ক্ষুধা আর ধর্ম…!

ক্ষুধা আর ধর্ম…!

যে ধর্ম ক্ষুধার্তের পেটে অন্ন যোগাতে পারে না, সেই ধর্মের মুখে ইয়ে করে দিলে কি হয় ! একদম ঠিক কথা। এটাও ঠিক, পেটে ভাত না থাকলে ধর্মের কোন বালাই থাকে না।

 আচ্ছা, চাপাতির কোপের সামনে কি ক্ষুধার্তের কোন ক্ষুধার অনুভূতি থাকে? ধরুন, প্রচন্ড ক্ষুধার্ত একটা লোককে যদি চাপাতি নিয়ে তাড়া করা হয়, দৌড়ে পালানোর সময় খাবার দেখলেও কি ও থামবে, খাওয়ার কথা মনে পড়বে? নাকি পূর্ণিমার চাঁদ দেখে ঝলসানো রুটির কথা মনে করে বৈপ্লবিক কাব্যি জেগে উঠবে? চৌদ্দশো বছর আগে এক রাতে লাইন ধরে সারি সারি দাঁড় করানো বুনো কুরাইজা গোষ্ঠীর নিরপরাধ নিরস্ত্র লোকগুলোর ক্ষুধার অনুভূতিটা ঠিক কেমন ছিলো, এক খোদ ধর্ম প্রবর্তক নিজের হাতে যাদের নৃশংস ভাবে খুন করেছিল, নারীদের গণিমতের মাল হিসাবে ভাগ বাটোয়ারা করে দখল নিয়ে ধর্ষণ করেছিল, যৌনদাসী হিসাবে বিক্রি করেছিল? 

ঐতিহাসিক ছেচল্লিশ বা পঞ্চাশে পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বঙ্গ থেকে প্রতিনিয়ত চাপাতির তাড়া খেয়ে বা ধর্ম সম্মত ‘গণিমতের মাল’ হিসেবে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘরের মা বোন মেয়ে বা বউয়ের দিকে ধেয়ে আসা জেহাদীদের নোংরা হাত থেকে বাঁচতে আমাদের পূর্ব পুরুষরা যখন রাতের অন্ধকারে সর্বস্ব ফেলে একবস্ত্রে পালিয়ে আসছিলেন , তখন তাঁদের ক্ষুধার অনুভূতিটা ঠিক কিরকম ছিল… ? ধর্মীয় অনুভূতিটা কিন্তু তখনও ছিল, নাহলে তো পালিয়ে আসত না। শান্তি ধর্মের আশ্রয় নিয়ে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। আচ্ছা, তাঁরা কি ক্ষুধার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন…? চাকরি ব্যবসা জমি জমা অর্থ প্রভাব প্রতিপত্তি – সবই তো তাঁদের ছিল। তাঁরাও তো তখন সেদেশের সমাজ সভ্যতার উন্নতি নিয়ে মগ্ন থাকতেন। তাহলে..? তাহলে ভবিষ্যত সুরক্ষিত রাখতে, নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি রুখতে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই এর চেয়েও বেশি জরুরি নয় কি প্রতিবেশীদের চেনা, তাদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণকারী সাম্রাজ্যবাদী ধর্মীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে জানা এবং জেনে অন্য সবাইকে সচেতন করা, সজাগ করা..? দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব মুক্ত উন্নত সমাজের স্বপ্ন দেখে করবটা কী, আমার অস্তিত্বই যদি না থাকে !

… ছেচল্লিশের ঐ অভিশপ্ত রাতে রাজেন্দ্র লাল রায়চৌধুরীর বাড়িতে রান্না বসানো হয়েছিল, দু’দিনের প্রতিরোধে ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্তদের খাওয়ানোর জন্য। আগুন লাগিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা ঐ ক্ষুধার্ত মানুষগুলি, বলের মত লোফালুফি খেলা রাজেন্দ্রলালের ঐ কাটা মুন্ডুটা বা ধর্ম সম্মত লুঠের মাল অর্থাৎ গণিমতের মাল হিসেবে গোলাম সোরোয়ারের জেহাদী দুই সর্দারের ভাগ করে নিয়ে নেওয়া রাজেন্দ্রলালের সুন্দরী দুই মেয়ের কি ক্ষুধার অনুভূতি ছিল? চোখের সামনে শিকে বাঁধা স্বামী ভাই বা ছেলে জ্যান্ত আগুনে পুড়ছে, পাশেই খড় বিছিয়ে পরিবারের মহিলাদের পা দিয়ে সিঁদুর মুছিয়ে গণ ধর্ষণ করেছে পশুর চেয়েও পাশবিক বর্বররা, এক বিছানায় শাশুড়ি, বৌ আর নাবালিকা নাতনি, একসাথে তিন প্রজন্মকে গণধর্ষণ করেছে ধর্মান্ধ পশুরা – তাদের ক্ষুধার অনুভূতিটা ঠিক কেমন ছিল ? বা শায়েস্তা গঞ্জের জমিদার চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরীর কি তখন ক্ষুধা পেয়েছিলো যখন নিজের হাতে নিজের আদরের সন্তানদের খুন করছিলেন ঐ বর্বর জেহাদীদের হাত থেকে ওদের বাঁচানোর জন্য? বা এখনো, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে লক্ষ বাঙালির আত্মত্যাগে বাঙালির জন্য সৃষ্ট বর্তমান বাংলাদেশ থেকে বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও শুধু হিন্দু অর্থাৎ মালাউন হওয়ার অপরাধে জেহাদী রোষে প্রতিনিয়ত যাদের বাস্তুভিটে ছাড়তে হচ্ছে, তাদের? ভবিষ্যতে যখন এখান থেকেও পালাতে হবে, তখন ক্ষুধার অনুভূতিটা ঠিক কেমন হবে? এখন যারা মার্ক্সবাদের বুলি আউড়াচ্ছে, চাপাতির সামনে তখনও কি এই বুলি আউড়াবে? ঐ পাড়ের কমিউনিস্টরাও কি ঐ সময় আউড়েছিল? যতোই ভুলিয়ে রাখতে চাক আর যতোই ভুলে থাকতে চাই, আমাদের কি এখন ঠিক এই অবস্থাই না ?

শুধুই কি আমাদের পূর্ব পুরুষরা..? কাশ্মীরি পন্ডিত, আফগানিস্তান পাকিস্তানের হিন্দু শিখ বা বৌদ্ধ, ইরানের পার্শীরা, আরবের প্যাগান আরব বা ইহুদী, ইরাক সিরিয়ার ইয়াজিদি খ্রীষ্টান – গণহত্যা আর গণধর্ষণের মুখে উৎখাত হওয়ার সময় ওদের কি ক্ষুধার কোন অনুভূতি ছিলো..?

আগে তো বাঁচতে হবে, তারপর সমাজ সভ্যতা নিয়ে ভাবা যাবে । যেভাবে জেহাদের কালো ছায়া আস্তে আস্তে সারা পৃথিবী গ্রাস করে নিচ্ছে, সবকিছু বাদ দিয়ে এই জেহাদ রোখাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নয় কি?

এমন হচ্ছে না তো, বামপন্থীরা যেমন কথায় কথায় বলে থাকে ধর্মের আফিং খাইয়ে, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজন করে গরিবী , অশিক্ষা, ইত্যাদি মূল সমস্যাগুলি থেকে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখা হচ্ছে, আসলে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো! বামপন্থীরা কথায় কথায় এই গরিবী, অশিক্ষা, বেকারত্ব ইত্যাদির বুলি শুনিয়ে শুনিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের সমূহ বিপদ অর্থাৎ অবশ্যম্ভাবী জেহাদী আগ্রাসন থেকে নজর ঘুরিয়ে রাখছে না তো ? বামপন্থীরা আসলে এক কল্পিত সম্প্রীতির ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে চায় শুধুই আমাদের ঘুমিয়ে রাখতে। চায় এক কল্পিত ধর্মহীন বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নে মশগুল রেখে, ক্ষুধার গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে জেহাদীদের হাতের চাপাতি টাকে আড়াল করে রাখতে । যাতে আমরা, শুধু আমরাই বরাবরের মতো সমাজ বদলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকি, সেক্যুলারিজমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি, আর পেছন থেকে ছুরি চালাতে বরাবরের মতোই অন্যদের সুবিধা হয়…!

মনে রাখবেন, শুধু ক্ষুধা তৃষ্ণা দিয়ে মানুষ হয় না, ক্ষুধা তৃষ্ণা তো কুকুর বেড়ালেরও থাকে। কিন্তু কুকুর বেড়ালের চিন্তা শক্তি থাকে না। আর কোন দেশে বামপন্থা কায়েম হয়ে গেলে সে দেশে কোন ক্ষুধার গল্পই যে আর থাকে না, সে ভেনিজুয়েলা সহ অনেক দেশের মানুষই জানে। আর কোন দেশে ইসলাম কায়েম হয়ে গেলে ক্ষুধার গল্প শোনানো বামপন্থীরাই যে থাকে না, বামপন্থীরাও জানে সেটা।

তাহলে…?

Anirban Dasgupta

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.