আজ বিজেপি কে শুধু বাংলায় নয়, সমগ্র রাষ্ট্রের একটা বিশাল সংখ্যক বিজেপি কর্মী ও সমর্থকেরা কোথাও দোষী সাব্যস্ত করছে রাজ্যের অভ্যন্তরীন পটভূমিতে কার্যত কেন্দ্রীয় সুরক্ষা প্রদানে নিষ্ক্রিয়তার জন্য, অর্থাৎ কর্মীদের উপর হওয়া আক্রমণে কেন্দ্রীয় সুরক্ষা বাহীনি বা মিলিটারি অ্যাকশন না নেওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হোক কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, রাষ্ট্রীয় সভাপতি বা রাজ্যের সকল শীর্ষ নেতৃত্ব, সকলেই তাদের কাছে এর জন্য দায়ী। রাজ্যে সন্ত্রাসের প্রকোপ এতটাই গুরুতর, যে বিজেপি কর্মীদের বাড়ি ঘর লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের জেরে অসংখ্য বিজেপি কর্মী সপরিবারে ঘরছাড়া হয়ে এলাকা থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে। তাই রাজ্যে বিজেপির দ্বিতীয় অবস্থান ও রাজ্য শীর্ষ নেতৃত্বের নির্ণয় ইত্যাদি নিয়ে অনেক চুল চেড়া বিশ্লেষণ ও নানা দলীয় মতভেদের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে বহু কর্মী সমর্থকেরা। গত কিছু বছরে, বিশেষত লোকসভা নির্বাচনে ১৮ টি আসনে জয়লাভের পরে এবং সকল কর্মীদের অগাধ পরিশ্রম ও বহু কর্মীর প্রাণের বলিদানের ফলস্বরুপ, মানুষের আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যাশা বিজেপিকে সত্যিই বিজয়ী ঘোষণা করেছিল। তাই প্রকৃত ফলাফল কে একটু সরিয়ে রেখে, বিজেপি যদি সেই প্রত্যাশার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ২০০ সীটে জয়লাভ করতো, সেই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে একটা সমীক্ষা।
এটা খুবই বাস্তব, যে বিজেপির জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যেমন একাধারে আমাদের রাজ্যের মানুষের কাছে বেড়েছে, সেরকমই একটা বিশাল সংখ্যক মৌলবাদী জনগোষ্ঠীও এই গ্রহনযোগ্যতায় শঙ্কিত হয়ে আক্রমণাত্মক ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়েছে। এই আশঙ্কিত আক্রমণাত্মক আস্ফালন নির্বাচন চলাকালীন হিংসার মাধ্যমে যথেষ্ট পরিস্কার হয়েছিল। তাই বলা যায়, প্রাক্তন সরকারের পুনরায় জয়লাভের পর মূহুর্ত থেকেই নানা জেলায় হিংসার বিস্ফোরণ শুধু রাজ্যেই নয়, সম্পূর্ণ রাষ্ট্রে একটা বিভীষিকা ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বিজেপি জিতলে সেই আশঙ্কাই হয়তো চরমে পৌঁছে সেই আক্রমণের সম্পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ হতো, এবং প্রতিক্রিয়া বশতঃ ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ভারতের সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক গণহত্যার নিদর্শন হতে পারতো, হয়তো ইতিহাসের পাতার থেকেও বড়। রাজ্য ও বাংলার সমাজ এইরকম একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য কতটা প্রস্তুত?
CAA এখনো প্রযোজ্য হয়েনি, NRC এখনো বাস্তবায়ন হয়েনি, কিন্তু এর প্রভাব যথেষ্ট ঘণীভূত হয়েছে বিশেষ করে আমাদের রাজ্যে, যা এককাট্টা সংখ্যালঘু ভোটের মতামতে বা নির্বাচনের ফলাফলে খুবই স্পষ্ট বোঝা যায়। এখানে উল্লেখ্য একটা ঘটনা হলো, সকল জাতীয় ও আঞ্চলিক মিডিয়া নির্বাচন চলাকালীন কেন্দ্রীয় বাহিনী CISF এর দ্বারা হিংসা প্রতিরোধমূলক ফায়ারিং ও তার ফলে চারজনের মৃত্যুর সমালোচনায় দিনরাত মুখর ছিলো ও তাদের জবাবদিহিতা দাবি করেছিল। এমনকি আন্তর্জাতিক মিডিয়াও এই ঘটনার ওপর নানাভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা করে। আবার এরাই কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পরপরই অর্থাৎ প্রাক্তন রাজ্য সরকারের পুনরায় গঠন হওয়া সুনিশ্চিত হওয়ার পরে থেকে বিগত পাঁচ দিনের রাজ্যব্যাপি হয়ে চলা একমুখী হিংসার সকল ঘটনায় মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলো। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন চলাকালীন প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ইলেকশন কমিশন অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় ছিলো, তাই প্রতিটি মৃত্যুর দায়ভারও কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরেই ছিলো। রাজ্যব্যাপী এইরকম বিভৎস এক দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও নব নির্বাচিত বিজেপির রাজ্য সরকারের রাজ্য পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টায় সেই ৪ হয়তো ৪০০ বা ৪০০০ সংখ্যারও হতে পারতো। কেন্দ্র ও রাজ্য সেই পরিস্থিতির জন্য কতটা প্রস্তুত?
করোনা অতিমারী না জৈবিক যুদ্ধের অস্ত্র, সেটা এখনো অনেক গবেষণার বিষয়। তবে এর দ্বিতীয় পর্যায়ের ভয়াবহতা ও প্রকোপ থেকে এটা পরিষ্কার যে এর সাথে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও কুটনীতি দুইই যথেষ্ট জড়িয়ে। সম্প্রতি আমেরিকার রাজনৈতিক বদল থেকে চীনের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক দখলদারি সত্ত্বেও, ভারত সরকার সম্পূর্ণ প্রচেষ্টা করেছে ও সফলও হয়েছে ছোট বড় সকল দেশের সাথে তার আন্তর্জাতিক কুটনীতিক সম্পর্ক উন্নত ও মজবুত করায়, ভারতের তৈরী ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে। যা আজ বিশ্বব্যাপী এই অতিমারী সংকটে ভারতের তিরঙ্গা ধ্ধজের মান আন্তর্জাতিক স্তরে অবশ্যই অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের এই করোনা প্রকোপ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থান কে নানা ভাবে প্রভাবিত করে চলেছে, এইরকম পরিস্থিতিতে পাঁচটা রাজ্যের নির্বাচন সফল ভাবে সম্পন্ন করাও একটা বিশাল কৃতিত্ব, যেখানে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীন সকল অপশক্তির হস্তক্ষেপ প্রতিনিয়ত গণতান্ত্রিক সকল প্রক্রিয়ায় বাধা দিয়ে চলেছে। এই সব কিছুর নিরিখে, কেন্দ্র শাসিত বিজেপি দলের পশ্চিমবঙ্গে নজির বদল আনা ও নতুন রাজ্য সরকার গঠনের পর মূহুর্তে রাজ্যব্যাপী এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সম্মুখীন হওয়া এবং তার মিলিটারি নিয়ন্ত্রণ কেমন ও কি কি প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা খুবই স্পষ্ট। সেই প্রভাব হয়তো চিরতরের জন্য একটি হিন্দুবাদী সরকারের স্থায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গে, এবং পরবর্তীতে দিল্লির থেকে উপড়ে ফেলতে পারে। এই পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের জন্য, পশ্চিমবঙ্গের ও ভারতের হিন্দু সমাজ কতটা প্রস্তুত?
সনাতনী সিদ্ধার্থ