মহাবীর জয়ন্তী

জৈন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে ‘মহাবীর জয়ন্তী’ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন জৈনধর্মের ২৪তম তীর্থঙ্কর ‘মহাবীর’ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জৈন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় উৎসব হল এই ‘মহাবীর জয়ন্তী’। মাত্র ৩০ বছর বয়সে সংসার সুখ ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন মহাবীর। তাঁর পিতা ছিলেন রাজা সিদ্ধার্থ এবং মাতা ছিলেন লিচ্ছবি রাজকন্যা ত্রিশলা। কথিত আছে যে, মহাবীরের জন্ম দেওয়ার সময় তাঁর মাতা কোনও বেদনা অনুভব করেননি। মহাবীর যৌবনেই সমস্ত রাজকীয় সুখ, গৃহ ও পরিবার ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অনুসন্ধানে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন।
জৈনদের মতে, বহু প্রাচীনকাল থেকেই ২৪ জন তীর্থঙ্কর বা মুক্তির পথ নির্মাতা জৈনধর্ম প্রচার করেছেন। ‘তীর্থঙ্কর’রা সংসার দুঃখ পার হওয়ার ‘ঘাট’ বা ‘তীর্থ’ নির্মাণ করেছিলেন বলে তাঁরা ওই নামে পরিচিত। সর্বপ্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন ‘ঋষভদেব’ এবং সর্বশেষ তীর্থঙ্কর হলেন ‘মহাবীর’। প্রথম বাইশজন তীর্থঙ্করের কোনও ঐতিহাসিক সন্ধান পাওয়া যায় না। ২৩তম তীর্থঙ্কর ‘পার্শ্বনাথ’ই ছিলেন জৈনধর্মের প্রকৃত প্রবর্তক। কিন্তু এই ধর্মকে সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচার করে একটি প্রভাবশালী ধর্মে পরিণত করার কৃতিত্ব শেষ তীর্থঙ্কর ‘মহাবীর’-এর।
জৈনধর্মের শেষ প্রবর্তক মহাবীরের জন্মকাল সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। মোটামুটি ভাবে বলা হয়ে থাকে যে, আনুমানিক ৫৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৈশালী উপকণ্ঠে কুন্দগ্রাম বা কুন্দপুর বর্তমানে মজঃফরপুর জেলার ‘বসার’ গ্রামে জ্ঞাতৃক নামক ক্ষত্রিয় রাজবংশে মহাবীরের জন্ম হয়। তাঁর পিতৃদত্ত নাম হল ‘বর্ধমান’।
তরুণ বয়সে যশোদা নাম্নী জনৈকা কুমারীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় এবং তাঁর এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। ৩০ বছর বয়সে তিনি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ১২ বছরের কঠোর সাধনার পর ‘ঋজুপালিকা’ নদীর তীরে এক শালগাছের নীচে তিনি ‘কৈবল্য’ বা ‘সিদ্ধিলাভ’ করে ‘জিন’ বা ‘জিতেন্দ্রিয়’ নামে বিখ্যাত হন এবং চিরতরে বস্ত্র ত্যাগ করে নিগ্রন্থ (গ্রন্থি হীন বা সংসার বন্ধনহীন) হন। কৈবল্যের মাধ্যমে তিনি কামাদিরিপু ও সুখ-দুঃখকে জয় করেছিলেন বলে তাঁকে ‘মহাবীর’ বলা হয়। ‘জিন’ থেকে তাঁর শিষ্যদের ‘জৈন’ বলা হয়। সংস্কৃত ‘জিন’ শব্দটির অর্থ ‘জয়ী’। যে মানুষ আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, অহংকার, লোভ ইত্যাদি আবেগগুলিকে জয় করেছেন এবং সেই জয়ের মাধ্যমে পবিত্র অনন্ত জ্ঞান লাভ করেছেন, তাঁকেই ‘জিন’ বলা হয়। জিনদের আচরিত ও প্রচারিত পথের অনুগামীদের বলে ‘জৈন’।
জৈনধর্ম ‘শ্রমণ প্রথা’ থেকে উদ্গত ধর্মমত। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মগুলির মধ্যে অন্যতম। জৈনরা তাঁদের ইতিহাস চব্বিশজন তীর্থঙ্করের কথা উল্লেখ করেন। তাঁদের শিক্ষাই জৈনধর্মের মূল ভিত্তি। আধুনিক বিশ্বে জৈন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও এই ধর্ম বেশ প্রভাবশালী। ভারতবর্ষ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম ইউরোপ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জৈন ধর্মাবলম্বীরা রয়েছেন। ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইতিহাসে জৈনধর্মের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জৈনরাই সর্বপ্রথম বর্ণ বিভক্ত সমাজের বুকে আঘাত হেনে মানুষের সমান অধিকারের দাবিকে তুলে ধরে। আচার অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জৈনধর্ম আত্মার উৎকর্ষ ও মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। মধ্যযুগের জৈন সন্ন্যাসীগণ প্রাকৃত ও সংস্কৃতে বহুৎ টীকা-ভাষ্য রচনা করেছিলেন। সাহিত্য সম্পর্কে তাঁরা খুব উৎসাহিত ছিলেন। শিল্প ও বিজ্ঞান চর্চাতেও তাঁরা পিছিয়ে ছিলেন না। ভারতের বিভিন্ন স্থানে জৈনদের প্রতিষ্ঠিত বিহার, মন্দির ও গুহা রয়েছে। এইসব মন্দিরে বহু প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য পুঁথি আজও সংরক্ষিত আছে।
সিদ্ধি লাভের পর মহাবীর প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তিনি মগধ, অঙ্গ, কোশল, মিথিলা, নালন্দা, রাজগৃহ, বৈশালী সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের নানা স্থানে ধর্ম প্রচার করে বহু নর-নারীকে জৈনধর্মে দীক্ষিত করেন। সমসাময়িক রাজন্যবর্গও তাঁকে যথেষ্ট সম্মান ও সমাদর করতেন। ৪৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৭২ বছর বয়সে রাজগৃহের কাছে পাবা নগরীতে তিনি অনশনে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন।
মহাবীর যে ধর্মমত প্রচার করেছিলেন, তার মূল ছিল পার্শ্বনাথ প্রবর্তিত ‘চতুর্যাম’। এই চতুর্যাম হল – (১) অহিংসা (২) সত্য (৩) অচৌর্য অর্থাৎ চুরি না করা এবং (৪) অপরিগ্রহ অর্থাৎ বিষয় সম্পত্তির প্রতি অনাসক্ত থাকা। এই চারটি নীতির সঙ্গে মহাবীর আরও একটি নীতি যুক্ত করেন, তা হল ‘ব্রহ্মচর্য’। এই পাঁচটি নীতি ‘পঞ্চমহাব্রত’ নামে পরিচিত। মহাবীরের মতে সত্য বিশ্বাস, সত্য জ্ঞান এবং সত্য আচরণ ‘ত্রিরত্ন’ নামে পরিচিত। এই ত্রিরত্নের সাহায্যে ‘সিদ্ধশিলা’ অর্থাৎ পরম শুদ্ধ আনন্দ বা আত্মার মুক্তি লাভ সম্ভব।
জৈনরা মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির সুষ্ঠু ও চরম প্রকাশকেই ঐশী শক্তিরূপে গণ্য করেন। তাঁদের মতে, তীর্থঙ্করদের মধ্যেই ঐশী শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। তাঁরা কর্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, ‘পঞ্চমহাব্রত’ পালন ও কৃচ্ছ্রসাধনের দ্বারাই কর্ম ও জন্মান্তরের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। জৈনরা সকল বস্তু এমনকি পাথর ও ধাতুর মধ্যেও প্রাণের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তাঁদের মতে, কোন প্রাণী হত্যা মহাপাপ। অহিংসা, অপরিগ্রহ, কৃচ্ছ্রসাধন ও রিপুজয় — জৈনধর্ম অনুমোদিত সর্বোত্তম বৃত্তি।
জৈনধর্ম নতুন কোনও ধর্মমত নয়। হিন্দু ধর্মের চিন্তাধারা, বিশেষত উপনিষদ ও আরণ্যকের চিন্তাধারা থেকে তা অদ্ভূত। জৈনধর্মে গণেশ, লক্ষ্মী প্রভৃতি দেবদেবীর উপাসনা প্রচলিত আছে। পাশাপাশি হিন্দুরাও ‘পার্শ্বনাথ’ বা ‘পরেশনাথ’ ও ‘মহাবীর’কে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে থাকেন। আসলে জৈনধর্ম হল সনাতন হিন্দু ধর্মেরই একটি সংস্কারিত রূপ। তাই জৈনদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী হিসেবে গণ্য করা হয়। হিন্দু শাস্ত্রের উপনিষদ ও আরণ্যকে অহিংসার কথা বহু পূর্বে বলা হয়েছে।
সেই অহিংসাকেই ‘জৈন’রা ভীষণ গুরুত্ব সহকারে মেনে চলেন। জৈনধর্মের মূল সূত্রগুলি প্রথমে মৌখিকভাবে প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে তা গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়। জৈনশ্রমন ভদ্রবাহু রচিত ‘কল্পসূত্র’ কে জৈনদের আদি শাস্ত্রগ্রন্থ বলা যেতে পারে। চোদ্দটি পর্বে রচিত এই গ্রন্থ থেকে মহাবীরের বাণী সম্পর্কে বিশদভাবে জানা যায়। আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত প্রথম ‘জৈন সংগীতি’তে জৈন ধর্মশাস্ত্রকে চোদ্দটি পর্বের পরিবর্তে বারোটি ‘অঙ্গ’তে সংকলিত করা হয়। এগুলিকে ‘দ্বাদশ অঙ্গ’ বলা হয়। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে গুজরাটের বলভীতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ‘জৈন সংগীতি’ তে আবার নতুনভাবে ধর্মগ্রন্থ সংকলন করা হয়। বর্তমানে ওই সংকলন ‘জৈন আগম’ বা ‘জৈন সিদ্ধান্ত’ নামে পরিচিত। ‘জৈন সিদ্ধান্ত’ আবার অঙ্গ, উপাঙ্গ, মূল ও সূত্র নামে চারটি ভাগে বিভক্ত। এছাড়া ‘চতুর্বেদ’, ‘পরিশিষ্টপার্বণ’ প্রভৃতি জৈন ধর্মগ্রন্থ থেকে এই ধর্ম সম্পর্কে অনেক তথ্যদি জানা যায়। এইসব গ্রন্থগুলো প্রাকৃত ভাষায় রচিত। জৈন দার্শনিকদের মধ্যে স্থূলভদ্র, ভদ্রবাহু, হেমচন্দ্র, সিদ্ধান্ত, হরিভদ্র প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ভদ্রবাহু’র নেতৃত্বে দাক্ষিণাত্যে জৈনধর্মের প্রচার ব্যাপকহারে হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে জৈনরা মহাবীরের শাসনগুলি কঠোরভাবে মেনে চলতেন। তাঁরা কোনও গ্রন্থি বা বস্ত্র ধারণ করতেন না। এই জন্য তাঁদের ‘দিগম্বর’ বলা হত। অন্যদিকে স্থূলভদ্রের নেতৃত্বে যে জৈনরা উত্তর ভারতে থাকতেন এবং শ্বেতবস্ত্র পরিধান করতেন, তাঁদের ‘শ্বেতাম্বর’ বলা হত।
জৈন ধর্মানুশীলনে নিরামিষ আহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ জৈন দুগ্ধজাত নিরামিষ খাবার খেয়ে থাকতেন। কারণ অহিংসা হল জৈনধর্মের প্রধান ও সর্বাধিক পরিচিত বৈশিষ্ট্য। কোনও রকম আবেগের তাড়নায় কোনো জীবিত প্রাণীকে হত্যা করাকেই জৈনধর্মে ‘হিংসা’ বলা হয়। এই ধরনের কাজ থেকে দূরে থাকাই জৈনধর্মে ‘অহিংসা’ নামে পরিচিত। ইচ্ছাকৃতভাবে কীটপতঙ্গদের ক্ষতি করা জৈন ধর্মানুশীলনে নিষিদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ কীটপতঙ্গ মারার বদলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। জৈনধর্মে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতি করা ও নির্দয় হওয়াকে হিংসার চেয়েও গুরুতর অপরাধ বলে মনে করা হয়। মহাবীর সৃষ্ট জৈনধর্মের আরও একটি আদর্শ হল ‘অনেকান্তবাদ’। জৈনদের কাছে ‘অনেকান্তবাদ’ হল মুক্তমনষ্ক হওয়া। এই ধারণাটি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও অহিংসার আদর্শকে অনুপ্রাণিত করে।
মহাবীর জয়ন্তী সমগ্র দেশে পালিত হয়। তবে ভারতবর্ষের কয়েকটি স্থানে বেশ ধুমধাম করে পালন করা হয়। বিহারের ভাগলপুর, নালন্দা জেলায়, গুজরাটের গিরনার, জুনাগড়, পালিতানা, রাজস্থানের মাউন্টআবু, কলকাতার পরেশনাথ মন্দির সহ বিভিন্ন স্থানে জৈন ও হিন্দুরা মহাবীর জয়ন্তী উদযাপন করেন। এই উৎসব উপলক্ষে মহাবীরের বাণী পাঠ, জীবনী পাঠ, পুজো, প্রার্থনা, ভক্তিমূলক গান সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জৈন মন্দিরগুলিকে পতাকা দিয়ে সাজানো হয়। কোথাও কোথাও শোভাযাত্রাও বের হয়। এই দিন ভক্তরা সততা, অহিংসা ও প্রেমের ব্রত নেন। পাশাপাশি সমগ্র জীবকূলকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক আত্মোন্নতিরও শপথ নেন।

সরোজ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.