মহাত্মা গান্ধীর জীবনদৃষ্টি অনুসরণ করুন

মোহন ভাগবত

আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস তথা স্বাধীন ভারতের উত্থান গাথায় যেসব মহান মানুষের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে, সনাতন কাল থেকে চলে আসা ভারতের ইতিহাসে যাঁরা নিজেরাই এক একটি অধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের মধ্যে পূজ্য মহাত্মা গান্ধী অন্যতম। ভারত আধ্যাত্মিক দেশ এবং আধ্যাত্মিকতার আধারের উপর ভর করেই তার উত্থান হবে। এই দর্শন ও চিন্তা মহাত্মা গান্ধীরও ছিল। ভারতীয় রাজনীতিকে তিনি আধ্যাত্মিকতার আধারশিলার উপরেই দাঁড় করিয়েছিলেন।

গান্ধীজির প্রয়াস কেবল ক্ষমতার রাজনীতির মধ্যেই সীমিত ছিল না। সামাজিক আন্দোলন ও তার নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যে যাতে সাত্ত্বিক আচরণ থাকে, তার উপর তিনি বরাবর জোর দিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থ চরিতার্থ করা, অর্থের লোভ, অহঙ্কার, বিকারগ্রস্ততার কোনও জায়গা রাজনীতিতে নেই বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন মহাত্মা। তিনি এমন এক ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা থাকবে। সত্য, অহিংসা, স্বাবলম্বনের মতো বিষয়ই হয়ে উঠবে এ দেশের জনজীবনের মৌলিক দর্শন। ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় গান্ধীজি এ পথেই হেঁটেছেন।

১৯২২ সালে গান্ধীজি গ্রেফতার হওয়ার পর নাগপুর শহর কংগ্রেস একটি জনসভার আয়োজন করে। ওই সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার। গান্ধীজিকে ‘পূণ্যপুরুষ’ বলে সম্বোধন করে ডাঃ হেডগেওয়ার বলেছিলেন, উনি যে কথা বলেন, সেটাই করে দেখান। ওঁর মত ও পথের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। নিজের মতাদর্শের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতেও উনি মনেপ্রাণে প্রস্তুত। হেডগেওয়ার বলেন, কেবল গান্ধীজির ‘গুণবর্ণনা’ করলে অবশ্য তাঁর মতাদর্শ ও কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। গান্ধীজির এইসব গুণ অনুকরণ করে ব্যক্তিগত জীবনকে সেই পথে চালিত করলে তবেই তাঁর মতের ও কাজের প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে।

পরাধীনতার জন্য কারও কারও মনে যে গোলামির মানসিকতা তৈরি হয়, তা যে কতটা হানিকারক তা গান্ধীজি জানতেন। ওই মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের উন্নয়ন যে সম্ভব, তা তিনি বিশ্বাস করতেন। ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর মধ্যে দিয়ে তেমনই এক স্বপ্নচিত্র আঁকতে চেয়েছিলেন তিনি। অথচ পাশ্চাত্য জগত তখন অন্য উন্মাদনায় বুঁদ হয়ে রয়েছে। ঝাঁ চকচকে ব্যাপারস্যাপার আর বস্তুবাদে তখন তারা বিভোর। তাদের লক্ষ্য তখন একটাই- ক্ষমতার বলে তারা শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থাকে বিকৃত করে গোটা বিশ্বকে আর্থিক ভাবে তাদের গোলাম তথা আশ্রিত করে তুলবে। ঠিক সেই সময়েই গান্ধীজির এই উদ্যোগ, সত্য ও অহিংসার দর্শনে জনজীবনকে সমস্ত দিক থেকে পরিপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা ছিল এক সফল প্রয়োগ। যদিও গোলামির মানসিকতা যাদের মধ্যে চেপে বসেছিল, তারা আগু পিছু বিচার না করেই পশ্চিমের এই জীবনদর্শন ও ভাবনাকেই সত্য বলে মেনে নেয়। তাদের পূর্বপুরুষ এবং পূর্ব গৌরব ও ঐতিহ্যকে হীন ও হেয়জ্ঞান করে আধুনিক হয়ে ওঠার চাটুকারিতায় লেগে পড়ে। তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আজও ভারতের দশায় ও দিশায় প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
পৃথিবীর অন্য দেশের সমকালীন মহাপুরুষরাও গান্ধীজির মত ও পথ দেখে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার পর গান্ধীজির দর্শনকে বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও তাঁরা তাঁদের দেশের জীবনশৈলীর অঙ্গ করে তুলেছেন। গান্ধীজির মৃত্যুর পর আইনস্টাইন তো বলেছিলেন যে, আগামী দিনে মানুষের হয়তো বিশ্বাসও হবে না যে এমন একজন মহান মানুষ জন্মেছিলেন এই পৃথিবীর বুকে। এমনই পবিত্র আচরণ ও বিচারের দৃষ্টান্ত গান্ধীজি আমাদের সামনে রেখেছিলেন।

১৯৩৬ সালে ওয়ার্ধার কাছে সঙ্ঘের এক শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে এসেছিলেন গান্ধীজি। মহাত্মা যেখানে ছিলেন, পরের দিন সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন ডাঃ হেডগেওয়ার। গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনা হয়। তাঁদের পারস্পরিক কথাবার্তা ও প্রশ্নোত্তর এখন বই হিসাবেও প্রকাশিত হয়েছে। বিভাজনের রক্তরঞ্জিত দিনগুলিতে দিল্লিতে তাঁর বাসভবনের কাছে সঙ্ঘের শাখায় গান্ধীজি মাঝেমধ্যেই যেতেন। সঙ্ঘের শাখায় ওঁর বৌদ্ধিক বর্গও হয়েছিল। ১৯৪৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ‘হরিজন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেইসব বৃত্তান্ত। সঙ্ঘের অনুশাসন ও জাত-পাতের ঊর্ধ্বে উঠে মানব সেবা দেখে গান্ধীজি খুবই প্রসন্ন হয়েছিলেন।

‘স্ব’-এর আধারে নতুন ভারতের গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন গান্ধীজি। সমাজে সমানাধিকারের ও সব মানুষের সমান মর্যাদার পক্ষে সওয়াল করতেন তিনি। যে চিন্তা ও মতাদর্শের কথা বলতেন তা সর্বৈব ভাবে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতেন। সমস্ত মানুষের জন্য আদর্শ এই পূজ্য মহান ব্যক্তির মতাদর্শ অনুধাবন করে আমাদের উচিত ব্যক্তিগত জীবনশৈলীকে সেই পথে চালিত করা। ওঁর এই সব গুণের জন্যই, ওঁর সঙ্গে যাঁদের সামান্য মতান্তর ছিল, তাঁরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন।

দেশের মহাপুরুষদের স্মরণ করার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ স্থাপনার দিন থেকেই সকালে একটি স্তোত্র পাঠের রীতি রয়েছে। ১৯৬৩ সালে তা পুনর্বার রচনা করে নতুন করে অনেকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ততদিনে পরলোকে গমন করেছেন গান্ধীজি। তাঁর নামও ওই স্তোত্রে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এখন একে ‘একাত্মতা স্তোত্র’ বলে। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা প্রতিদিন সকালে গান্ধীজির নাম উচ্চারণ করে তাঁর কথা স্মরণ করেন।

গান্ধীজির দেড়শতম জন্মতিথিতে তাঁর কথা স্মরণ করে আমাদেরও সঙ্কল্প নিতে হবে যে, তাঁর ত্যাগময়, পবিত্র জীবন তথা ‘স্ব’- আধারশিলায় গড়ে তোলা জীবনদৃষ্টি অনুসরণ করে আমরাও ভারতকে বিশ্বসেরা হিসাবে গড়ে তুলতে নিজেদের জীবনেও যেন ত্যাগ ও সমর্পণের ভাবনা নিয়ে আসতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.