইএএসককে টপকে সঞ্জয়বাবুকে মুখ্যসচিব করায় ক্ষুব্ধ হন রাজ্যের আমলাকুল। কিন্তু ততদিনে আইএএস অ্যাসোসিয়েশনকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
(চলবে)
হিন্দুস্থান সমাচার
অশোক সেনগুপ্ত