দুই জেএনইউ দুই বাঙালী মহাপুরুষ ( #NetajiSubhasChandraBose )

এবছর নেতাজী জয়ন্তীর দিনে শহরে আসছেন কানাইয়া কুমার। তিনি ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিআই) দলের ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য। সভার দিন হিসাবে ২০২০ সালের ২৩এ জানুয়ারীকে নির্বাচন করাটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বাংলার সর্বকালের প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। আজ নিরপেক্ষ ইতিহাসবিদরা বলেন যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির বেশিরভাগ কৃতিত্বটাই নেতাজী সুভাষের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও বাঙালী বহুদিন অপেক্ষায় ছিল, রাস্তার মোড়ে মোড়ে জাতীয় পতাকা টাঙিয়ে, নেতাজীর ছবিতে ফুলমালা দিয়ে লিখেছে, “তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ করো।”

কিন্তু সিপিআই দলের জাতশত্রু নেতাজী সুভাষচন্দ্র। কারণ তাদের মতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিডেকি তোজোর কুকুর। ১৯৪২ সালের ১৯ জুলাই সিপিআই দলের মুখপত্র ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকার প্রচ্ছদে একটি কার্টুন ছাপা হয়। একটি গাধার পিঠে বসে আছেন বোমা হাতে হিডেকি তোজো আর গাধার মুখটা চশমা পরিহিত সুভাষচন্দ্র। সেই শুরু। এরপর একটির পর একটি কার্টুন আর লেখা প্রকাশ করতে থাকে সিপিআই। কখনও একটি কুকুরের মত সুভাষ, জাপানিরা তাঁকে ঘাড়ে ধরে মাইকের সামনে বলিয়ে নিচ্ছে। ১৯৪৩ সালের ১৮ জুলাই ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকায় কমরেড জি. অধিকারীর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। হিটলার আর তোজোর দালাল সুভাষচন্দ্রের চক্রান্ত থেকে আমাদের চিনের ভাইদের বাঁচাতেই হবে। অথচ সেই দিনগুলোতেই নিজের সবটুকু সুখ বিসর্জন দিয়ে দেশমাতৃকার শৃঙ্খলামোচনের জন্য প্রাণপাত করছিলেন বীর সুভাষ।

সিপিআই দল তাদের এই কৃতকর্মের জন্য কখনো নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছে? সঠিকএবং স্পষ্ট উত্তর হল, “না”। কারণ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুদের রক্তে যে স্বাধীনতা এসেছে তা হল তাদের ভাষায় ‘ঝুটা আজাদি’। তাই কানাইয়া কুমাররা আজাদি চান দিনরাত। কাশ্মীরে শতশত নিরীহ সাধারণ মানুষের হত্যাকারীদের দিল্লীর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এনে সংবর্ধনা দিয়েছে সিপিআই দলের ছাত্রসংগঠন। যেখান স্লোগান উঠেছে, “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে, ইন্সাল্লা, ইন্সাল্লা”।

ভারতবর্ষের সেনাবাহিনীর উপরেও তাদের চরম অবিশ্বাস। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ কানাইয়া কুমার তখন জেএনইউ স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতি। তিনি প্রকাশ্যে বললেন যে ভারতীয় সেনারা কাশ্মীরে মহিলাদের ধর্ষণ করছে। এইভাবেই নিজের কেরিয়ার তৈরি করেছেন তিনি। জেএনইউ ছিল তাঁর উপরে ওঠার সিঁড়ি।

মজার ব্যাপার হল সংসদে আসন সংখ্যা যতই কম হোক না কেন, বামদলগুলি কিন্তু যথেষ্ট ধনবান। ২০১৭ সালের হিসাব অনুসারে ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) দেশের দ্বিতীয় ধনী দল। প্রথম হল বিজেপি যাদের ঘোষিত আয় ১০৩৪ কোটি টাকা আর তারপরেই সিপিআইএম-১০০২ কোটি টাকা।

এই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানিই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অরাজকতা বাড়িয়ে তুলেছে। অনেকেই “ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে” বা “মাঙ্গে আজাদি”কে কেরিয়ার হিসাবে ভাবছেন। কারোর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের আধিকারিক, কে বড়ঘরের সন্তান, দিল্লীর কোন পাঁচতারা বেসরকারী কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছেন, তাদের চাকরী পেয়ে সংসারকে দেখার তাড়া নেই। বিশ্ববিদ্যালয় যতদিন খুশি বন্ধ যাক, তাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাটাই বড়। সেমিস্টার বন্ধ থাকলে গরীব ছাত্রছাত্রীদের মনের কি অবস্থা হয় সেটা বোঝার ক্ষমতাই এঁদের নেই।

‌জেএনইউতে হস্টেলের ভাড়া ১০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। যদিও প্রায় ৮০০০ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৪৩৫৯ জন এমফিল বা পিএইচডি করছেন। তাঁরা সকলেই সরকারি হারে স্কলারশিপ পান। কিন্তু এর বিরুদ্ধেই সিপিআই দলের ছাত্রসংগঠন এআইএসএ উগ্র আন্দোলন শুরু করেছিল। “স্পেশাল সেন্টার ফর মলিকুলার মেডিসিনের” সামনে চলছিল জেএনইউএসইউএর অবরোধ। বিভাগের অধ্যাপক আনন্দ রঙ্গনাথন তার গবেষণাগারে ঢুকতে চেয়েছিলেন। অধ্যাপক বলেছিলেন যে এই ধরনের গবেষণাগারে জীবিত সামগ্রী তাকে, সেগুলো এভাবে বন্ধ রাখা যায় না।

এই বাধাদানের ঘটনার ভিডিও রেকর্ডিঙ সোশ্যাল মিডিয়াতে বহুলভাবে ছড়িয়ে গেছে। টিভির কল্যাণে পরিচিত নেতৃস্থানীয় মুখগুলিকে ওই ভিডিও ফুটেজেও দেখা যাচ্ছে। কর্তব্যরত সিকিউরিটি কর্মীর সঙ্গে ওই ছাত্রনেত্রী এমনভাবে কথা বললেন যেন উনিশ শতকের কোন উচ্চবংশের সম্ভ্রান্ত কেউ একজন অস্পৃশ্যের সঙ্গে কথা বলছে! এরপর অধ্যাপক রঙ্গনাথনের পালা। জমিদার বাড়ির মেয়ে যেভাবে বাড়ির চাকরের সঙ্গে ব্যবহার করে, ছাত্রীটি (নেত্রী হলেও ছাত্রীই তো!) অধ্যাপকের সঙ্গে তেমন ব্যবহারই করলেন।

আসলে জেএনইউ ক্যাম্পাসে আজ এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ইচ্ছুক ছাত্ররা যাতে নিজেদের নাম রেজিস্ট্রি করতে পারে তার জন্য অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা ছিল। সেটাকে ভণ্ডুল করার জন্যই সার্ভার রুম ভেঙে অপটিকাল কেবল কাটার প্রয়‌োজন হয়েছিল। ছাত্রদের যারা এমন করছেন তাদের চোখে নিজের পড়াশুনা শেষ করে ডিগ্রি পাওয়া নয়, তাদের সফল দাদাদের মতো পাঁচতারা নেতার হওয়ার লক্ষ্যই বড় হয়ে উঠেছে।

কিন্তু জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই আরও একটা জেএনইউ আছে। যেখানে গরীব ঘরের ছেলে, পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর একটি মেয়ে নিজের জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখে। তারা নিজেদের পরম সৌভাগ্যবান মনে করে, কারণ দেশের এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানে তারা পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তাদের সমাজের কত কত ছেলে মেয়ে জেএনইউএর পাঁচিলের বাইরে থেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে গেছে।

এমনই একটি ছেলে রাকেশ কুমার। অত্যন্ত গরীব তপশিলি জাতিভুক্ত পরিবারের ছেলে। গাজিয়াবাদের বিকাশনগরের ৪ নং গলির এই রাকেশ প্রথম প্রজন্মের বিদ্যার্থী। তার বাবা কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরী করেন না আর মা টিভিতে ইংরাজীতে বলতেও পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গরীব ছাত্রদের জন্য পুরাতন হারেই হোস্টেল ফি নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে যখন রেজিস্ট্রেশনের জন্য গিয়েছিল তখন তাকে পিটিয়ে বার করে দিয়েছিল জেএনইউএসইউ সংগঠনের সমর্থকেরা। এরপরে শত শত রাজেশের মতো ছেলে মেয়ে এক হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অনলাইনে ফর্ম ভর্তি করে লেখাপড়া শুরু করেছে।

রাজেশ গত ১২ই জানুয়ারি তার সুপারভাইজার ড. রত্নেশ্বরকে দিয়ে সই করিয়ে নতুন বছরের ফর্ম জমা করেছে। তার ঝিলম হোস্টেলে ফিরে ফুল দিয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের ছবিতে। তাকে কম্প্যুটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে এমটেক করে সফল হয়ে বের হতেই হবে। তার ফেরার পথ চেয়ে আছে তার গরীব বাবা, মা, সমগ্র পরিবার, এমনকি তার গোটা বঞ্চিত সমাজটাই!

স্বামী বিবেকানন্দ। এই দ্বিতীয় এক বাঙালী “টুকরা টুকরা” গোষ্ঠীর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন। এই বাঙালীই তো বলেছিলেন, “হে ভারত ভুলিও না।” এই মহামানবের ডাকেই তো জেগে উঠেছিল ভারতবর্ষ। এই বাঙালী মূর্তি ক্যাম্পাসে থাকলে কীভাবে স্লোগান উঠবে, “ভারত তেরে টুকড়ে হোঙ্গে।” স্বামীজীর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে দেশবিরোধী কতা বলার সাহস হবে? অ্যাডমিনিস্ট্রিটেটিভ ব্লকের ডানদিকে স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তিটি ছিল পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মূর্তির ঠিক উল্টো দিকে। নভেম্বর মাসে উপাচার্যের অফিস তছনছ করার পরে স্বামীজীর মূর্তি ভাঙা হল, নিচে লাল কালিতে লেখা হল ‘ভগবা জ্বলেগা”, মানে “গৈরিক পুড়ে ছাই হবে।”

এই বছরটা বাঙালীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল বাংলার। তার অর্ধেকটা প্রাপ্য পূর্ববঙ্গের বিপ্লবীদের। আজ এত বছর পরে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা অত্যাচারিত মানুষরা ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব পাবেন। তাই দিল্লীর জেএনইউ থেকে কলকাতা, একটা প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে। আগামী প্রজন্ম কি ‘তোজোর কুকুর’ বলে ‘বা ‘ভগবা জ্বলেগা’ লিখে যারা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অপমান করেছেন তাঁদের ক্ষমা করবে?

সত্যান্বেষী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.