পর্ব ২
ভারতীয় , বিশেষ করে বঙ্গ , কলিঙ্গ , দক্ষিণভারত এবং পশ্চিমভারত যে দক্ষ ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারে, ইতিহাস তার প্রমাণ দেয়। পেরিপ্লাসের লেখা থেকে শুরু করে মার্কো পোলোর বর্ণনাতেও বঙ্গের বাণিজ্য বা বহির্বিশ্বে গঙ্গাবন্দরের বাণিজ্যের কথা বেশ ফলাও করে লেখা আছে। বস্ত্র থেকে শুরু করে চিনি গুড় লবণ নারকেল পান সুপুরি – বিদেশে রপ্তানি করতে বাংলার জুড়ি বাস্তবিকই ছিল না। জাহাজ-ভর্তি পণ্যসামগ্রী পাড়ি দিত বিদেশে। তেমনি ভর্তি-জাহাজ ধনসম্পদ দেশের মাটিতে এসে পৌঁছত। তাম্রলিপ্ত বন্দরের যে জগৎজোড়া খ্যাতি ছিল – তা তো জানা কথাই। এই খ্যাতি পরিচয় মেলে বঙ্গের প্রাচীন মুদ্রাতে। খ্যাতি ও অখ্যাতি দুটোরই।
খ্রিস্টিয় শতকের বেশ কিছু বছর আগে থেকেই বাংলায় মুদ্রার প্রচলন। মহাস্থান শিলালিপিতে মিলেছিল গণ্ডক ও কাকনিক নামের দুটি মুদ্রার কথা। পেরিপ্লাসের গ্রন্থে মেলে, গঙ্গাবন্দরে প্রচলিত ক্যালটিস নামের মুদ্রার কথা। অনুমান, সেই মুদ্রা ছিল সোনার। এমনিতে বঙ্গে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন বেশ ভালোই ছিল। রাজশাহী, মৈমনসিংহ, তমলুক, ঢাকায় প্রাচীন স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে কালীঘাটে ২০০ স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়াও যশোরে, হুগলিতেও স্বর্ণমুদ্রার হদিশ মিলেছিল। সোনার এই প্রাচুর্য দেশের সমৃদ্ধিকেই প্রকাশ করে। একটি সোনার মুদ্রা ছিল ১৪২ মাষ। বঙ্গ কুষাণ সাম্রাজ্যর অধীনে ছিল না। কিন্তু কুষাণ যুগের মুদ্রাও বঙ্গে পাওয়া গিয়েছে। যা প্রমাণ করে, সর্বভারতীয়ক্ষেত্রেও বঙ্গ বাণিজ্যের একটা বিস্তৃতি ছিল।
তবে, অদ্ভুত ব্যাপার এটাই, রুপো খুবই অপ্রতুল ছিল বঙ্গে। রুপোর মুদ্রার হদিশ প্রায় মেলেনি বললেই চলে। বিশেষ করে গুপ্ত যুগে যেন রুপোর মুদ্রা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গুপ্ত আমলের শেষে বাংলায় অরাজকতা দেখা দেয়। মাৎসন্যায় বাংলার অর্থনীতিকে বেশ গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাতে দেশের সমৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছিল। এরপর পাল আমলে দেশে সুশাসন ফেরে। তার সঙ্গে ফেরে রুপোর মুদ্রাও। পাল আমল থেকে বাংলায় আর কোনো স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায় না। তার জায়গা নেয় রুপো ও তামার মুদ্রা। শ্রীবিগ্রহের নামে রুপোর মুদ্রার হদিশ মিলেছে নানাস্থানেই। অনেকেই মনে করেন, গুপ্ত আমল থেকে বঙ্গের বাণিজ্যের অধঃপতন। বিশ্ববাণিজ্যে ততদিনে অন্যের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তারপর দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, প্রতিবেশী রাজ্যর আক্রমণের ভয়, মাৎস্যন্যায় – সব মিলিয়ে বঙ্গের বাণিজ্যকে কোণঠাসা করেছিল।
পাল আমলে তাও রুপো ও তামার মুদ্রা দেখা গেলেও, সেন আমলে সেসব উঠে গিয়ে বাজার দখল করে কড়ি। কড়ি আগেও ছিল। তবে তার একচ্ছত্র আধিপত্য এই সেনবংশ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমলের গোড়া অবধি বহাল ছিল। বহির্দেশ বা অন্তর্দেশ- সমস্ত বাণিজ্যর ক্ষেত্রেই উর্ধ্বতম, নিম্নতম মুদ্রা বলতে ছিল কড়ি। চর্যাপদে কড়ির ব্যবহার সম্পর্কে লেখা আছে। মিনহাজউদ্দিনের লেখাতেও মেলে যে, বাংলাতে কোথাও রুপোর মুদ্রা পাওয়া যায়নি। এমনকি রাজাও যখন কাউকে কিছু দান করতেন, তা কড়িই হত। লক্ষ্মণসেনের নিম্নতম দান ছিল এক লক্ষ কড়ি। খুব আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, পালযুগে তাও ধাতব মুদ্রার একটা প্রচলন ছিল। কিন্তু সেনযুগে তা পুরোপুরি অবলুপ্ত৷ এমনকি সেন রাজারাও তা শুরু করার কোনো চেষ্টা করেনি। ত্রয়োদশ বা পঞ্চদশ শতকেও কড়িই বিনিময় হত।
প্রাচীন ভারতের সমুদ্র যাত্রা সঙ্গে জড়িত ছিল বেশ কিছু প্রথা ।প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় উপকূল অঞ্চলেরসঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিস্তৃত ছিল সমগ্র পৃথিবীর। পারস্য উপসাগর, আরব সাগর হয়ে সুমেরীয়, কেলডীয়, আক্কাদীয়, ব্যবিলনীয় ও মিসরীয় সভ্যতার জনগোষ্ঠীর এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতীয় বঙ্গ , কলিঙ্গ ইত্যাদি অঞ্চলের বণিকদের ছিল পণ্য আদান-প্রদানের সম্পর্ক। সেসব সময়ের অনেক নথিপত্র, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজও রয়েছে বিস্তর।
আমাদের মঙ্গলকাব্যগুলি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সওদাগরদের প্রবল উপস্থিতি। চাঁদ সওদাগরের প্রভাব ও প্রতিপত্তির কথা আমরা জানতে পারি, যখন সে স্বয়ং দেবীকেই প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে; যদিও পরিণামে তার বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছে; কিন্তু সওদাগরের বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ভিত্তি হলো নৌ-বাণিজ্যের অর্থনৈতিক শক্তি। পূর্ববঙ্গ গীতিকায় সাগর পাড়ি দেওয়ার আছে অসংখ্য গল্প।
প্রাচীন ব্রতকথাগুলোতে দেখা যাবে, বাবা-ভাই-স্বামীর বাণিজ্য যাত্রা নিয়ে বাড়িতে থাকা মেয়েরা স্বজনের মঙ্গল কামনা করছে, ব্রত পালন করছে, সুরে সুরে গাইছে মঙ্গলগীতি :
‘ভেলা! ভেলা! সমুদ্রে থেকো/ আমার বাপ-ভাইকে মনে রেখো !’অথবা,’সাগর! সাগর! বন্দি।/তোমার সঙ্গে সন্ধি।/ভাই গেছেন বাণিজ্যে,/বাপ গেছেন বাণিজ্যে,/সোয়ামি গেছেন বাণিজ্যে।/ ফিরে আসবেন আজ’… কিংবা, ‘কাগা রে! বগা রে! কার কপাল খাও?/ আমার বাপ-ভাই গেছেন বাণিজ্যে, কোথায় দেখলে নাও।’
উড়িষ্যার জনগণ যেমন সেই অনুষ্ঠানাদি আজও মেনে চলেন। আবার তেমন বাইরে বৃহত্তর ভারতের দেশগুলিতেও পালন করা হয় সেই উৎসব । তৎকালীন বঙ্গ এবং কলিঙ্গর সঙ্গে সামুদ্রিক পথে বালির যোগসূত্র বহুকালের। উড়িষ্যায় আজও বৈঠাবন্দনা বলে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানের আরেকটি নাম #বালিযাত্রা। কলিঙ্গ রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত ছিল অধুনা তেলেঙ্গানার উত্তরভাগ থেকে সমগ্র উড়িষ্যা হয়ে উত্তর-পশ্চিম অন্ধ্রপ্রদেশ এবং বেশ কিছুটা মধ্যপ্রদেশের অংশসমূহ নিয়ে। মহানদী এবং গোদাবরী নদীর বিস্তারিত অঞ্চল নিয়ে ভারতবর্ষের অন্যতম বিখ্যাত এই রাজ্যটি পরিচিত ছিল। আর এই বৈঠাবন্দনা বা বালি যাত্রা অনুষ্ঠান মূলত কলিঙ্গের বৈশ্য সম্প্রদায় যেদিন পালতোলা নৌবহরগুলি নিয়ে বালি , জাভা ,সুমাত্রা তথা সুবর্ণভূমি উদ্দেশ্যে যাত্রা করত , সেইদিন পালন করা হতো। এই দিন বণিক গৃহের মা ,বোন, স্ত্রী, কন্যাগণ তাঁদের প্রিয়জনদের যাত্রা নির্বিঘ্নে হয় সেই কামনা করে , সৌভাগ্য এবং সমৃদ্ধি কামনা করে, শুভ যাত্রার কামনায় বারিদেবতা এবং সমুদ্রদেবতার নিকট প্রার্থনা করে ধূপ, দীপ ,পুষ্প জলে ভাসিয়ে দিতেন। এই লোকাচার কলিঙ্গ বা উৎকল বা উড়িষ্যার বহু লোককাহিনীর সঙ্গে জড়িত আছে। আজও উড়িষ্যার জনগণ এই উৎসব শ্রদ্ধা এবং ভক্তির সঙ্গে পালন করে থাকেন। আবার একই উৎসব থাইল্যান্ডের মানুষজনও পালন করেন। সেখানকার মানুষ একটি বিশেষ তিথিতে পুষ্প, দীপ জলে ভাসিয়ে মঙ্গলকামনা করেন আপনজনের জন্য। সেখানে এই উৎসবের নাম লয়ক্র্যাথং।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য , যে ব্যবসায়ী ও জ্ঞানীগুণী জনের ঐসকল দ্বীপে পৌঁছনোর বৃত্তান্ত আমরা জানতে পারি তাঁদের মধ্যে বেশকিছু মানুষ ছিলেন উত্তর ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের মিশ্র জাতি। এনারা বণিক সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন , আলেকজান্ডারের সময় সমুদ্রপাড়ি দিতেন, যেমন দিতেন বঙ্গের মানুষজন, গঙ্গারিডিরা। তাঁরা আরো কিছু ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্য, মৌর্য যুগের মানুষ ।
ভাগ্য অন্বেষণে জন্য যুগ-যুগান্তরে মানুষ সমুদ্রে ভেসেছেন। পৌঁছে গেছেন নিত্যনতুন দেশে। আর এই বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে ভারতবর্ষের মহাকাব্যের সম্ভার পৌঁছে গেছে সেই সমস্ত নতুনদেশের মানুষের কাছে। ফলে, ভারতবর্ষের সকল উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ঐতিহ্য দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে । সনাতনী মার্গীয় বিভিন্ন পন্থা , যেমন – মূল সনাতন ধর্ম , বৌদ্ধ , বৈষ্ণব, শৈব , তন্ত্র সকল ভাবই ভারতীয় উপমহাদেশের কোনায় কোনায় পৌঁছে গিয়েছিল এইভাবে । প্রাচীনকাল থেকে আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও যেমন , আমরা রামায়ণ মহাভারত কে উপেক্ষা করতে পারি না, তেমনি উপেক্ষা করতে পারিনা বৃহত্তর ভারতবর্ষের দ্বীপময় দেশ গুলিকে । রামায়ণের ব্যাপকতা, গভীরতা, সাধারণ জীবনের সঙ্গে মিলে মিশে যাওয়ার মত এমন মহাকাব্য বোধ করি আর একটিও নেই। আর মহাভারত পূজিত হয়ে চলেছে তার ভাগবত দর্শন ও বীরত্বের জন্য।
বাল্মিকীর রামায়ণ মহাকাব্য ইন্দোনেশিয়াতে পরিচিত কাকাবেন বা কাকবীণ রামায়ণ নামে। মূল রামায়ণ থেকে উৎসারিত হওয়া এই কাকাবীণ অত্যন্ত জনপ্রিয় বালি, জাভা এবং যোগ – জাকার্তায় । যদিও এর মূল উৎসমুখ ভারতীয় রামায়ণ , তবে এটি সম্পূর্ণভাবে বাল্মিকী রামায়ণের অনুসরণে নির্ধারিত হয়নি। প্রসঙ্গত যে সমস্ত লোকভাষায় রামায়ণ রচিত হয়েছিল, তারা কেউই মূল বাল্মিকী রামায়ণকে অনুসরণ করেননি সেকথা পূর্বেই বলেছি। এই রামায়ণ আনুমানিক ৯০০ শতাব্দীতে মূল জাভার প্রাম্বনান থেকে বালিতে এসে পৌঁছে ছিল ।
বহু বিশেষজ্ঞের মতে রামায়ণ অনেকাংশেই ষষ্ঠ- সপ্তম শতাব্দীর সংস্কৃত কবি ভট্টি রচিত #ভাট্টিকাব্য অনুসরণে লেখা । যা অনেকাংশেই সংস্কৃত নাটকের নিয়ম রীতিতে গঠিত। এখানে প্রথম পঞ্চখন্ড সরাসরি অনুবাদ করার প্রয়াস নিলেও কিন্তু বাকি দুই খন্ড নিজস্বতা দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে।
আসলে এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে আমাদের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। বহু প্রাচীনকাল থেকে জাভার সঙ্গে ভারতবর্ষের যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, তারই ফলশ্রুতি ভারতীয় সাহিত্যের প্রচলন জাভাতে । বালিদ্বীপের সংস্কৃতি সেখান থেকেই প্রাপ্ত । সুতরাং, এক মিশ্র সাহিত্য অনুশীলনের ফলে একটি নতুন সাহিত্য ধারার উদ্ভব হয় , যাকে ডঃ রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় #ভারত_জাভা সাহিত্য বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে ভারতের বাইরে ভারতীয় সাহিত্যের এরকম গভীর অনুশীলন আর কোথাও হয়নি ।
জাভা তথা সমগ্র মলয় দ্বীপপুঞ্জের রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং বৈদেশিক মরু আক্রমণ সবকিছুর প্রভাবই সেখানকার সাহিত্যে ছায়াপাত করেছে। যখন থেকে মাজাপহিত বংশের পতন হয় তখন থেকে প্রাচীন জাভা সাহিত্যের দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল । কারণ জাভা সাহিত্যচর্চা তখন আর কেবল একটি কেন্দ্রে করা সম্ভব ছিল না । অধিকাংশ অধিবাসী বালি দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফলতঃ, বালি – জাভা মিশ্রিত নতুন সাহিত্য ধারা সৃষ্টি হয়।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সমগ্র ভারতবর্ষে রামায়ণ মহাকাব্য নানাভাবে লেখা হয়েছে । কখনো কাব্য হিসাবে, কখনোবা নাট্যরূপ দান করা হয়েছে । বলা যেতে পারে , রামায়ণকে কেন্দ্র করে যেমন আঞ্চলিক ভাষ বা প্রাদেশিক ভাষার বিভিন্নতা দেখা যায় , তেমনি কিছু রামায়ণের ভাব যতটা আধ্যাত্বিক রসসিক্ত, ততটা আবার নাট্যব্যঞ্জনায় নয় । আর সনাতন ধর্মের মানুষ শুধুমাত্র এর প্রবণতা বজায় রেখেছেন । সনাতন ধর্মীয় বিভিন্ন মার্গ যথা – বৌদ্ধ , জৈন , ও শিখ ইত্যাদি মার্গেও রামায়ণের প্রভাব অবিস্মরনীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য ।
এমন কি সমকালীন কিছু ব্যক্তিও রামায়ণ রচনা করেছেন , উদাহরণস্বরূপ বলা যায় – সংস্কৃত ভাষায় প্রায় ৪২ টি রামায়ণ নাট্যরূপ ভারতবর্ষে রয়েছে । ভাষ , ভবভূতি, যশোবর্মন , মধুসূদনের ন্যায় প্রাচীন এবং বিখ্যাত নাট্যকারদের রচনায় প্রায় সপ্তম শতাব্দী থেকে পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত রামায়ণী ঘটনা সম্বলিত নাটক প্রচলিত ছিল ।
আবার ভারতের ১৩ টি প্রদেশের বিভিন্ন ভাষায় ১৫ টি অধিক রামায়ণী সংস্করণ ভারতে রয়েছে। ১২০০ শতাব্দীর তামিল কবি কাম্বারের রচিত #কম্বোরামায়ণ থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ , কেরালা, কর্ণাটক, গোয়া, আসাম, উড়িষ্যা , কাশ্মীর , মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট ,সহ বঙ্গের বিখ্যাত কৃত্তিবাসী রামায়ণ – বহু নামে, বিভিন্ন ভাষার সম্ভারে রামায়ণকথা প্রবাহিত হয়ে চলেছে । শুধুমাত্র সংস্কৃত আধ্যাত্বিকরসে জারিত উল্লেখযোগ্য রামায়ণ রচনাযই পাওয়া গিয়েছে ৬টি । যথা – আধ্যাত্ম রামায়ণ, বশিষ্ঠ রামায়ণ , যোগ বশিষ্ঠ রামায়ণ , আনন্দ রামায়ণ এবং অদ্ভুত রামায়ণ। এই বিভিন্ন রামায়ণ এর প্রভাবে ভারতবর্ষের বাইরে দেশগুলিতেও রামায়ণের বিভিন্ন সংস্করণ উপলব্ধ হয়ে থাকে ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রামায়ণের অনেকগুলো সংস্করণ প্রচলিত আছে । তার মধ্যে জাভা
বা যবদ্বীপে বিখ্যাত ছিল দুটি সংস্করণ। একটির নাম #সেরৎরম , অন্যটি হলো যোগীশ্বরের কাকাবেন বা কাকাবীণ রামায়ণ। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, সেরৎরমের প্রায় ১২০০টি পূর্ব – যবদ্বীপীয় সংস্করণ পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সুতরাং, এর জনপ্রিয়তা বা প্রভাব কতটা ছিল তা আর বেশি করে বোঝাতে হবেনা।
যোগীশ্বরের প্রাচীন রামায়ণ কাকাবীণ ২৬ টি সর্গ এবং প্রায় ২৭৭৪ টি শ্লোক আছে। যদিও এই যোগীশ্বর নামটি নিয়ে নানা প্রকার মতভেদ দেখা যায়। মনে করা হয় যে ব্যক্তি আসলে যোগীশ্বর নামে এবং কাকাবেনের রচয়িতা রূপে খ্যাত সেই ব্যক্তি মানুষটির অন্য কোনো নাম ছিল। #নাগরকৃতাগম এবং #রাজপতিগুন্ডল নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে – যাঁরা অগ্নিকে নিয়ে ধর্মচর্চা করেন, তাঁদের যোগীশ্বর এবং দেবগুরু বলা হয়।
অনেকে অনুমান করুন এই যোগীশ্বর ছিলেন একজন গুণবান রাজকুমার , তাঁর নাম ছিল রাজকুসুম বা কুসুম বিচিত্র। যেহেতু , বতর্মান কালেও বালিদ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে শৈব এবং আগমতন্ত্রের প্রাধান্য অধিক, সেই কারণেই সুপ্রাচীনকালের এই রাজকুমার তন্ত্রশৈব মতে আপন নাম পরিবর্তন করে যোগীশ্বর হয়েছিলেন।
কাকাবেন বা কাকাবীণ রামায়ণের সঠিক সময়কাল আজও জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয়, রাজা সিন্ডোকের সময় অর্থাৎ ৮৫১ শকাব্দ সময়ের সূচনায় এবং বিখ্যাত রাজা ঐরলঙ্গের অর্থাৎ ৯৫০ শকাব্দের পরবর্তী কালের মধ্যে রচিত হয়েছে। অধ্যাপক ডঃ কার্ণ বলেন , এই রামায়ণ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের কাছে সাল-তারিখ অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিঃসন্দেহে। বৃহত্তর ভারতে রামায়ণী সভ্যতার বিকাশের কথা বলতে গেলে এগুলি বিশেষভাবে প্রয়োজন । কিন্তু যেহেতু আমরা ঐতিহাসিক নই এবং রামসীতা এবং রামায়ণকে ভালবেসে, রামায়ণের প্রভাবে প্রভাবিত কিছু দেশের কথা বলতে বসেছি , তাই আবার ফিরে আসছি এই কাব্যে , দেশ- কাল- পাত্রভেদের রূপান্তরে। সংস্কৃত রামায়ণ, ভাট্টিকাব্য , তুলসীদাসী রামায়ণ সবকিছু সঙ্গে মহর্ষি বাল্মিকী রচিত রামায়ণের আংশিক মিল থাকলেও, জাভা – বালির রামায়ণ সাহিত্য কাকাবীণে সবথেকে বৃহৎ পার্থক্য রয়েছে তার সমাপ্তিতে। যেহেতু এগুলি ছিল স্বাধীন রচনা ,শুধুমাত্র অনুবাদ নয় তাই কাকাবেন রামায়ণ ,সীতার অগ্নিপরীক্ষার পরে রামসীতার মিলনের সুখের মুহূর্ত দিয়েই সমাপ্ত হয়ে যায়। সীতার পুনর্বার বনবাস, অগ্নিপরীক্ষা এবং সীতার পাতাল প্রবেশ এই দেশের সাহিত্যে পাওয়া যায় না । বলা বাহুল্য , এসব তথ্য বাল্মিকী রচিত মূল রামায়ণেও প্রাপ্ত হয় না।
এ প্রসঙ্গে বলা যায় কাকাবেন হল আদতে জাভার নীতিশাস্ত্র। যাকে বলা হয় #কবিন। এটি বর্তমানে বালির নীতিসার নামে পরিচিত। এগুলোর বাহ্যিকরূপ রামায়ণ, মহাভারত যাই হোক না কেন , অভ্যন্তরীণ শক্তি হল নৈতিক উপদেশ, ধর্মীয় সদাচারণ বাণী, জ্ঞানী মানুষদের অভিজ্ঞতার সঞ্জাত উক্তির প্রকাশ। তাই ব্রহ্ম ঋষি বিশ্রবার ব্রাহ্মণ ও শাস্ত্রজ্ঞ পুত্র , লঙ্ককেশ্বর এবং অশুভ শক্তির আধার রাবণের শাস্তি পাবার ঘটনাই এখানে মূখ্য হয়ে উঠেছে। ভারতের বাইরে রামায়ণের গল্প কিন্তু যেটা উঠেছে সেটা হল শুভ অশুভের যুদ্ধ, দেবা অসুরের যুদ্ধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াই, ভালোর সঙ্গে মন্দের লড়াই এবং দুষ্টের নাশ ও ন্যায়ের জয়। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পূর্ব পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা, সময় বা কালের প্রভাবকে গভীর মান্যতা দেওয়া।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. রামায়ণ – দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পদচিহ্ন
২. Ramayana–An Instrument of Historical Contact and Cultural Transmission between India and Asia
৩. 1971.Traces of an Old Sundanese Ramayana Tradition in Indonesia