কিভাবে 34 বছর ক্ষমতায় থাকলো জ্যোতি বাবুরা? শুধুই রিগিং? শুধুই মস্তিস্ক মস্তিস্ক প্রক্ষালন? শুধুই বিপ্লবের স্বপ্ন? নাকি স্ট্রাটেজি? নাকি অন্য কিছু?  – শেষ পর্ব

34 বছরে বামফ্রন্ট যদি রাজ্যকে সত্যিই কিছু দিয়ে থাকে, তবে সেটা দিয়েছে ষষ্ঠবামফ্রন্ট l যদিও 2001 এর পর সিপিএম ক্যাডারদের ভয়ে বিরোধী দলের কর্মীরা প্রায় সবাই বাড়িতে বসে গেছেন l ভোটে ভরাডুবির পর, মমতা আবার NDA তে ফিরে এলেন l বাজপেয়ীজি তাঁকে প্রথমে মন্ত্রিত্ব দিলেন না l তারপর শপথ নেয়ালেন বটে কিন্তু দপ্তর দিলেন না বহুদিন l শেষের দিকে কয়লা দপ্তরে দেয়া হল কিছুদিনের জন্য l 

ভোটে জিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশে মন দিলেন l ম্যাকেন্সিকে দিয়ে একটা স্ট্র্যাটেজিক রোড ম্যাপ বানালেন l সফটওয়্যার, MSME, অলংকার, বস্ত্র, পেট্রোকেমিকাল, আবাসন, খনি, চা বাগান ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটা জোয়ার এলো l বুদ্ধদেবকে ভারতের ডেঙ বলে ডাকতে শুরু করলো সংবাদমাধ্যম থেকে শিল্পমহল l ওদিকে অটল বিহারি বাজপেয়ী সড়ক যোগাযোগ, টেলিকমে বিপ্লব এনে বুদ্ধদেবের কাজ সহজ করে দিলেন l 1966 র পর প্রথমবার রাজ্য থেকে ব্রেন ড্রেন কিছুটা কমতে শুরু করলো l তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য ছিলেন পুরো ব্যর্থ একজন মানুষ l তাঁর আমলে বাংলার সিনেমা, থিয়েটার, নাটক, যাত্রা, সাহিত্য, কবিতা, সংগীত, লোকগীতি সব কিছুরই চূড়ান্ত অধঃপতন হয়েছিল l কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনলেন বাংলার সংস্কৃতি l সেটা চাকরি ও ব্যবসার বাজার পরিবর্তন করে মানুষের হাতে টাকা তুলে দিয়ে l তাঁর কাকা সুকান্ত ভট্টাচাৰ্য বলেছিলেন, ‘ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’, আর জ্যোতিবাবুর এই ক্ষুধার রাজ্যে মানুষকে কর্মসংস্থান ও ব্যবসা দিয়ে, সংস্কৃতি জগতেরও গতি পরিবর্তন করে দেন বুদ্ধদেব l একটা ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’ সারারাজ্যে কাজ করতে থাকে l 

এই সময় মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত সিপিএম এর হাতে এসে পড়লো গুজরাট দাঙ্গা l ডাঙ্কেল প্রস্তাব ও  গ্যাটচুক্তির পর বামফ্রন্টের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক হাতিয়ার l প্রতিটি দেয়ালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কার্টুন l উদ্দেশ্য সংখ্যালঘু ভোট l মমতা NDA ছাড়লেন না, কিন্তু রাজ্যে তপন সিকদারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে থাকলেন l 2004 এ তৃণমূল-বিজেপি জোট ভোট লড়লেন বটে কিন্তু মমতা বাদে সবাই হারলেন l পুরো সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূল বিজেপি জোটের  বিরুদ্ধে চলে গেল l কংগ্রেস পাঁচটি আসন জিতল l রাজ্য রাজনীতিতে আসনের নিরিখে দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উঠে এলো l 

 বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য রাজ্যের যুবকদের কাছে নতুন আশা হয়ে উঠলেন l কিন্তু গন্ডগোল পাকালেন নিরুপম সেন l খুব ঠান্ডা মাথার নির্মম মানুষ এই নিরুপম l.বিরোধীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মঞ্চে দাবী করেছেন, নিরুপম সেন নাকি 1970 এর কুখ্যাত সাইবাড়ি হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত এবং যাবজ্জীবন শাস্তি পাওয়া আসামী খোকন সেন l 1978 এ জ্যোতি বাবু তাঁকে মুক্তি দিলে, মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে নতুন পরিচয় নিয়ে নিরুপম সেন হয়ে আত্মপ্রকাশ সংসদীয় রাজনীতিতে l তাঁর দল বা তিনি কোন দিন সেভাবে এই অভিযোগের  প্রতিবাদ করে নি এবং করো বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও করে নি l নিরুপম শিল্প বানাতে গিয়ে নির্মমভাবে জমি অধিগ্রহণ শুরু করলো l বিরোধী দলের অভিযোগ, তাঁদের সমর্থকদের জমির পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ দিতেন না সরকার l কিন্তু ভোটে তাঁর প্রভাব পড়লো না l এই প্রথম 50% এর বেশী ভোট পেল বামফ্রন্ট l তৃণমূল নেমে এলো 29 এ l পরে বনগাঁ উপনির্বাচনে জিতে 30 হল l আর বামফ্রন্ট 235 l

এদিকে দিল্লিতে মনমোহন সিং সরকারকে রোজ কোন না কোন বিষয়ে ঝামেলায় ফেলা শুরু করল প্রকাশ কারাট l প্রণববাবু  এদের হাত থেকে বাঁচতে মমতাকে আন্দোলন শুরু করতে উৎসাহিত করা শুরু করলেন l সংসদে মমতাকে একা পেয়ে সিপিএম এর সাংসদরা এমন কটূক্তি করতেন যে মমতা সংসদে যাওয়া প্রায় বন্ধ করে কলকাতার রাজনীতিতে নিজেকে নিমজ্জিত করলেন তিনি এবং রাজনীতিতে ফিরে আসার রাস্তা খুঁজছিলেন l প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য 2006 বিধানসভার ঠিক আগে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে  গিয়েছিলো, যার প্রভাব 2006 এর রাজনীতিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল l 1999 এ অধীররঞ্জনকে সাংসদ করেছিলেন অনিল বিশ্বাস তৃণমূল-বিজেপিরকে আটকাতে l কিন্তু 2004 এ যেই দিন থেকে কেন্দ্রের UPA সরকারকে সমর্থন শুরু করেছে সিপিএম,  সেই দিন থেকে অধীরের প্রয়োজন ফুরিয়েছে অনিল বিশ্বাস l 2006 বিধানসভা ভোটের আগে অতিআত্মবিশ্বাসী অনিল বিশ্বাসের নির্দেশে অধীরকে গ্রেফতার করা হল একটা পুরোনো খুনের মামলায় l গ্রেফতারির সময় অধীর ETV নিউস এর এক সাংবাদিককে বলে গেলেন, ” আমি জেল থেকে বেরিয়ে অনিল বিশ্বাসের সুইস ব্যাংকের একাউন্ট নাম্বার ফাঁস করে দেব” l অধীর জামিন পাবার আগেই অনিল বিশ্বাসের হঠাৎ সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে মৃত্যু হয় l 

সিপিএম মস্তিস্কহীন হয়ে যায় l জ্যোতিবসু, হরকিষেন সিং সুরজিৎ এবং অনিল বিশ্বাসের মত তিন ধুরন্ধর রাজনীতিবিদের জায়গা নেয়, বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য, প্রকাশ কারাট ও বিমান বসু l এর মধ্যে কিছু এমন ঘটনা ঘটতে থাকে যা তৎকালীন নেতৃত্ব সামলাতে ব্যর্থ হয় l 

এক, মুরগির বার্ড ফ্লু : গ্রামে গ্রামে ছাড়িয়ে পড়ে এই রোগ l সরকার মুরগি নিধন শুরু করে l কিন্তু জমিহারাদের মত এক্ষেত্রেও সরকার ক্ষতিপূরণে পক্ষপাতিত্ব শুরু করে l সংখ্যালঘুরা বামফ্রন্টের উপর আস্থা হারাতে থাকে l

দুই, রেশন লুট : মিঠুন চক্রবর্তীর ফাটাকেষ্ট সিরিজের ছবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রাম বাংলায় রেশন লুট শুরু হয় 2007 এ l আগুনের মত এই রোগ ছড়াতে থাকে l একদিকে গ্রামবাসীদের মনোবল বাড়তে থাকে এবং অন্যদিকে বামকর্মীদের মনোবল ভাঙতে থাকে এই বিদ্রোহের ফলে l 

তিন, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম : সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে  সিপিএম তাঁর ত্রিশ বছরের পুরোনো পাপের ফল ভুগতে হল l যে বার্গাদারির ফল তাঁরা উপভোগ করেছে এই ত্রিশ বছর, সেই বর্গাদার গুনতে তাঁদের মাথা খারাপ হয়ে যায় l একটা ছোট্ট জমিতে এতো লোককে ক্ষতিপূরণ দিলে,  জমিতেই সব বিনিয়োগ চলে যাবে l 

সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের রাজনৈতিক পরাজয়ের ফলে 2008 এর পঞ্চায়েতের ফলে পড়লো l মনমোহন, সোনিয়া, প্রণব, অধীর থেকে লালকৃষ্ণ আডবাণী, তপন সিকদার, এমনকি SUCI ও কিছুই নক্সালপন্থী দল পঞ্চায়েত ভোটে পরোক্ষ ভাবে মমতাকে সাহায্য করলো l কিন্তু সেই খবর সিপিএম এর উপর মহলে পৌঁছল না l জেলা পরিষদ না পেলেও নিচের স্তরে আধা রাজ্য দখল করলো বিরোধীরা l 

কিন্তু অহংকারী এবং অতিআত্মবিশ্বাসী প্রকাশ কারাটকে কে থামায় l সারা দেশের মুসলিম ভোটের উপর সম্পূর্ণ অধিকারের উদ্দেশ্যে আমেরিকা বিরোধী হিসেবে নিজের অবস্থান প্রমান করতে, মনমোহন সিংএর সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলেন কারাট l 

2009 সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস ও SUCI এর সঙ্গে হাত মেলালো মমতা l বিজেপি অধিকাংশ আসনে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করলো যাতে 1991 বা 2001 এর মত এই বার ভোট ভাগের ফল বামফ্রন্ট না পায় l সোমেন মিত্র কংগ্রেস ছেড়ে নতুন দল বানিয়ে এর মধ্যেই মমতার সঙ্গে জোট বেঁধেছেন l 

আরও একটা ঘটনা 2009 এর সাধারণ নির্বাচনে প্রভাব ফেলল l সেটা হল 2006 তে সপ্তম বামফ্রন্ট আসার পর বিধানসভায় পাশ হাওয়া l বুদ্ধদেব ভাবেন এই আইন পাশ হলে পঞ্চায়েতের হাতে একবার বিচার ব্যাবস্থা চলে গেলে, পুরো গ্রামবাংলা বামদলগুলোর দখলে চলে যাবে l কিন্তু 2008 এ গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলির অর্ধেক চলে যায় বিরোধীদের হাতে ln2009 তে তাঁরা রিগিং আটকে দেয় l 2008 এর  জেতা প্রতিটি পঞ্চায়েতে তাঁরা রিগিং আটকে দেয় l বামদুর্গের ভিত নড়ে গেল 2009 সাধারণ নির্বাচনের ফলের পর l 19 টা তৃণমূল, 6 টা কংগ্রেস, 1 টা SUCI ও একটা বিজেপি পেল l 35 থেকে 15 তে নেমে এল l 

2010 এর পুরনির্বাচনে সোমেন মিত্রর দামালদের  মমতা বহু কেন্দ্রেই টিকিট দিলেন, যাতে ভবিষ্যতে তাঁরা তৃণমূল ছেড়ে বেরিয়ে না যায় l এককথায় মালদা মুর্শিদাবাদের বাইরের সব কংগ্রেস নেতাকে নিজের দলে টেনে নিলেন l 2009 তে হারার পর থেকেই সিপিএম নেতা ও কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করলেন l 2010 এ বহু পুরসভা তৃণমূল ও কংগ্রেসের হাতে চলে এল l তারপর 2011 তে 34 বছরের বাম দুর্গের পতন l 

প্রথমদিন থেকে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরেও সাত বার জিতে সিপিএম যে ইতিহাস তৈরি করেছেন, খুব কাছে থেকে তাঁর বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ভোট একটা এক দিনের ক্রিকেটের মত, টেস্ট ম্যাচ নয় l এখানে খেলোয়াড়েদের পারফর্মেন্সের থেকেও  স্ট্রাটেজি একটা বড় ভূমিকা পালন করে l সঙ্গে ভাগ্য l সব কারণগুলি যদি আবার লিপিবদ্ধ করি তবে দেখা যাবে সরকারের পারফরমেন্স শুধুমাত্র ভোটের হার জিতের কারণ হতে পারেনা l নরসিমা রাও, অটল বিহারি বাজপেয়ী এমনকি বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য কাজ করেও হেরে যান l কিন্তু জ্যোতি বসুর মত ব্যর্থ একনায়ক বারবার এই পরীক্ষায় পাশ করেছেন, শুধুমাত্র বিরোধীদের ভুল পদক্ষেপ, অতিআত্মবিশ্বাস, কোন্দল বা প্রস্তুতির অভাবের জন্য l 1987 তে প্রিয়বাবুকে মানুষ নেয় নি কারণ তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা ওই চাকরির জন্য যথাযত ছিল না l একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীকে মানুষ মুখ্যমন্ত্রী করেনি l 1991 তে সিদ্ধার্থ হারেন বিরোধী ভোট ভাগের ফলে l 1996 ও 2001 এ হারের কারণ ভুল লোককে টিকিট দেয়া l আবার 2006 এর নায়ক কিভাবে মাত্র দুই বছরের মধ্যেই রাজ্যের অর্ধেক পঞ্চায়েত আসনে হেরে গেল l.অহংকার ও অতি আত্মবিশ্বাস আজকের নির্বাচনী যুদ্ধে ততটাই আত্মঘাতী, যতটা কুরুক্ষেত্রের যুগে ছিল l রাজনীতির এই রসায়ন ও দর্শন কাল ছিল, আজ আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে l তাই 2016 তে নিজেকে 294 টি আসনে নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করা মমতা ব্যানার্জী প্রশান্ত কিশোরকে নিজের পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ করেন l তাই আরেকবার 34 বছরের আটটি নির্বাচনের বিশ্লেষণ করে এই বিষয়ে আলোকপাত করার একটা চেষ্টা

সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.