“কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে”, কবির ভাবনা কি কখনো বাস্তব হবে না? কলকাতার ব্রিজগুলি ভেঙ্গে পড়ায় সময়, এই বছর ফেব্রুয়ারিতে জোড়াবাগানে নয় বছরের নাবালিকাকে ধর্ষণ করে হত্যার খবর প্রকাশের পরে বা পুলিশের উর্দিতে এসিপি বিনোদ কুমার মেহতাদের মতো মানুষ দিনের আলোয় খুন হওয়ার ঘটনার সময় হঠাৎ মনে হয়েছিল, জীবনানন্দ দাস বাংলা কবিতায় এতটা সাহসের কথা বলেছিলেন? তাই হয়তো কলকাতার ট্রাম তাঁকে ধাক্কা দিয়ে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিয়েছিল। তাই আর কেউ কলকাতার আকাশে চাঁদ দেখার চেষ্টা করেন না। সেই কারণেই হয়তো কলকাতার বিস্তৃর্ণ এলাকার রাস্তার নামফলকের থেকে বাংলা মুছে গেছে।
কিন্তু কলকাতা তো তিলোত্তমা ছিলো। সারা এশিয়ার কেন্দ্র ছিল কলকাতা। জ্ঞানে, বিজ্ঞানে আর সাহিত্যে সারা ভারতের হৃদপিণ্ড ছিলো আমাদের শহর। বেশ কয়েক বছর আগে চৈত্রের গরমে সারাদিন কলকাতা ঘুরে এক ইংরেজ ললনা ভিক্টোরিয়ার সামনে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে খেতে বলেছিলেন, ‘ঠাকুমা গতবছর চলে গেলেন। নাহলে বলতাম, ‘ আমি কলকাতা দেখে এলাম’। ফ্রান্সের জুরা পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট শহরতলি সেন্ট জেনিস পৌল্লি। সেখানে এক দুপুরে কফির দোকানের সামনে এক স্কুল মাস্টারমশাই কলকাতা থেকে এসেছি শুনে বলেছিলেন, ” বিখ্যাত শহর, সুন্দর শহর।’
এই শহরের প্রথম মেয়র ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সেই আসনে বসেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মহাপুরুষ।
শিক্ষায় সংস্কৃতিতে ভারতের মধ্যে, এমনকি দেশের পরিধি ছাড়িয়ে অগ্রগন্য হয়ে উঠেছিল কল্লোলিনী কলকাতা। স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ পালটে দিলেন। জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, সাহিত্যে পৃথিবীর যেকোন বড় শহরের সমতুল্য হয়ে উঠেছিল কলকাতা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের ভাষন দিলেন বাংলায়। উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ব্যবস্থাপনাতে। ইংরেজ সরকারের মুখে সেটা ছিল চপেটাঘাতের মতো। দেশের প্রথম কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভারতীয় ভাষায় সমাবর্তনের অনুষ্ঠান করল।
কলকাতা ২০২১ সালে ৭৫ বছর পরে নিজের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখল। কলকাতায় হাতে হাত দিয়ে জোট বেঁধেছে দুই শক্তি। যেমনটি হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ১৬ অগষ্ট। সেদিন মুসলিম লীগের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। সেদিন মনুমেন্টের নিচের সভা থেকে ‘ডায়রেক্ট একশানের’ ডাক দেওয়া হয়েছিল। শুরু হয়েছিল ব্যাপক হিন্দু নিধন। ইতিহাসের পাতায় যার কথা ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ‘ বলে লজ্জার অক্ষরে লেখা থাকবে। এত নির্দয়ভাবে এতো মানুষের মৃত্যু, সেই হলোকাস্টের সাক্ষী কলকাতা।
আজ নেতানেত্রীদের কথায় বারবার “বহিরাগত” শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেদিন লিচুবাগান বস্তিতে গনহত্যার প্রথম শিকার হয়েছিলেন উড়িষ্যার থেকে আসা কিছু “বহিরাগত” গরীব শ্রমজীবী। বাঙালিকে বাঁচাতে প্রথম প্রতিরোধ করেন কালীঘাটের “বহিরাগত ” পাঞ্জাবি শিখেরা আর মানিকতলায় “বহিরাগত ” কতিপয় রাজস্থানের মারোয়ারী। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শিয়ালদহ, বেলেঘাটার বিহার আর উত্তরপ্রদেশের মানুষেরা।যেদিন গোপাল মুখোপাধ্যায়, যুগল ঘোষেদের আত্মরক্ষার লড়াইকে এঁরা মনপ্রান দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। কলকাতা সেদিনই চিনে নিয়েছে কে বা কারা “বহিরাগত”।
কলকাতা অনেক পতন দেখেছে।
১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল বিজন সেতুতে দিনের আলোয় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল আনন্দমার্গ সম্প্রদায়ের ১৬ জন সন্ন্যাসী আর ১ জন সন্ন্যাসিনীকে। কি ছিল তাদের অপরাধ? কে বা কারা তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারল? তাদের কি শাস্তি হয়েছিল? কলকাতা কিছুই জানতে পারেনি।
১৯৯৩ সালে কলকাতা রসিদ খানের বউবাজারের কারখানায় বোমা বিস্ফোরণ দেখেছে।
২০০৭ সালে বাংলাদেশের লেখিকাকে তাড়ানোর দাবীতে কলকাতা দাঙ্গা দেখেছে। সেবছর ২১ নভেম্বর থেকে টানা তিনদিন কলকাতায় দাঙ্গাবাজদের সামনে পুলিশের অসহায় অবস্থা দেখেছে।
বাংলাদেশের নিষ্ঠুর নরসংহারকারী রাজাকারদের সমর্থনে বিশাল মৌলবাদী সমাবেশ দেখেছে কলকাতা ২০১৩সালের ৩০ মার্চ।
এই সবকটি ঘটনার মূল সাম্প্রদায়িক মুখগুলিই পরে রাজনৈতিক অলিন্দে উঠে এসেছেন, বড় বড় দায়িত্ব পেয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তানে যেতে চায়নি, ভারতবর্ষের মধ্যে থাকতে চেয়েছে। “বেঙ্গলী হিন্দু হোমল্যান্ড ” হিসেবে ভারতের এক অঙ্গরাজ্য হয়েছে। আজ সেই কলকাতায় সগর্বে ঘোষিত হচ্ছে “মিনি পাকিস্তান “। আজ পর্যন্ত কেউ ক্ষমা চাননি। কারণ অনেকের ধারনা হয়ে গেছে যে কলকাতার বাঙালী অমেরুদণ্ডী হয়ে গেছে। তাই প্রচারে বের হয়ে কোন রাজনৈতিক দলের নামে বা হিন্দু সম্প্রদায়ের নামে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেওয়া যায় খোদ কলকাতা শহরের উপরে।
শুভ দাশগুপ্ত শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ার। এমবিএ করে এখন বহুজাতিক সংস্থায় জেনারেল ম্যানেজার। চিরকালের তাত্ত্বিক বামপন্থী। অগাধ পড়াশোনা। তাই ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক করলেও নিজেকে সম্বৃদ্ধ মনে হয়। গতকাল ফোন করে বলল, এবার কলকাতাতে বাঙালি হিন্দুদের বাঁচানোর শেষ সুযোগ। সেভাবেই ভোট দেব। শুভর কথা শুনে আমি কয়েক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
যখন যাদবপুরের ছাত্র ছিলাম তখন বিজ্ঞান বিভাগের অতি পরিচিত ছাত্রনেতা ছিলেন সুধাময় দাস ( এত পরিচিত নাম তাই পরিবর্তন করলাম)। অসাধারণ মেধাবী ছাত্র, অতিবামপন্থী তুখোড় ছাত্র নেতা। আমাদের প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও কলা তিনটি ফ্যাকাল্টির রোল মডেল ছিলেন সুধাময়দা। আজ উনি ভারত বিখ্যাত বিজ্ঞানী। সম্প্রতি সোশাল মিডিয়াতে ওনার লাগাতার পোস্ট দেখে একবার জিজ্ঞেস করেই বসলাম। উত্তরে সুধামদার চটপট উওর , ” কলকাতায় বাঙালি হিন্দুর কেবল মা বোনেদের ইজ্জত নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আজ প্রশ্নের মুখে। তাই…”
আজ ৭৫ বছরে পরে কলকাতা আবার সেই এক প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক অনেক ভাবনা তর্ক আছে, থাকবেও চিরকাল। যদি বেঁচে থাকি, কথা বলার স্বাধীনতা থাকে তবেই থাকবে। করোনা অতিমারি প্রতিকারের জন্যও আজ অনুভব সম্পন্ন স্থিতিশীল সরকার প্রয়োজন। যে সরকার কেন্দ্রীয় বা রাজ্যের সবকটি সুযোগকে সর্বাত্মকভাবে ব্যবহার করবে।
অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা বামপন্থী ছিলেন,
একান্ত গান্ধীবাদী ছিলেন সুচেতা কৃপালিনী। কিন্তু ১৯৪৭ সালে তাঁরা সকলে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন। তাই বেঁচে গিয়েছিল কলকাতা। পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষে থেকে গিয়েছিল। জাতির বিপদে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এক হলেই বাঙালি রক্ষা পাবে।
কলকাতা এবার কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে। নিশ্চিত হবে।
জিষ্ণু বসু