বাংলাদেশ থেকে ওয়াহাবিদের অত্যাচারে এখানে আসা মানুষদের সিকিউলার, লিবেড়াল, সুশীল উত্তরপ্রজন্মের মতো, সিপিএমের অন্ধকার যুগের ভুক্তভোগী মানুষদের উত্তরপ্রজন্মও কালচারাল মার্ক্সিজমের মগজধোলাইয়ে প্রভাবিত হয়ে, সিপিএম সমর্থক হবে কিনা, সেটা আপনাদেরকেই ঠিক করতে হবে

সারাদিন ইয়ার্কি, খিল্লি, এপ্রিল ফুল, নন্দীগ্রাম এসব অনেক হল। এবার কটা সিরিয়াস কথা বলি।

সিপিএম পাকাপাকিভাবে জমি হারাতে শুরু করে ২০০৯-এর লোকসভা ভোট থেকে। বামফ্রন্ট বলছি না। সিপিএমই বলছি। কারণ, ওরা একাই প্রভু। বাকীরা সাবঅর্ডি‌নেট। আর ২০১৯-এর লোকসভায় সিপিএম শূন্য সীট পায়। বিকাশ ভট্টাচার্য ছাড়া সকলের জামানত জব্দ হয়। ভোট কমে ৭% হয়। অর্থাৎ, পতন সম্পূর্ণ।

এবার এই ২০০৯ থেকে ২০১৯, সবাই সিপিএম-কে রাজনৈতিকভাবে হারানো নিয়েই আনন্দে ছিলেন। সিপিএমের আসল প্রাণভোমরা, ডিপস্টেট নিয়ে এখনো পর্যন্ত কেউ সেইভাবে মাথা ঘামাননি। সেই ডিপস্টেটটি হল “কালচারাল মার্ক্সিজম”। সিপিএম রাজনৈতিকভাবে শূন্যপ্রাপ্ত হলেও, সেই দুরবস্থাতেও কালচারাল মার্ক্সিজম এবং লেফ্ট ইকোসিস্টেম কিন্তু, পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় ছিল। এর ফল আজ আবার সিপিএমের এই মেকওভার করার সুযোগ।

২০০৯-১০ থেকে ২০১৯-২০, এই যে দশ-বারো বছরের সময়টা বাকীরা পেলেন, সেই সময় কালচালার মার্ক্সিজম আর লেফ্ট‌ ইকোসিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য কে কী করলেন? হাতে গোন কটা বই। যেগুলোর নামও কেউ জানেন না। পাওয়াও যায় না। আর সামান্য কটা কাগজে কিছু লেখালেখি। চার-চারটে দশক ধরে সিপিএম যা কুকীর্তি করেছে, আরও আগে দেখলে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই, বিশেষ করে ১৯৪২ থেকে যেভাবে ভারতের সর্বনাশ নিয়মিতভাবে করে চলেছে, সেই নিয়ে দাস ক্যাপিটালের থেকেও বৃহৎ কলেবর কাজ করা যায়। কিন্তু সেই নিয়ে আজকের প্রজন্ম কিছু জানে?

এবার সিপিএম তো নিশ্চয়ই নিজেদের কুকীর্তি নিজেরা জানাবে না। সেই কাজটা বাকীদের করতে হত। তাহলে ২০০৯-২০২০ এই বারো বছরে যে বিপুল সংখ্যায় নতুন ভোটার, নতুন প্রজন্মরা এসেছেন, তাঁদের কাছে সিপিএম নিজেদের আমলকে কোন রূপকথা বলে বেচতে পারত না। সুযোগ-সময় দুটোই অনেকটা পেয়েছেন স্যার-ম্যাডামরা। সিপিএম-এর ডিপ স্টেটকে ডিসম্যান্টেল করার জন্য কিছুই করলেন না। এরফল হবে, আর দুটো ভোটে সিপিএম রেজাল্ট খারাপ করলেও, পরের দশক থেকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। খিল্লি নয়, সত্যি। কারণ, যারা সিপিএম আমলের দুঃস্বপ্ন নিজেরা দেখেছেন, ভুগেছেন, তাঁরা আস্তে আস্তে সংখ্যায় কমতে থাকবেন। এবং সেই বিভীষিকার ইতিহাস পরের প্রজন্মের কাছে কিছুই পৌঁছবে না। ফলে, সেই প্রজন্ম রূপকথাতেই ভুলে থাকবে এবং তারপর আবার একদিন, পশ্চিমবঙ্গ চীন-কিউবা-ভিয়েতনাম-ভেনেজুয়েলার কলোনি হয়ে যাবে। আবার এলসির দাদাগিরি, অত্যাচার, আবার সেই ইটালিয়ান মাফিয়াদের থেকেও বড় নেটওয়ার্ক‌, যাতে প্রত্যেকটা মানুষ কী করছে, কী বলছে, কী খাচ্ছে, সব ডিটেলস পার্টির কাছে থাকে, আবার পার্টির দাদাদের বাইরে সবাই অশিক্ষিত, ইনফিরিয়র এটা বারবার বলা, আবার বিবেকানন্দ পড়লে টিটকিরি, হিন্দুধর্মের সবরকম বিরোধিতা, আবার সব ভারতীয় মনীষীদের নিয়ে কুৎসা। আমরা এসবের মধ্যেই বড় হয়েছি। কিন্তু সার্বিকভাবে এই সত্যিগুলোকে আমরা পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি, যতটা সিপিএম মিথ্যেগুলোকে বেচতে পেরেছে।

লোকসভা ভোটের পর বিজেপির সিপিএমের পার্টি অফিস খোলানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন প্রতিবাদ করেছিলাম, অনেক এক্সবাম বর্তমান হিন্দুত্ববাদী সেসবের বিরোধিতা করেছিলেন। আমি নিজে যেহেতু গ্রামের পরিবেশে মানুষ, আর আত্মীয়-স্বজনের সূত্রে আরও প্রত্যন্ত গ্রামের খবর পাই, তাই এটা গ্রাউন্ডেরই খবর, সিপিএম থেকে রটানো হচ্ছে, “একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম”। এটাকে খিল্লি ভেবে নিলে কিন্তু খরগোশ-কচ্ছপের গল্পও হতে পারে। হয়তো ছাব্বিশে নয়, কিন্তু ছত্রিশে? সিপিএম কিন্তু সেই প্রস্তুতি ২০২০ থেকেই শুরু করে দিয়েছে। এবং এবারের বিধানসভা ভোটে তার ছাপ স্পষ্ট।

ইম্মিডিয়েট ভোটে জেতা সিপিএমের পক্ষে সম্ভব নয়। সেটা সিপিএমও খুব ভাল জানে। তাই গতবছর থেকে সিপিএম যা করছে, সেটা লং টার্ম ইনভেস্টমেন্ট। এবং তার ডিভিডেন্ট, খুব সামান্য হলেও অলরেডি ঘরে তুলতে শুরু করে দিয়েছে।

সমাজের মাথারা প্রায় বারো বছর পেয়েছিলেন, সিপিএম কী ভয়ঙ্কর ছিল, সেই সত্য নথিবদ্ধ করে সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই বীভৎসতা মনে রাখতে পারে। সিপিএমকে রাজনৈতিকভাবে হারিয়ে, সেই স্বাধীনতাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড নিয়ে, ওদেরকে শুধু তুচ্ছজ্ঞান করে উপেক্ষা করেছেন। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। আপনি আজ ভাববেন, করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে, বেলেঘাটা আইডি ফাঁকা বলে আনন্দ করবেন। তারপর দেখবেন, করোনা আবার নতুন স্টেন নিয়ে হাজির। আবার সেকেন্ড ওয়েভের আতঙ্ক। সিপিএম ভাইরাসের থেকেও খারাপ। এবার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি? ক্যান্সারকে সার্জারি, কেমো, রেডিয়েশন দিয়ে সারানো গেলেও, সেই সুস্থতাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড নিলে, কোন নিয়মিত চেক আপ না করলে, ডাক্তারের কথামতো না চললে, যেমন খুশি যা খুশি খেলে, বা এরকম আরও সবকিছু করলে, ক্যান্সার কিন্তু আবার ফিরে আসতে পারে। এটা একদম মেডিক্যাল সায়েন্সের কথা। আমার লিস্টে অনেক ডাক্তারই আছেন। কিছু যদি ভুল বলে থাকি, শুধরে দেবেন। সিপিএম ক্যান্সারের মতোই। শুধুমাত্র থেরাপি দিয়ে অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে ভোটে হারিয়ে আপনারা ভাবছেন, শেষ করতে পারবেন। কিন্তু এর কো-মরবিডিটি, ফিরে আসার রিস্ক, নিয়ম মেনে ফলো আপ না করা, যথেচ্ছভাবে চলা, এগুলো নিয়ে ভাববেন না?

শুধু ফেসবুকের কটা পেজ বা প্রোফাইল থেকে কিছু লেখা সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়। তাও সবাই বিচ্ছিন্ন। যে যার নিজের মতো লেখেন। নিজেদের উদ্যোগে। আর ওদিকে সিপিএমের সংগঠন, লেখাপড়া, চ্যানেল, মিডিয়া, গ্রুপ, প্রতিটা কলেজে দাদাদিদি, পুরো সাংস্কৃতিক জগৎ এই পুরো মেশিনারি একসাথে কাজ করছে, পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম আমলের কালো অন্ধকার অতীতকে পুরো ভুলিয়ে দিয়ে, নতুন রূপকথাকে তুলে ধরতে। এর লাভ যে তাঁরা একদিন ঘরে তুলবেন, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, শুধু ভোট শতাংশ আর আসন সংখ্যা দিয়ে সিপিএমকে হারালে ক্যান্সারের মতো লোকাল ইনফেকশনটুকুই কন্ট্রোল হয় মাত্র। আসল অসুখটা ভেতরে থেকেই যায়। যার থেকে আবার আরও বড় মাত্রায় ক্যান্সার ফিরে আসতে পারে।

এসব দেখে বামেরা যদি শ্লাঘা বোধ করে হাসেন যে, “ওরা ভয় পেয়েছে, আমাদের রক্ত চোখে ভয় পেয়েছে”, তাহলে বলতেই হবে, সুস্থ মানুষ মারণ রোগের রক্ত চোখকে সবসময় ভয়ই পান। সেটাই সুস্থ মানুষের লক্ষণ।

এত কথা আজ লিখছি কারণ, যদি আবার পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল হয়, তাহলে যেন সেটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক পালাবদলেই আটকে না থাকে। সিপিএমের ডিপ স্টেট “কালচারাল মার্ক্সিজম” আর “লেফ্ট‌ ইকোসিস্টেম”-কে বৌদ্ধিকভাবে হারাবার ব্যবস্থা যেন করা হয়। কারণ, ওটা বাহুবলের জায়গা নয়। ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে মারপিট করে অ্যাকাডেমিক লেভেলে মার্ক্সবাদের প্রভাবকে ঠেকানো যাবে না। ওটা বুদ্ধিবলের জায়গা। অ্যাকাডেমিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কমিউনিজম আর সিপিএমের কালো দিক নিয়ে গবেষণা করা হোক। ভারতবর্ষ একটা মহাসমুদ্রের নাম। তার নিজস্ব ইতিহাস, দর্শন ভিত্তিক সাংস্কৃতিক জীবনধারা, মনীষীদের জীবন, কাজ, বাণী এসবকে ঠিকমতো তুলে ধরতে হবে। আর সাথে মার্ক্সবাদের অন্ধকার, বিভীষিকা, কঙ্কাল, লাশ, খুন, গণহত্যা এসব ইতিহাসকেও মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে প্রকৃত তথ্য সমেত। তবে আশা আছে। নাহলে কিছুই হবে না।

সিপিএম কিন্তু খুব ঠাণ্ডা মাথায়, অনেক গুছিয়ে পরিকল্পনা করে, সবদিক রেখে, সব আটঘাট বেঁধে কামব্যাক মিশন শুরু করে দিয়েছে। ২০২১-এর ইলেকশনে সিপিএমের খারাপ ফল মানে কিন্তু সেটা তাদের কামব্যাক মিশনেরই একটা পার্ট। এতে আনন্দ হবে ঠিকই। কিন্তু এটা দেখে তাদেরকে উপেক্ষা করলে, সেটা কিন্তু ভুল করা হবে।

বাংলাদেশ থেকে ওয়াহাবিদের অত্যাচারে এখানে আসা মানুষদের সিকিউলার, লিবেড়াল, সুশীল উত্তরপ্রজন্মের মতো, সিপিএমের অন্ধকার যুগের ভুক্তভোগী মানুষদের উত্তরপ্রজন্মও কালচারাল মার্ক্সিজমের মগজধোলাইয়ে প্রভাবিত হয়ে, সিপিএম সমর্থক হবে কিনা, সেটা আপনাদেরকেই ঠিক করতে হবে।

✍️✍️✍️ Deep Chatterjee

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.