ভারতবাসী তর্কশীল, আর বাঙ্গালি স্বভাবতই তর্কপ্রিয়। ভারতের বৈশিষ্ট্যই হলাে কোনও বিতর্কিত বিষয়ে তর্কসভা বসিয়ে আলােচনা আর বিতর্কের মাধ্যমে বিবাদিত বিষয়ের সমাধান করা। এই পরম্পরা ভারতে প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যমান। যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী-গার্গী, মণ্ডন মিশ্র এঁদের ঐতিহ্য ভারতীয়দের তর্কশীল করে তুলেছে। সহিষ্ণুতা দান করেছে। তবে সে সহিষ্ণুতা অন্যায়ের প্রতি নয়। সেখানে তাকে ‘বজ্রাদপি কঠোরাণি’ হবার কথাই বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি বাজারি পত্রিকায় জনৈক আহমেদের অনুপ্রবেশকারী এবং উইপােকা নামাঙ্কিত প্রবন্ধটি পড়ে বিষয়টি আবার চিন্তায় আঘাত করল। সােশ্যাল মিডিয়া জুড়ে নানাজনের নানা মন্তব্য আমাদের চিন্তিত করে দেয়। কিন্তু একটা বিষয়, সেখানে সবাই নিজের মন্তব্য করতে পারে। কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সে সুযােগ নেই। কিন্তু তর্কশীল ভারতীয় তত্ত্ব মানতে হলে সে সুযােগ থাকা বাঞ্ছনীয়। আর সেটা না থাকলে শুধু ভঙ্গি দিয়ে চোখ ভােলানােই হবে। একটা ন্যারেটিভ থাকলে তার বিপ্রতীপে অন্য ন্যারেটিভও থাকবে। উভয়কে পাশাপাশি স্থান দেওয়াই সুস্থ গণতন্ত্র। কোনও একটাকে দাবিয়ে রাখলে সুস্থ গণতন্ত্রের বিকাশ হতে পারে না।
বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের সুস্থ গণতান্ত্রিক বিকাশে দ্বিচারিতাই প্রধান অন্তরায়। বুদ্ধিজীবী ও গণতন্ত্রপ্রেমী তাদের একতরফা মতামত দেবেন কিন্তু তার বিপ্রতীপে যে মত তার প্রকাশে সর্বতােভাবে বাধা সৃষ্টি করবেন এটা চলতে পারে না। এই বঙ্গে আজ পক্ষপাতপূর্ণ মতামতই প্রাধান্য পায়। বিরুদ্ধ মতের স্থান নেই।
সম্প্রতি অনুপ্রবেশকারী, শরণার্থী, উইপােকা ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা হচ্ছে। এই আলােচনায় বস্তুনিষ্ঠার স্থান নিচ্ছে এক পক্ষপাতমূলক আবেগ। অথচ, বিষয়টির আলােচনায় আরও বেশি আবেগহীন বস্তুনিষ্ঠা আশা করা যায়। ভারতের অনুপ্রবেশকারী আলােচনায় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটটি না বিশ্লেষণ করলে তা অসম্পূর্ণ এবং অর্ধসত্য হয়ে যায়।
শ্ৰী আহমেদের আলােচনায় বিশ্বের অনেক দেশের প্রসঙ্গ এসেছে কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলির কোনও প্রসঙ্গই আসেনি। মানবের অবমূল্যায়ন প্রসঙ্গে রােয়ান্দা, জার্মানি ইত্যাদি দূরের দেশের উদাহরণ দিয়েছেন আমাদের দেশের মানবিক অবমূল্যায়ন প্রসঙ্গে। তার আলােচনায় আমাদের নিকট প্রতিবেশী চীনের ইউঘুর, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমারের প্রসঙ্গ কেন এল না বুঝলাম না। এটা কি ইচ্ছাকৃত?
মনুষ্যত্বের অবমূল্যায়ন, উদ্বাসনে এই দেশগুলির চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোনও দেশে আছে কি? অন্যান্য দেশের উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা হাজারে হাজারে; আর পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে উৎখাত হওয়া মানুষের সংখ্যা লাখ লাখ ছাড়িয়ে কোটিও ছাড়িয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এই উদ্বাসনের দ্বিতীয় কোনও উদাহরণ নেই। আজও আমাদের মধ্যে এমন লাখ লাখ মানুষ রয়েছেন যারা ওই উদ্বাসন ও অত্যাচারের শিকার। শ্ৰী আহমেদের কী এদিকে দৃষ্টি পড়ে না; তাই ওই দূরের পানে তাকানাে! আমাদের একই ভাষার, একই ভৌগােলিক পরিবেষ্টনীর মানুষদের যেভাবে যে দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা, শারীরিক অত্যাচার করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল সে আখ্যান কি আহমেদবাবু জানেন না?
এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ বােধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘উদ্বাস্তু’ পুস্তকে সেই অবর্ণনীয় ঘটনার উল্লেখ করেছেন। দেশভাগের ঠিক পরে পরেরই এই ঘটনা। এক গ্রাম্য বধূ পুকুরে স্নান করছেন, হঠাৎই খেয়াল করলেন, পুকুরের চারপাশে যুবক, মাঝবয়সি অনেক মানুষ ভিড় করেছে। হঠাৎই পুকুরের একদিক থেকে আওয়াজ উঠল, ‘পাক, পাক, পাকিস্তান’ অন্যদিক থেকে প্রত্যুত্তর হলাে, ‘হিন্দুর ভাতার মুসলমান’। এক প্রৌঢ় মুসলমান অন্য এক যুবককে বলল, ওরে তাের চাচিজানের পা অসাড় হয়ে গেছে, ওকে ধরে টেনে তুলে আন। ওই গ্রাম্য বধূর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এছাড়া হিন্দুদের ‘মালাউন’ ও নানা নামে গাল দেওয়া তাে আছেই। আমার এক মামাতাে ভাই তার বাল্যকালের বিদ্যালয়ের বন্ধুদের তাকে “মালউন’ বলে খ্যাপানাে আজও ভুলতে পারে না। শ্ৰী আহমেদ এবং অন্য বুদ্ধিজীবীরা এই অন্য ‘ন্যারেটিভ’টাও খেয়ালে রাখুন। দূরের রােয়ান্দা, জার্মানি, দক্ষিণ আমেরিকার ঘর পােড়া দেখুন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং চীনের ইউঘুরদের বিষয়েও দিক্পাত করুন।
রাষ্ট্র সঙ্ঘের এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্থান থেকে ধর্মীয় এবং সংস্কৃতিগত কারণেই হিন্দু-শিখ- বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এঁরা অত্যাচারিত হয়েই এদেশে এসেছেন; সুতরাং তাঁরা শরণার্থী’; মুসলমানরা ওই দেশগুলিতে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে বিতাড়িত হননি। তারা রােজগার অথবা জীবিকার্জনের জন্য অথবা অন্য উদ্দেশে এসেছেন। সুতরাং এই সংজ্ঞা অনুযায়ী তারা ‘অনুপ্রবেশকারী’। তাই তাদের ফেরত পাঠানােরই কথা। আজকের দিনে বেশি জনসংখ্যা যে কোনও দেশেরই সমস্যা, এই সমস্যা কোনও দেশ বাড়তে দিতে পারে না; ভারতই বা দেবে কেন?
বিনয়ভূষণ দাশ
(লেখক প্রাক্তন ব্যাঙ্ক আধিকারিক ও ইতিহাস গবেষক)