মমতা ব্যানার্জীর অর্থমন্ত্রী হবার খবরে যারা অবাক, তাঁদের জানা উচিৎ অমিত মিত্র কোন দিনই অর্থমন্ত্রী ছিলেন না l উনি একজন অফিসারই ছিলেন, যার কাজ ছিল হিসেব মেলানো l মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতায় আসার আগেই আগামী দিনের বাজেটের দিক নির্দেশ করে রেখেছিলেন l তাঁর 2009, 2010 এবং 2011 র রেল বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে উনি 2011 তে মুখ্যমন্ত্রী হবার ব্যাপারে কতটা নিশ্চিত ছিলেন এবং তাঁর ভবিষ্যতের বাজেটের প্রস্তুতি কিভাবে নিচ্ছিলেন রেল মন্ত্রী হিসেবেই l রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কোন খাতে উনি খরচ করবেন এবং কোন খাতে করবেন না, এই ব্যাপারে উনি কতটা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছেন, সেটা ওনার রেল বাজেট দেখলেই বোঝা যায় l তার আগে, গত দশ বছরের বাজেটের মূল দর্শনটাকে একবার বুঝে নেয়া যাক l
যে কোন রাজ্য সরকার মূলতঃ যে যে খাতে খরচ করে তাঁর মধ্যে আছে সরকারি কর্মীদের মাইনে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের খরচ, মৌলিক (বেসিক ) পরিকাঠামো (সড়ক, বিদ্যুৎ, সেচ, জলপথ, পানীয় জল এবং পরিবেশ ), শিল্প পরিকাঠামো, পরিকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ বাবদ খরচ (Resettlement & Rehabilitation ) এবং সামাজিক ক্ষেত্র (যেমন কন্যাশ্রী, বেটি বাঁচাও, আয়ুষ্মানভারত, স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি ) l এর মধ্যে শেষ ক্ষেত্রে যত বেশী খরচ করা যায়, ভোট তত বেশী পাওয়া যায় l পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেটাই করেছে এবং তৃণমূলের নির্বাচনী সাফল্য তাঁর প্রমান l এখন প্রশ্ন বাকী রাজ্যগুলি সেই রাস্তায় যায় না কেন? এমনকি আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশ কেন এতো টাকা সড়ক, রেল, বন্দর, পানীয় জল থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লাস্টার তৈরিতে খরচা করছে? কারণ, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভীত তৈরি করছে তাঁরা l তাতে হয়তো তাৎক্ষণিক ভোটের রাজনীতিতে ফল পাওয়া যায় না l তবু সন্তানের জন্য কিছু রেখে যেতে হয় পিতাকে l সব টাকা সন্তানকে ওড়াতে দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার থেকে সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কিছুটা অপ্রিয় হওয়া শ্রেয় মনে করে পিতা l
কিন্তু মমতা ব্যানার্জী মুখ্যমন্ত্রী হবার আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি পারিকাঠামো খাতে ন্যূনতম খরচ করবেন l একটা ছোট্টো উদাহরণ দিলে এটা বোঝা যাবে l সেটা হল কলকাতার মেট্রো প্রকল্প l কলকাতায় এখন ছয়টি মেট্রো প্রকল্পে কাজ চলছে l প্রথমটি KMRCL নামে একটি রেল অধীনস্ত কোম্পানির অধীনে যার নাম ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো (হাওড়া থেকে সল্টলেক) l 2006-07 এ বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক এবং রাজ্য নগরোন্নয়ন দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে এই কোম্পানি তৈরি করেন l কলকাতা বাদে দেশের সব মেট্রো প্রকল্পে এই মডেলেই কাজ হচ্ছে l প্রসঙ্গত, মিডিয়ার দৌলতে, 99% বাঙালী জানেই না যে মেট্রো রেল মন্ত্রকের বিষয়ই নয়, এটা নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের বিষয় l কিন্তু মমতা ব্যানার্জী 2009 তে রেলমন্ত্রী হয়ে দেখলেন দুই বছর পরে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় এলে এই 50% মালিকানা তথা খরচের দায় তাঁর কাছে একটা বোঝা হয়ে দাড়াবে l বরং এই খাতে বরাদ্দ টাকা যদি সামাজিক খাতে খরচ করা যায় তবে জনপ্রিয়তা বাড়বে l মনমোহন এবং সোনিয়াকে চাপ দিয়ে উনি এই কোম্পানিকে রেলের অধীনে নিয়ে এলেন l শুধু তাই নয়, 2009 বাজেটে গাড়িয়া এয়ারপোর্টে, জোকা বিবিদিবাগ, দমদম দক্ষিনেশ্বর, দমদম বারাকপুর, দমদম বারাসাত মেট্রো ঘোষণা করলেন, যা রেল মন্ত্রকের বিষয়ই নয় l অর্থাৎ, দেশের প্রতিটি রাজ্য তাঁদের মেট্রো রেল বানাতে 50% খরচা করবে, ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ l মুখ্যমন্ত্রী হবার আগেই উনি ঠিক করে ফেলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কোন কোন খাতে খরচা করবেন না এই ধরনের বড় পরিকাঠামো উন্নয়নে l ফলে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাজেট ডঃ অমিত মিত্র পেশ করলেও তাঁর প্রস্তুতি মমতা ব্যানার্জী বহু আগেই নিয়ে রেখেছিলেন l অমিত মিত্র অংক মেলাতেন, কিন্তু দর্শন, ভাবনা পুরোটাই মমতা ব্যানার্জীর l
আরও একটি ঘোষণা উনি মুখ্যমন্ত্রী হবার আগে করছিলেন l সেটি হল, তাঁর সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে না l এখানেও উনি ভবিষ্যতের বাজেটের থেকে বড় টাকা বাঁচিয়ে রাখলেন l শিল্প ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে জমি কেনার টাকা সহজেই সামাজিক খাতে খরচ করা গেছে l এক্ষেত্রেও মমতা ব্যানার্জীর রাজনৈতিক ভাবনাই ডঃ মিত্র বাজেটে বড় অক্সিজেন জুগিয়ে এসেছে l
আরও একটি বড় ক্ষেত্র হল ম্যাচিং গ্র্যান্টে খরচ, যেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার গত দশ বছরে কোন বরাদ্দ করে নি l এই ব্যাপারটা বোঝা দরকার l যে কোন পরিকাঠামো প্রকল্পে কেন্দ্র কিছু টাকা দেয় এবং রাজ্য বাকীটা দেয় l রাজ্যের দেয়া এই অংশটিকে বলে ম্যাচিং গ্রান্ট l মমতা ব্যানার্জী কেন্দ্রের দেয়া একের পর এক প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করে এই ম্যাচিং গ্র্যান্টে বাবদ বরাদ্দ নিজের বাজেটে কম রাখতে ডঃ মিত্রকে সাহায্য করেছেন যাতে ওই টাকায় বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে বিনিয়োগ করা যায় l উদাহরণ হিসেবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সাগরের গভীর সমুদ্র বন্দর, যা শুধু পশ্চিমবঙ্গকে এগিয়ে নিয়ে যেত না, পিছিয়ে পড়া গঙ্গা অববাহিকাকে আবার পুরোনো গৌরব ফিরিয়ে দিতে পারতো l নীতিন গতকারীজী 2016 তে এই প্রকল্পের ছাড়পত্র দেন l মমতা ব্যানার্জী নিজে এর নাম দেন ভোর সাগর বন্দর l কিন্তু পরে উনি যখন দেখেন রাজ্য সরকারকে ম্যাচিং গ্র্যান্টের কয়েক হাজার কোটি টাকা দিতে হবে, উনি প্রকল্প নিয়ে বেঁকে বসেন l প্রকল্প সরে যায় তাজপুরে l নতুন করে সমীক্ষা, ডিসাইন এবং আর্থিক বিশ্লেষণ শুরু হয় l এখনো নতুন প্রকল্প পাশ হয় নি l
মমতা ব্যানার্জীর বাজেটের আরও একটা দিক. আছে যা এককথায় অতুলন l উনি স্থায়ী কর্মী নিয়োগের ভীষন বিরোধী l প্রায় সব দপ্তরেই এক অবস্থা l শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে এর প্রভাব সবচেয়ে খারাপ l সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমার মুকুন্দ লাহিড়ীর মতে নায়ক যেমন অপরিহার্য, তেমনি আমরা সবাই জানি সেরা শিক্ষক ও ডাক্তারের বিকল্প নেই l একজন সেরা ডাক্তারকে চারজন সাধারণ ডাক্তার দিয়ে প্রতিস্থাপন অসম্ভব l তাছাড়া সরকার শিক্ষক ও ডাক্তারদের অবসরের পরে আবার পুনর্নিযোগ করছে খরচ বাঁচানোর জন্য l এর ফলে নতুন মেধা সুযোগ পাচ্ছে না বছরের পর বছর l এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সমাজে বেশ নেতিবাচক l আর এই ভাবনা ডঃ অসীম দাশগুপ্তের অর্থনীতি থেকে পাওয়া l 1991 তে দেশের আর্থিক সংস্কারের জন্য ডঃ মনমোহন সিং তাঁর যে কৃতী ছাত্রকে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকরি ছড়িয়ে এনেছিলেন, সেই অমিত মিত্রের ভাবনা এটা নয় l
অমিত মিত্রর একমাত্র ইতিবাচক অবদান রাজ্য সরকারে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু l হয়তো মমতার অনুপ্রেরণা এতে থেকে থাকবেl কিছু সচ্ছতা এসেছে নিঃসন্দেহে l কর বেড়েছে বহুগুণ l (2011 পর্যন্ত বহু দপ্তরে মাইনেইও নগদে দিতেন আমাদের পূর্বতন অর্থমন্ত্রী তথা MIT ফেরত অর্থনীতিবিদ ডঃ অসীম দাশগুপ্ত l )
তবে বাজেট কিন্তু মমতা ব্যানার্জীরই l ওই করের টাকা কোথায় খরচা হবে, সেটা ঠিক করেন মমতা ব্যানার্জীই l তাঁর অর্থনীতির একটাই ফর্মুলা l করের টাকার অধিকাংশ মানুষের হাতে তুলে দাও l আর এরজন্য আমেরিকা থেকে পাশ করা অর্থনীতিবিদের কোন প্রয়োজন নেই l মমতা ব্যানার্জীই যথেষ্ট l
এবার আসি মূল প্রশ্নে l অর্থমন্ত্রী হবার জন্য কি ইকোনমিক্স নিয়ে পড়াশুনা করা জরুরি? স্বাস্থ্য দপ্তর চালাতে যদি ডাক্তার হওয়া জরুরি না হয়ে থাকে, কিম্বা বিদ্যুৎ, পূর্ত, সেচ, জনস্বাস্থ্য দপ্তর চালাতে যদি ইঞ্জিনিয়ার না প্রয়োজন হয়, তবে অর্থ দপ্তর চালাতে ইকোনমিক্স এ ডিগ্রির প্রয়োজন কোথায়? অশোক মিত্র, অসীম দাশগুপ্তের চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং যশবন্ত সিং, যশবন্ত সিনহা, প্রণববাবু , অরুন জেটলিদের কাজের ফিরিস্তি আরেকদিকে রাখি, তবে অর্থমন্ত্রী পদে ইকোনমিক্সর ডিগ্রির দরকার কেন হবে? অন্ততঃ পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে লক্ষ্য নিয়ে চলছে, অর্থাৎ ‘করের অধিকাংশ টাকা মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার অর্থনীতি’, তাতে ওই পদে ইকোনোমিস্ট একেবারেই প্রয়োজন নেই l
সুদীপ্ত গুহ