1977 এ জ্যোতিবাবুরা রাজ্যে ক্ষমতায় আসে একটি দক্ষিণপন্থী দলের কাঁধে চড়ে যা আগেই বলেছি l জনতা পার্টিতে চারটি দলের মিলিত একটি দল l এরমধ্যে জনসংঘ এবং লোকদল একে অপরের বিরুদ্ধে ছিল l লোকদলের নেতা ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী চরণ সিং l মোরারজি দেশাইকে বিপদে ফেলতে চরণ সিং বারবার ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যে মামলা এবং কমিশন বানাতে থাকেন l প্রতিটি মামলা ইন্দিরা গান্ধীর গুরুত্ব বাড়াতে থাকল l 1977 এ ইন্দিরাকে পরাজিত করা লোকদলের নেতা রাজনারায়ণ গোপনে সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা শুরু করলেন সরকার ফেলার জন্য l এরমধ্যে 1978 এ কংগ্রেস (আর ) থেকে বহিস্কৃত হলেন ইন্দিরা ও সঞ্জয় l কিন্তু চরণ সিং ও ইন্দিরা দুজনেই জানতেন জনসঙ্ঘ সরকার বাঁচিয়ে দেবে l জ্যোতি বসু পরিস্থিতির উপর নজর রাখছিলেন এবং সিপিআই এর সঙ্গে দূরত্ব কম করছিলেন l কারণ সিপিআই ছিল কংগ্রেস ( আর ) এর মতোই সোভিয়েত রাশিয়া পন্থী l 1979 তে মোরারজি পদত্যাগ করলেন l সরকার গড়লেন চরণ সিং এবং 21 দিন পর তার সরকারের থেকে সমর্থন তুলে নিলেন ইন্দিরা l 1980 তে ক্ষমতায় এলেন ইন্দিরা l জ্যোতিবসু বুঝলেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে টক্কর নিয়ে লাভ নেই l সিপিআইকে বামফ্রন্টএ আনা হল ইন্দিরা গান্ধীর আশীর্বাদ পেতে l 18 বছরের তিক্ততা কাটিয়ে এবং নখদন্তহীন হয়ে বামফ্রন্টে এল সিপিআই l কিন্তু এই ঘটনায়, ইন্দিরা গান্ধী এবং সোভিয়েত রাশিয়ার বিশ্বাস অর্জন করলেন জ্যোতি বসুরা l 1982 তে সেনাপতিহীন কংগ্রেস রাজ্যে লড়াই করলো বটে l কিন্তু আগের চেয়ে তাঁদের আসন কমে গেল l 52 থেকে 40 l
1982 তেই ইন্দিরা তাঁর দুই পুরোনো সেনাপতিকে ক্যাবিনেটে আনলেন, যারা বাংলা কংগ্রেস বানিয়ে 1967 তে প্রফুল্ল সেন ও অতুল্য ঘোষের হার নিশ্চিত করেছিলেন l অর্থদপ্তরে প্রণব এবং রেলে গনিখান l প্রচুর টাকা পেল রাজ্য l মেট্রো রেলসহ রেল প্রকল্পের বন্যা বইয়ে দিলেন গণিখান l রাজ্য কংগ্রেসে জোয়ার এলো l 1984 তে ইন্দিরা হত্যার পর সাধারণ নির্বাচনে অশোক সেন, অজিত পাঁজা, ফুলরেণু গুহ, ভোলা সেন, তরুণকান্তি ঘোষের মত 16 জন লোকসভায় গেলেন l সবচেয়ে বড় আশ্চর্য বামদুর্গ দমদম ও যাদবপুরে আশুতোষ লাহা এবং মমতা ব্যানার্জীর জয় l রাজ্যের কংগ্রেস নেতা ও কর্মীরা 1987 তে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখা শুরু করল l
কিন্তু গন্ডগোল পাকালেন নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী l তাঁর মাকে অনুসরণ করে তিনিও সিপিএম এর সঙ্গে গড়াপেটা চালিয়ে গেলেন l রাজ্যে কংগ্রেসকে দুর্বল করতে প্রণব ও গণিখানকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ রাখলেন l সিপিএম সেই সুযোগে দুটি প্রচার শুরু করলো l এক, রাজ্যে কংগ্রেসের কোন নেতা নেই যে জ্যোতিবাবুর মাপের l নাইলে তাঁদের মন্ত্রী করলেন না কেন রাজীব? অশোক সেনকে আইন মন্ত্রী করেছিলেন বটে রাজীব, কিন্তু তিনি জননেতা নন l প্রণব মুখার্জী নিজের দল বানালেন l প্রিয়রঞ্জনকে প্রদেশ সভাপতি করা হল l কিন্তু প্রিয় কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী l কলেজে অধ্যক্ষ হতে যেমন অধ্যাপক হবার অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, তেমনি মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হতে গেলে কেবিনেট মন্ত্রী হাওয়া প্রয়োজন বলে ভোটাররা মনে করল l লিখিত কোন নিয়ম যদিও নেই, কিন্তু মানুষ অনভিজ্ঞকে মানবে কেন? প্রিয়কে মেনে নিল না ভোটাররা l দুই, কংগ্রেস বাঙালী বিরোধী l
1987 বিধানসভায় কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী প্রিয়রঞ্জনের ইস্তেহারের মূলতঃ তিনটি প্রস্তাব ছিল l
এক, দুটাকা কিলো চাল দেয়া হবে l
দুই, প্রতিটি বন্ধ কারখানাকে আবার চালু করা
তিন, প্রাথমিকে ইংরেজি চালু করা হবে এবং শিক্ষাঙ্গনকে পুনরায় রাজনীতিমুক্ত করা হবে
জ্যোতি বাবু ও তাঁর দুর্দান্ত পার্টি নেটওয়ার্ক এই তিনটি প্রস্তাবকে যে ভাবে নস্যাৎ করে মূল্যহীন করে ভোটে জিতলেন, তাতে পশ্চিমবঙ্গকে নির্বাচনী রাজনীতির ইতিহাসের হস্তিনাপুরের মর্যাদা দিতে পারেন ঐতিহাসিকরা l তারা যুক্তি দিলেন :
এক, প্রিয় দুই টাকার চাল বড়লোকদের দিলে গরিব চাষী না খেয়ে মরবে l তারা 50 পয়সাও পাবে না l প্রলিতারিয়েট পশ্চিমবঙ্গে বুর্জোয়াতন্ত্রের পুনরাবির্ভাব l সংগঠনের প্রচারে, এই ন্যারেটিভ কৃষকরা বিশ্বাস করে l
দুই, কারখানা খোলার ব্যাপারে প্রিয় এতো আত্মবিশ্বাসী কারণ সে পুঁজিপতিদের দালাল l শ্রমিকনেতাদের এই কুযুক্তি সেযুগের শ্রমিকসমাজ বিশ্বাস করে নেয় l
তিন, প্ৰিয় ইংরেজি আবার ফিরিয়ে আনতে চায়, যাতে গরিবের ছেলেমেয়েরা ফেল করে পড়াশুনা ছেড়ে দেয় l দুঃখের বিষয়ে, এই যুক্তিও গরিব মানুষ বিশ্বাস করে নেয় l
এদিকে, কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে প্রণব মুখার্জীর নতুন দল রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নিজেরা কিছু না করতে পারুক, কংগ্রেসকে বাঙালী বিরোধী প্রমান করে ছেড়েছে ওই নির্বাচনের আগে l 1978 এ ইন্দিরা গান্ধীকে কংগ্রেস (আর ) থেকে বহিষ্কারের সময় করার সময় তাঁর করা এক মন্তব্য l প্রিয়রঞ্জনকে নিয়ে ‘কাঁচের ঘর’ নাটক লিখে মঞ্চস্থ করলেন উৎপল দত্ত l দেখানো হল রাজ্যের সব বিধানসভা কেন্দ্রে l সেই নাটকে তিনি নিজে প্রিয়ারঞ্জনের ভূমিকায় অভিনয় করলেন l নাটকের উপসংহারে উৎপল দত্ত বাঙালীকে বললেন, ‘দয়া করে নিজের কুকুরের নামও প্রিয় রাখবেন না l সে বেইমানি করবে’ l প্রসঙ্গত, সত্তরের দশকে প্রিয় যুবকংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি হলেও জরুরি অবস্থার সময় সমালোচনা করেছিলেন ইন্দিরা এবং সঞ্জয়ের l ভবিষ্যতে কংগ্রেস ই তে যোগদানের পরেও কোনদিন অস্বীকারও করেন নি এবং এর জন্য ক্ষমাও চাননি l কিন্তু জরুরি অবস্থা সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গুলিহেলনে হয়েছিল l প্রতিটি বানপন্থী একে সমর্থন করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে l আর সেইজন্যই বামপন্থীরা প্রিয়রঞ্জনের প্রতি বরাবর খড়্গহস্ত ছিল, যা প্রণব, সোমেন, সুব্রতদের উপর ছিল না l নির্বাচনে ভরাডুবি হল প্রিয়রঞ্জনের l কোনরকমে চল্লিশের ঘর পেরোলো ইন্দিরা কংগ্রেস l
এই সময়, কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতি আবার 1977 এর মত সর্বভারতীয় রূপ নিল l বোফর্স দুর্নীতির অভিযোগে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং l হাত মেলালেন বিজেপি এবং সিপিএম এর সঙ্গে l তাঁর সঙ্গে যোগ হল অনভিজ্ঞ রাজীব গান্ধীর কুশাসন l দেশ দেউলিয়া হবার পথে চলল l.বেকারত্ব প্রায় তুঙ্গে l
সেই সময় বামবিরোধী হাওয়াও বেশ তুঙ্গে উঠল এই রাজ্যে l যে ইস্যুগুলো বিরোধীরা সবচেয়ে বেশী হাতিয়ার করলো তা হল
- চন্দন বসুর দুর্নীতি
- যতীন চক্রবর্তীর বিদ্রোহ
- বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি
- ট্রাম কেলেঙ্কারি
5 ট্রেজারি কেলেঙ্কারি
- মাটি কেলেঙ্কারি
- সন্তোষ ভট্টাচাৰ্যকে অপমান
- ভয়ঙ্কর লোডশেডিং
- রোজ কোন না কোন শিল্প বন্ধ
- নৃপেন চক্রবর্তীর বিদ্রোহ
- বানতলা, বিরাটি, সিঙ্গুরসহ সারা রাজ্যে মহিলাদের উপর বিভিন্ন নারকীয় অত্যাচার l
কিন্তু রাজীববিরোধী হাওয়া এবং সিপিএম এর প্রচার যন্ত্রের কাছে 1989 সাধারণ নির্বাচনে ধুয়ে মুছে গেল কংগ্রেস l 16 থেকে নেমে এল 4 এ l কলকাতার তিনটি এবং মালদা বাদে পুরো রাজ্য থেকে ধুয়ে মুছে সাফ l প্রধানমন্ত্রী হলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং l পাঞ্জাবের রাজ্যপাল পদ খোয়ালেন সিদ্ধার্থশঙ্কর l মমতা ব্যানার্জী হারলেন যাদবপুর l রাজীব গান্ধী প্রণব মুখার্জীকে ফিরিয়ে এনে প্রদেশ সভাপতি করলেন l এদিকে সিদ্ধার্থশঙ্কর ফিরে এসে দেখলেন অধিকাংশ প্রদেশ কংগ্রেস নেতাকে সাম-দান-দন্ড-ভেদ মন্ত্র দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে তাঁর বন্ধু জ্যোতি l 1990 তে চূড়ান্ত রিগিং, বোমাবাজি, খুনোখুনির মধ্যে কলকাতা কর্পোরেশন দখল করল সিপিএম l সিদ্ধার্থশঙ্করকে ফিরিয়ে আনলেন রাজীব গান্ধী প্রদেশ সভাপতি হিসেবে l সিদ্ধার্থর পাশে দাঁড়ালেন প্রিয়রঞ্জন ও মমতা l বাকিরা দূরত্ব রাখলেন l নিজেদের শক্তি যাচাই করতে কলকাতা বন্ধ ডাকলেন সিদ্ধার্থ l 16ই আগস্ট 1990 l সেই দিন লালু আলমের লাঠির ঘায়ে মমতা ব্যানার্জী প্রায় মৃত্যু মুখে পতিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন l রাজীব গান্ধী প্রদেশ যুবকংগ্রেসের সভানেত্রী করলেন মমতাকে l সিপিএম এর অবস্থা এবার সত্যিই খারাপ হতে থাকল l দিল্লিতে বন্ধু সরকারের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সবদিকে ব্যর্থ l সারাদেশে জাতপাতের যুদ্ধ শুরু মণ্ডল কমিশন নিয়ে l এই অবস্থায় 1991 বিধানসভা নির্বাচনে জ্যোতি বসুকে বাঁচিয়ে দিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, তপন সিকদাররা l বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে নয় l জটিল নির্বাচনী পাটিগণিতের ধাঁধায় l 1990 রামমন্দিরের দাবী নিয়ে রথযাত্রা শুরু করলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী l বিহারে তাকে গ্রেফতার করলেন লালু যাদব l বিশ্বনাথ প্রতাপের সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করল বিজেপি l
সিপিএম এর মধ্যে একটা নতুন পাটিগণিতের সন্ধান পেল l একদিকে তারা লালুকে নায়ক বানিয়ে কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোটে থাবা বসলো এবং মালদা, মুর্শিদাবাদে নিজেদের প্রভাব বাড়াল l তাঁরসঙ্গে বিজেপিকে ক্রমাগত আক্রমণ করে কংগ্রেসের হিন্দু ভোট ভেঙে দেবার পরিকল্পনা শুরু করলেন l সেইসময়ে বিজেপির তৎকালীন নেতাদের বক্তব্যও রাজ্যের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হল l তপন সিকদার, পরশ দত্ত, কর্নেল সব্যসাচী বাগচী, রাহুল সিনহাদের বক্তব্য রাজ্যবাসীর কাছে একটা বিশুদ্ধ বাতাসের মত অক্সিজেন হয়ে এলো l তাঁর সঙ্গে বিশ্বশ্রী মনোহর আইচের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুরা নিজেদের মনের ভাষা খুঁজে পেলেন l
সিদ্ধার্থ রায় বুঝলেন বিজেপি কংগ্রেসের ভোট কাটবে, কিন্তু সিপিএম এর ভোট একই থাকবে l বিজেপির বিরুদ্ধে তিনিও খুব একটা বললেন না l কিন্তু বারবার ভোটারদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন বিজেপিকে ভোট দিলে সেটা সিপিএমকে জিততে সাহায্য করবেন l কিন্তু ভোটাররা শুনলো না l
সিদ্ধার্থ রায়ের ভবিষ্যৎবাণী মিলে গেল l চন্দন বোস, বেঙ্গল ল্যাম্প, লোডশেডিং, মমতার মাথায় লাঠি কাজে লাগলো না l সেবার সিদ্ধার্থ রিগিং আটকালেন বটে l কিন্তু 12% ভোট কেটে 137 টি আসনে কংগ্রেসকে হারিয়ে দিল সিপিএম l কংগ্রেস পেল 42 l ভোটার পর সিদ্ধার্থ আক্ষেপ ভোট ভাঙার জন্য করলেন l
1991 তে ফিরে এলো উন্নততর বামফ্রন্ট l পরের পাঁচ বছর অত্যাচার আরও বাড়লো বিরোধীদের উপর l রাজ্যে চলছে বিরোধীদের জ্যান্ত কৈমাছ খাওয়ানো, হাত কেটে নেয়া, মহাকরণে গুলি এবং একের পর এক রাজনৈতিক হত্যা l পাল্লা দিয়ে বন্ধ হাওয়া শুরু করল একের পর এক জুট মিল, পেপার মিল থেকে চাবাগান l ওদিকে নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে এক নতুন সূর্যোদয়ের আশায় এগিয়ে চলেছে নতুন ভারত l নব্বইয়ের দশকে রাজ্যের রাজনীতিতে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন এল রাজ্যের রাজনীতিতে l আলোচনা হবে পরের পর্বে l
সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)
( চলবে )