বসন্তের আগমনী বার্তা বহনকারী হচ্ছে দোলযাত্রা। পুরাতন বা জীর্ণ জিনিসকে যেমন নতুন রঙে রাঙিয়ে তাকে পুনরায় রাঙিয়ে তোলা হয়, অনেকটা ঠিক তেমনই নতুন বছর আসার আগে হিন্দুরাও নিজেদের সমস্ত জীর্ণ দৈন্যদশাকে ঝেড়ে ফেলে নতুন রঙে রাঙিয়ে তোলে। তাই একে নতুনের আহ্বানও বলা যায়। দোলের দিন আমরা জাতপাত ধর্ম বর্ণ সব ভুলে একে ওপরকে রাঙিয়ে তুলি। তাই এই উতসবকে প্রেমের বা সৌহার্দ্যের উৎসবও বলা হয়।
ইতিহাস > বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী দোল পূর্ণিমার দিন শ্রী কৃষ্ণ রঙ ও আবির দিয়ে শ্রী রাধা ও অন্যান্য গোপিদের সাথে রঙ খেলায় মেতে উঠেছিলেন। দোল খেলার উৎপত্তি সেখান থেকেই। আবার এই দিনটাকে গৌড়পূর্ণীমাও বলা হয়। কারন ১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি শনিবার দোল পূর্ণীমা তিথীতেই শ্রী চৈতন্য মহা প্রভুর জন্ম হয়েছিল।
বঙ্গদেশে দোল উৎসবের সুচনা শ্রী চৈতন্যদেবের দ্বারা হয়েছিল। ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি পুরীধাম ত্যাগ করে বৃন্দাবন গিয়ে সেখানকার রঙ খেলা দেখে অভিভূত হয়ে এই বাংলায় দোল উৎসবের সুচনা করেন। তবে খেলাচ্ছলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাবিলাস কবে শুরু হয়েছিল তা জানা যায় না। কিন্ত বিভিন্ন কবির কবিতায় ও গানে সেই মধুর আখ্যান ধরা পড়ে।
পুরানমতে প্রায় দু হাজার বছরের আগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন গোকুলে হোলি খেলার প্রচলন করেন। তবে ইতিহাসে একাধিক ইন্দ্রদ্যুম্ন থাকায় সঠিকভাবে এনার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নি। এছাড়া রঙ ও গুলাল নিয়ে এই উৎসবের কথা জৈমিনির ‘পুর্ব মীমাংসা সুত্রে’, ভবভূতির ‘মালতি মালব’ নাটকে বসন্তৎসবের কথা উল্লেখ আছে। সপ্তম শতাব্দীতে সম্রাট্ হর্ষবর্ধনের লেখা ‘রত্নাবলি’ নাটকে আমরা হোলি খেলার দৃশ্য দেখতে পাই। এছাড়া সঠিক হোলি খেলা না হলেও কবি কালিদাসের ‘ঋতু সংহার’ কাব্যের বসন্ত বর্ণনায় দেখা যায় যুবতী রমণীরা ফুলের নির্যাস, চন্দন, কুঙ্কুম প্রভৃতি প্রাকৃতিক রঙে খেলাচ্ছলে নিজেদের রঞ্জিত করেছে। আবার আলবারুনির লেখাতেও আমরা ভারতবর্ষের দোল উৎসবের বর্ণনা পাই। শুধু উত্তর ভারতে নয় দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগরের হাম্পিতে একটা মন্দিরের গায়ে এক রাজকুমার রাজকুমারীর রঙ খেলার চিত্র খোদিত আছে। আহমেদ নগর ও ভারতবর্ষের বহু পুরাতন ছবিতে হোলি খেলার বর্ণনা ও চিত্র আছে।
প্রাচীন ভারতে এই উৎসবকে হোলিকা উৎসবও বলা হত। নারদ পুরান ও ভবিষ্য পুরানেও হোলিকা উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায়। বিন্ধ অঞ্চলে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় খ্রীষ্টপুর্ব তিনশ বছর আগেও এই উৎসবের প্রচলন ছিল।
দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত পৌরানিক উপাখ্যান ও লোকগাথাগুলো মুলত দু প্রকার প্রথমটা দোলযাত্রার আগের দিন পালিত বহ্ন্যুৎসব হোলিকা দহন বা নেড়াপোড়া এবং দ্বিতিয়টা রাধা কৃষ্ণের দোল বা ফাগ খেলা কেন্দ্রিক।
পুরানমতে ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত ছিলেন প্রহ্লাদ কিন্ত তার পিতা অসুর রাজ হিরণ্যকশিপু পছন্দ করতেন না পুত্রের এই বিষ্ণু ভক্তি। ভাগবৎ পুরানের সপ্তম অধ্যায় অনুসারে [১-৫] ব্রম্ভার বরে অমরত্ব লাভ করে হিরণ্যকশিপু অহংকারী ও উদ্ধত হয়ে ওঠেন। তার পুত্র তাকে পুজো করতে না চাওয়ায় তিনি তার পুত্রকে বিভিন্ন ভাবে হত্যার চেষ্টা করেন। এব্যাপারে হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকার কাছেও সাহায্য প্রার্থনা করেন। হোলিকার কাছে এক বিশেষ পোষাক ছিল যা তাকে আগুনে পুড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা করত। হোলিকা সম্মত হন এবং তার দাদাকে কোলে বসিয়ে প্রহ্লাদের ওপর আগুন জ্বালিয়ে দেবার পরিকল্পনা করেন যাতে প্রহ্লাদ পুড়ে মারা যান এবং হোলিকার কাছে থাকা বিশেষ আগুন নির্বাপক বস্ত্রের জন্য তারা বেচে যান কিন্তু সেই আগুন জ্বালতেই হোলিকার বিশেষ বস্ত্র খুলে গিয়ে প্রহ্লাদকে আবৃত করে এরফলে হোলিকা পুড়ে মারা যায় এবং পরবর্তীকালে বিষ্ণুর নৃশিংহ অবতারের হাতে হিরণ্যকশিপুর মৃত্যু হয়। হোলিকা দহন বা নেড়াপোড়া উৎসব এই ঘটনাকেই নির্দেশ করে। হোলিকার এই অগ্নদগ্ধ হওয়ার কাহিনীই হোলিকা দহন বা চাচড় উৎসবের সঙ্গে যুক্ত। স্কন্দ পুরান গ্রন্থে ফাল্গুন মাহাত্ম্য গ্রন্থাংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের এই উপাখ্যান বর্ণিত আছে। এই কাহিনী অশুভ শক্তির পরাজয় ও শুভ শক্তিয় সুচনার কথাই বলে। এইদিনটাতে অন্য এক পুরান মতে শ্রী কৃষ্ণকে স্মরণ করার কথাও বলা আছে যাকে হোলিকা ফাল্গাহও বলা হয় এবং এক্ষেত্রে হোলিকাকে বলা হয় পুতনা। শিশু কৃষ্ণ শুধু পুতনার বিষ দুধই পান করেননি তার রক্তও পান করেন এবং পুতনা আগুনে জ্বলে যায় ও কৃষ্ণের গায়ের রঙ নীল হয়ে যায়।
ফাল্গাহ উদযাপনের আগের রাতে পুতনার দহন পালিত হয়। ব্রম্ভ বৈবর্ত পুরাণে আছে কৃষ্ণের ভজনা করার জন্যেই শ্রী রাধার জন্ম হয়। হিন্দু পুরান অনুসারে কৃষ্ণ তার শ্যাম বর্ণের জন্য হতাশ হন তখন তার মা তাকে বলেন তিনি যেন রাধার মুখমণ্ডল রঙ দিয়ে রাঙিয়ে দেন।
পুরাকালে বিবাহিত নারীরা তাদের পরিবারের কল্যানের জন্য মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমায় রঙের উৎসব করতেন। ভারতের বাইরেও ভারতীয় বংশদ্ভুতদের মধ্যে এই উৎসব দেখা যায়। দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপের অনেকাংশে, বেশ কিছু ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং মরিশাসেও এই উৎসব পালিত হয়। গায়নায় এই উৎসবকে বলে ফাগুয়া।
হোলি নিয়ে অন্য একটা পুরান মতে আরও একটা গল্প আছে যা ভালোবাসার জন্যে আগুনে পুড়ে আত্মত্যাগের সাথে সম্পর্কিত। সতীর মৃত্যুর পর মহাদেবের সাথে পার্বতির বিয়ের আগে দেবী পার্বতী শিবকে যোগ ও ধ্যান থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার জন্য বসন্ত পঞ্চমির দিন প্রেমের দেবতা কামদেবের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কামদেব ও রতিদেবী দেবী পার্বতীকে সাহায্য করার জন্য মহাদেবের দিকে প্রেমের তীর ছুড়ে তার ধ্যানে বিঘ্ন ঘটানোয় শিব রাগণ্বিত হয়ে তার তৃতীয় নয়ন খোলেন এবং তার সেই তেজদীপ্ত চোখের চাহনিতে কামদেব ভস্ম হয়ে যান। এই ঘটনায় রতিদেবী বিমর্ষ হয়ে পড়েন ও পরবর্তীতে শিব ও রতিদেবীর বিবাহ হয়। এই বিয়ের সময় রতিদেবী শিবের কাছে প্রার্থনা করেন যাতে কামদেবকে তিনি পুনরায় তার কাছে ফিরিয়ে দেন। দেবাদিদেব সন্তুষ্ট হয়ে সম্মত হন এবং কামদেবকে সত্যিকারের আবেগের একটা বাস্তব সত্তা হিসেবে ফিরিয়ে দেন। প্রেমের দেবতার এই ফিরে আসা বসন্ত পঞ্চমীর চল্লিশ দিন পর হোলি হিসাবে পালিত হয়। কামদেবের কিংবদন্তী ও হোলি উৎসবের তাৎপর্যের বিভিন্ন প্রকরন দক্ষিণ ভারতে দেখা যায়।
ঐতিহ্যগত ভাবে অহিন্দুদের মধ্যে যেমন, জৈন,নেপালের বৌদ্ধদের মধ্যেও এই উৎসব দেখা যায়। শিখরাও এই উৎসব পালন করে, উনিশ শতক জুড়ে। শিখ ধর্মের ইতিহাসে একে ‘হোলা’ বলা হয় শিখদের শেষ ধর্মগুরু গুরু গোবিন্দ সিং হোলিকে পরিবর্তন করে তিনদিনের হোলা মহল্লা উৎসবে পরিনত করেছিলেন যেখানে মার্শাল আর্টও অন্তর্ভুক্ত হয়। আনন্দপুর সাহিবের পর হোলি উৎসবের এই বৃদ্ধির সুচনা ঘটে। মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের সময়ও শিখ সাম্রাজ্যে হোলি খেলার উল্লেখ আছে। সেই উৎসবের সংস্কৃতি ভারত ও পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে বিস্তৃত হয়। ট্রিবিউন ইন্ডিয়ার একটা প্রতিবেদন অনুসারে শিখ দরবারের নথি বলছে ১৮৩৭ সালে লাহোরে ৩০০ পাউন্ডেরও বেশি রঙের ব্যবহার হয়েছিল। রঞ্জিত সিংয়ের উদ্যোগে লাহোর দূর্গে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রার ছবি আকা হয় এবং তৎকালীন ব্রিটিশ কর্মকর্তাগনও এই উৎসবে যোগদান করতেন। দোল বা হোলি উৎসবে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রবনতাও লক্ষ্য করা যায়। কারন বসন্তকালে গাছের ঝরা পাতা শুকনো ডাল জড়ো করে পোড়ানো হয় দোলের আগের দিন (নেড়াপোড়া, চাচড় বা হোলিকা উৎসব)। যার ফলে প্রাকৃতিক কিছু বর্জ্য পদার্থ জ্বালিয়ে পরিবেশ পরিস্কারও হয়।
বৈষ্ণব ধর্ম ছাড়াও শাক্ত ও শৈব ধর্মেও এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসব একদিকে যেমন প্রেমের উৎসব ওপরদিকে তেমনই অশুভ শক্তির পরাজয়ের মাধ্যমে শুভ শক্তির সুচনা বা শত্রু নিধনের উৎসবও বলা যেতে পারে। এটা হিন্দু ধর্মের একটা সামাজিক মেলবন্ধনেরও উৎসব বটে।
সুনন্দ মিত্র
সৌজন্য স্বীকার:-banglaexpress.in and bn.m.wikipedia.org. বা দোলযাত্রা উইকিপিডিয়া