পর্ব ১
রামায়ণ অখন্ড ভারতবর্ষ এবং বৃহত্তর ভারতবর্ষের এমন একটি মহাকাব্যিক সম্পদ যা শুধু আধ্যাত্মিক জগতের নিমিত্তই নয় , এ এক চলমান ইতিহাসের দলিল। সুবিশাল ভারত তথা বৃহত্তর ভারতের অন্তরের সুরটি রামায়ণের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক সময় মনে হয় কেবলমাত্র ভারতের উত্তর ও মধ্য অংশের মধ্য দিয়ে রাম ও রামায়ণ প্রবাহিত হয়েছে। সেই তুলনায় ভারতের অন্য অংশ বা বৃহত্তর ভারতে হয়তো রামায়ণ ততটা প্রবল নয় । কিন্তু পূর্ব, উত্তরপূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ এবং বৃহত্তর ভারত তথা রামায়ণের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে চমৎকৃত হতে হয়।
রাম ও রামায়ন ভারতীয়দের রক্তে মিশে আছে। তাই কালে কালে যুগ যুগে ভারতবর্ষ ও বৃহত্তর ভারতবর্ষে রামকথা শত ধারায় বর্তমান। তাই ভারতবর্ষের সব প্রদেশেই রচিত হয়েছে একটি করে প্রাদেশিক রামায়ণ। বাল্মিকী রামায়ণ হচ্ছে প্রকৃত রামায়ণ। কিন্তু বাল্মিকী রামায়ণকে মূলধন করে আরো এক দঙ্গল রামায়ণ রচিত হয়েছে , যেমন – মহারামায়ন, বশিষ্ট্ঠ রামায়ণ, অদ্ভুত রামায়ণ, আধ্যাত্ম রামায়ন, ভারত রামায়ণের মত ভিন্ন ভিন্ন রামায়ন।
ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় #রামবতারম নামে একটি পৃথক রামায়ণ রচনা করেছিলেন মহর্ষি পাম্বান ।তামিল ভাষায় রচিত এই রামায়ণে বাল্মিকী রামায়ণের কাহিনীকে রমণীয় করে পরিবেশন করা হয়েছিল। ঘটনা হলো বাল্মিকী রামায়ণের বর্ণনা অনুসারে শ্রীলঙ্কায় অন্তত ১৪ টি স্থানে রাম রাবণ সীতা হনুমান সম্পর্কযুক্ত স্থানের সন্ধান মিলেছে। সরকারি তরফে সেগুলো সংস্কার সাধন করা হয়েছে ।ব্যবস্থা করা হয়েছে সংরক্ষণের।
শ্রীলঙ্কায় এক জলাশয়ের ধারে যেখানে রামচন্দ্র দীর্ঘ সময় সীতা দেবীর কথা চিন্তা করেছিলেন সেখানে এক খণ্ড পাথরের ওপর রামচন্দ্রের পদচিহ্ন মিলেছে বলে দাবি শ্রীলংকার সরকারের। এই সমস্ত স্থানকে ঐতিহাসিক তো বটেই প্রত্নতত্ত্ববিদদের একাংশ নিতান্ত মিথ বা কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেননি ।কারণ এই সবই রামায়ণের বর্ণনার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যায় ।
ভগবান বুদ্ধের শরণাগত শ্রীলংকার বৌদ্ধরাও এই সমস্ত স্থানকে পরম পবিত্র বলে মনে করেন । স্থানটি একটি মহাতীর্থে রূপ নিয়েছে অসংখ্য ভক্ত সেখানে গিয়ে নতমস্তকে রামের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি নিবেদন করেছেন।
মালয়েশিয়া সেদেশের রামায়ণের নাম হল #হীকায়াতসেরিরাম । সে দেশের লোকেদের মুখে রাম কাহিনী শুনতে পাওয়া যায় । রামলীলা মঞ্চস্থ হয়ে থাকে আকচার । রামলীলা ,রামায়ন ,রাম কথা যাত্রাপালা মালয়েশিয়ায় খুব জনপ্রিয়। সে দেশে সামাজিক শিক্ষায় রামচরিত কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে ।মালয়েশিয়ার ধর্ম নির্বিশেষে রাম আদর্শ চরিত্র ।
কিছু মৌলবাদী রাম সম্পর্কে উন্নাসিকতা থাকলেও তাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে সে দেশে রাম-রামায়ন ,শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে । জনমনে রামের আসনকে স্থায়ী করার লক্ষ্যে প্রতিবছর মালয়েশিয়ায় প্রায় দু’শো টা স্থানে রামলীলা মঞ্চস্থ করা হয়।
রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী রাজ্য পেরাক। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের অর্থাৎ , যে বছর অযোধ্যা রাম জন্মভূমি মন্দির পুনরায় নির্মাণ আন্দোলন তুঙ্গে এবং তাকে দমন করার প্রবল প্রচেষ্টা হচ্ছিল ঠিক সেই বছর মালয়েশিয়ার ওই স্থানে নির্মিত হয়েছে বৃহত্তম রাম মন্দির। তাতে রাম সম্পর্কিত ১০০১ টি চিত্র কারুকার্য খচিত হয়েছে। এখানে এখন দর্শনার্থীর সমাগম চোখে পড়ার মতো।
ইন্দোনেশিয়া , প্রাক্তন জাভা বিশ্বের বৃহত্তম একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবেই মনে করা হয়ে থাকে সেখানকার ৯০% মানুষ মুসলিম । ৪৭০ খ্রিস্টাব্দে সেখানে মেডাঙ রাজতন্ত্র ছিল। তৎকালীন রাজার আমলে রচিত হয় ইন্দোনেশিয়ার #কাকাবীণ_রামায়ণ । জাভা ভাষায় রচিত অন্যান্য সমস্ত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কাকাবিন রামায়ন সর্ব বৃহৎ এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত ও স্বীকৃত। ১৩ হাজারেরও বেশি দ্বীপ সমৃদ্ধ ইন্দোনেশিয়ায় রাম ও রামায়ণের মর্যাদা দেয়া হয় তার অসংখ্য প্রমাণ বিদ্যমান ।
২০১৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জুলাইয়ে ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রগর্ভে অনুসন্ধান চালানোর সময় রাম, সীতা, লক্ষণ, হনুমান মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়।
রামায়ণের রচনা কালে মহামুনি অগস্ত্য বিন্ধ্যাচল পর্বত বেরিয়ে দক্ষিণ ভারত হয়ে যবদ্বীপ বা জাভা গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ভারত বর্ষের থেকে তিনি যে সংস্কৃতির মনি প্রদীপ নিয়ে গিয়েছিলেন বর্তমান ইন্দোনেশিয়ায় তার শিক্ষা এখনো দীপ্যমান রয়েছে।
নানা তথ্যের প্রকাশ , কাকাবিন রামায়ন রচিত হওয়ার অনেক আগে থেকে সে দেশের লোক মুখে রাম কাহিনী প্রচলিত ছিল । রাম কাহিনী কাকাবিন রচিত হবার পর আরো তার পরিব্যাপ্তি আরো বৃদ্ধি পায় । রামের জীবনাদর্শকে এখনো সে দেশে অধিকাংশ মানুষই আদর্শ জীবন চরিত বলে মনে করেন ।
সমগ্র ইন্দোনেশিয়া মানুষ যে ধর্মই হোক না কেন তারা কিন্তু এখনও রাম অনুরাগী । দেশের জাতীয় সড়ক পরিবহন সংস্থার নামকরণ হয়েছে রামায়ণ ট্রান্সপোর্ট । বিষ্ণুর বাহন গরুড় এর নামে চিহ্নিত করা হয়েছে এই দেশের জাতীয় বিমান পরিবহন সংস্থা গরুড় এয়ারওয়েজ ।আরো উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ইন্দোনেশিয়ার সংসদ ভবন অর্থাৎ জাতীয় আইনসভা গৃহের নামকরণ করা হয়েছে “মনু ভবন”।
তবে দুঃখের বিষয় যেহেতু দেশটি একটি মুসলিম দেশ । সেই জন্য সেখানে মোহাম্মদ হাবিবি সে দেশের রাষ্ট্রপতি থাকার সময় সেখানকার মোল্লা মৌলভী রাম ও রামায়ন এই সমস্ত নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সব থেকে বড় কথা পর্যটন শিল্পের জন্য সর্বসাধারণের কাছে তা এখনো কোনো গুরুত্ব পায়নি ।
বর্তমানে বৌদ্ধ প্রধান রাষ্ট্র হল থাইল্যান্ড ।দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পূর্বতন রাষ্ট্র শ্যাম তথা থাইল্যান্ডে রাম এবং অযোধ্যা এতটাই জনপ্রিয় যে সেখানে #রামকিয়েন নামে একটি পৃথক রামায়ণ আছে।
এই রামায়ণ মহর্ষি বাল্মীকি রামায়ণের অনুসরণে রচিত । রাম জন্মভূমি অযোধ্যার অনুকরণে এখানে অযুদ্ধ নগরীও স্থাপিত হয় । সেই অযুদ্ধ নগরী দু-দুবার সে দেশের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছে। বর্তমানে যদিও থাইল্যান্ডের রাজধানী হলো ব্যাংকক কিন্তু একবার ১৩৫০ থেকে ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দ ও পরবর্তীকালে ১৪৮৮ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তও অযুদ্ধা ছিল সে দেশের রাজধানী।
সেই সময় সমস্ত দেশে যারা রাজত্ব করেছেন তারা নিজেদের রামের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন ।রাজা প্রথম রামাতিবধি ( ১৩৫০ -১৩৬৯) রাজা প্রথম রামসুয়েন ( ১৩৬৯ – ১৩৯৫), রাম রাজা ( ১৩৯৫ – ১৪০৮), রাজা দ্বিতীয় রাম প্রমুখ ।১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে অযুদ্ধা নগরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রথমটি রামাতিবোধি। বর্তমানে থাইল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক রাজা ভূমিবল অতুলয়তেজ এর নামের সঙ্গেও রাম নাম যুক্ত হয়েছে। সে দেশে তিনি নবম রাম হিসেবে পরিচিত।
স্বদেশে কবিদের হাতে পড়ে মূল রামায়ন বারবার পরিবর্তিত হয়েছে ।সেই বদল থেকে মূল বাল্মিকী রামায়ণের স্বরূপটিকে ফিরিয়ে আনার সহজ কাজ নয় ।আর এই রকম একটি প্রাদেশিক রামায়ণ নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব ।
স্বদেশে বিভিন্ন প্রাদেশিক কবিদের হাতে পড়ে রামায়ন আশ্চর্য রূপ নিয়েছে, যে রামায়ণ কখনো বাল্মিকী রচনা করেছেন এ কথা অনেকে জানেন না। তাদের মূলধন যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই ভক্তিরস, সেখানে রাজনীতি, ধর্মনীতি , সমাজনীতির কোনো স্থান নেই। জনগণ আপন মুখের ভাষায় এমন আকুল করা কাহিনী পেয়ে বড়ই ব্যাকুল হয়েছেন। রামায়ণের মুখ্য চরিত্র গুলো যে চেহারা যেভাবে বাল্মীকির রামায়নে ছিল তার ওপর প্রাদেশিক রংবেরঙের টান পড়ায় চরিত্রগুলো অনেক সময় পাল্টে গেছে। কখনো বা মূল কাহিনীকে সামনে রেখে কালের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।চিরকালের এই কাব্যরসকে বাঙ্গালীর কবি কৃত্তিবাস ওঝা পঞ্চদশ শতকে বাঙ্গালীর হাতে তুলে দিয়ে হৃদয় জয় করেছেন। ভক্তপ্রাণ বাঙ্গালী পাঠকের নিকট আজ এই গ্রন্থটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে পূজিত হয়। তবে বাংলায় বহু কবি এই রামায়ন রচনায় আত্মোনিয়োগ করেন।
বাঙালিরা যেরকম রামায়ণ বলতে কৃত্তিবাস কে চেনেন, হিন্দি বলয়ে যেমন তুলসীদাসের প্রতিপত্তি আছে , তেমনই দক্ষিনে আছে কম্বনের রামায়ণ , তেলেগুতে রঙ্গনাথের রামায়ণ, কাশ্মীরি দিবাকর ভট্টের রামায়ণ । উড়িষ্যা, আসাম, নেপাল , তিব্বত – সবার নিজের নিজের মত রামায়ণ আছে তবে মজার বিষয় হলো বিশেষ বিশেষ প্রদেশের কবিদের রূপটানে রামায়ণের ঘটনা পরিবহনে যা পরিবর্তন পরিবর্ধন এসেছে, তা কখনো চমৎকার, কখনো অদ্ভুত, কখনো অর্থহীন …..
ফলে দেশ-বিদেশ ,প্রদেশ , হাজারও কবিওয়ালাদের টানাটানিতে কেউ সাত কান্ড রামায়ণ পড়ে কি যে বলে তা শুনে আজ আমরা আশ্চর্য হই না….তবে একথা সত্য যে রাম ও রাম সংস্কৃতি বহু প্রাচীন।
ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের বিচিত্র প্রকাশ ভারতের বাইরে যে দেশগুলির মধ্যে প্রবল রূপে বিদ্যমান তার মধ্যে বালি অন্যতম। শুধুমাত্র বালি নয় , জাভা, যোগ – জাকার্তা সুমাত্রা এবং বোর্ণিও সহ মালয়েশিয়াতে তার প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।
বালিদ্বীপ – ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত। ভারতবর্ষের বৈশ্য সম্প্রদায় , ক্ষত্রিয় বীর এবং ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ বর্হিভারতের দেশগুলোর সম্বন্ধে জানার প্রবল ইচ্ছার ফলস্বরূপ ইন্দোনেশিয়ার জাভা, বালিদ্বীপে ভারতীয় সভ্যতার আগমন ঘটিয়েছিলেন। অঙ্গ, বঙ্গ ,কলিঙ্গ, বিদর্ভ হতে বহু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বঙ্গোপসাগরের পথে পাড়ি দেবার ঐতিহাসিক বহু তথ্য পাওয়া যায় । কোন সময় থেকে ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব ইন্দোনেশিয়াতে পড়তে শুরু করেছিল তা বলতে গেলে বলা যায় যে, এ অতি প্রাচীন যোগসূত্র।
এইসব তথ্যঃ তো ইতিহাসের সাক্ষ্য। কিন্তু যে ইতিহাসকে নষ্ট করা হয়েছে বা যে ইতিহাস লিখিত নেই তার কি হবে? প্রমান যে নেই একদমই নয়। বহু প্রমান আছে। যা কেবল সঠিকভাবে নথি বদ্ধ করা হয় নি। নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাবিজ্ঞানীরা সেই সুদূরকালের তথ্য নিয়েও তৎপর হয়েছেন।
ভাষা , সংস্কৃতি , আচার, পাল, পার্বন, পূজা, জীবাশ্ম ,লোককথার সাদৃশ্য বিচার করে মাইগ্রেশনের অজস্র বৈজ্ঞানিক প্রমান মিলেছে। সেসব অনেক ব্যাখ্যা আমি দিয়েছি বিগত পর্বগুলিতে। ওশিয়ানিয়ার মানুষ ও তার মৌখিক ঐতিহ্যের যে মাইগ্রেশন ঘটেছে সেই বিষয় আজ আর কারো কোনো সন্দেহ নেই।
নিউজিল্যান্ডের মাওরি আদিবাসী তিরিশ হাজার বছর আগে ভারতীয় উপকূল থেকেই সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন। তাঁরা পৌঁছলেন ইরিহিয়া দেশে। সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলা হয় ব্রীহিয়া। মাওরিদের প্রধান খাদ্য চাল। তাঁরা চালকে বলতেন আরি। ভারতের দক্ষিণ অংশের বাসিন্দারা চালকে বলে আরি । প্রাচীন ভারতে ধানকে বলা হত ব্রীহি। ব্রীহিক অর্থাৎ ধান্য বিশিষ্ট। মনে করা হয় ব্রীহিয়া বা ইরিহিয়া নাম এসেছে ব্রীহি বা ব্রীহিক থেকে।
মাওরিরা দক্ষ সমুদ্র অভিযাত্রী। ভারতীয়রাও তো অকুল দরিয়ার মাঝি। অদ্ভূত ভাবে ভাষাগত এমন মিল এই দুই এলাকায় পাওয়া গিয়েছে যে, দুজন খ্যাত নাম ভাষা বিজ্ঞানী এবং সাংস্কৃতিক নৃ বিজ্ঞানী এস.পারসি স্মিথ ও এলসন বেস্ট এই জনগোষ্ঠীর মাইগ্রেশন বিষয় প্রামাণ্য গবেষণা করেছেন।ভাষা ও লোকসংস্কৃতি সাদৃশ্য তারা ব্যাপক ভাবে খুঁজে পেয়েছেন।
আহু এবং মাউই ….পলিনেশিয়ার ইস্টার দ্বীপে যুগ থেকে যুগান্তের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মূর্তি গুলির সঙ্গে সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার বহু মিল খুঁজে পাওয়া যায় ….কারন বহু বহু বহু সময় আগে এই ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিনাংশ থেকে প্রাচীন অধিবাসীরা মাইগ্রেট করেছিলেন পলিনেশিয়া , মাইক্রোনেশিয়া , মেলানেশিয়ায়। কেউ কখনো খোঁজ করেছে তাদের?
ভারতের দক্ষিণ অংশ থেকে দলে দলে মানুষ ইন্দোনেশিয়া , শ্যাম , যবদ্বীপ অঞ্চল , মাইক্রোনেশিয়া , মেলানেশিয়া , পলিনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন এবং সেটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। ফলে ,তাঁদের ভাষা- নিজস্ব সংস্কৃতি- আচার- পাল-পার্বনকে এক কথায় বিসর্জন দেননি। কালের প্রভাবে নানা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রণের ফলে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি । তাই তাঁদের সামাজিক লৌকিক সংগঠনে পুরনো ঐতিহ্যের রেশ রয়েছে। নানা প্রতিকূল ঢেউ আছড়ে পড়লেও তাঁদের ঐতিহ্যলালিত ভাষা ও সংস্কৃতিকে একেবারে মুছে দিতে পারেনি। লোককথার মধ্যেও তার হদিস মিলেছে।
প্রাচীন কম্বোজ ও জাভা দেশের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সাহিত্যসংস্কৃতি ও সভ্যতার বিস্তার ইন্দোনেশিয়ায় হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। এক্ষেত্রে অনেক মত, অনেক তর্ক আছে। কেউ কেউ বলেন “প্যালিও মেটালিক” যুগের যে সমস্ত প্রাচীন জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল এবং সেই যুগের বিনিময় প্রথার ফলে, ভারতীয় যে সকল বস্তুর আদান-প্রদান হয়েছিল সেগুলো তৃতীয় খ্রিস্টপূর্ব সময়কালের। কেউ কেউ মনে করেন এগুলো তারো বহু আগের ঘটনা। মধ্যযুগে ভারতীয় নৌ যাত্রার বর্ণনায় এবং বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক খননের ফলে বেশ কিছু সখ্যক মৃৎপাত্র, পাথর এবং কাঁচাপাথরের পুঁথির ভারতীয় গহনা ইত্যাদি প্রাপ্তি ঘটেছিল। এগুলোর নিদর্শন সম্ভবত চতুর্থ খ্রিস্টপূর্ব থেকে দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্ব সময়কালের মধ্যে। সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে থাইল্যান্ডের বান- ডন- থা -পেট থেকে পশ্চিমে অবস্থিত সেম্বিয়ান ও মালয়েশিয়ার কিছু প্রদেশ পর্যন্ত ভারতীয় বৈশ্যদের নিজস্ব যোগসূত্র ছিল গভীর, তা আজ প্রমাণের অভাব রাখেনা।
জাভা , বালি, সুমাত্রা এগুলি যেন এক দীর্ঘ সূত্রের খন্ডাংশ। জাভা বালির প্রতিবেশী রাজ্য । মাত্রই কিছু মাইল পূর্বে অবস্থিত। বালিদ্বীপ দীর্ঘদিন জাভা সাম্রাজ্যে অধীনস্থ ছিল।
বালি দশম শতাব্দীতে স্বাধীন হয় কিন্তু পুনরায় ১২৮৪ খ্রিস্টাব্দে জাভার কুক্ষিগত হয়। সেই সময় জাভা ছিল ভারতের বাইরের হিন্দুরাষ্ট্রগুলির মধ্যে অন্যতম অগ্রণী ভূমিকায় । বিখ্যাত হিন্দুরাজবংশ #মাজাপহিত ছিলেন জাভা শাসনকর্তা। এই হিন্দু রাজবংশ অতি উচ্চশিখরে উঠেছিল দ্বীপময় দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়। ১৩৬৫ সালে রচিত #নগরাকৃতাগমা বা #নাগরকৃতআগমা অর্থাৎ নগর কীর্তির যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার থেকে জানা যায় বিখ্যাত এই হিন্দুসাম্রাজ্যের অধীনে ৯৮টি প্রদেশ ছিল, যা সুমাত্রা হয়ে বিস্তারিত ছিল নিউগিনি পর্যন্ত। যার মধ্যে ছিল বর্তমান ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া , ব্রুনেই দক্ষিণ থাইল্যান্ড শুরু ফিলিপিনস এবং পূর্ব তিমুর। #সূর্য_মাজাপহিত বংশ নামে সেই রাজবংশ আজও ঐতিহাসিকদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। যাঁদের ধর্মীয় ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং পুরাতন জাভানীস ছিল লৌকিক ব্যবহারের জন্য।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে হিন্দু মাজাপহিত সাম্রাজ্যের পতন হয় “মরুদস্যু ” আক্রমণের ফলে । নতুন রাজা হিন্দু ধর্মকে মেনে নেয়নি । ইসলামকে প্রধান ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করে। ফলে জাভার সমগ্র রাজন্যবর্গ , জ্ঞানীগুণী ব্যক্ত এবং সম্প্রদায়গণ বালিতে চলে আসেন , অনেকটা কাশ্মীরি পন্ডিতদের ন্যায়। তাঁরা তাঁদের অতি সমৃদ্ধ সনাতন শিল্প-সংস্কৃতি, দর্শনচর্চা , ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সবকিছুকে নিয়ে সযত্নে ,পরম মমতায় নতুনদেশে সংরক্ষণ করে চলেন। তাঁদের এই পরিবর্তন ও পরিবর্ধন চিরন্তনী রূপ সনাতন চিন্তার সম্পদকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
এটুকুই ইতিহাস আলোচনার কারণ হল, আজ এই বৃহত্তর ভারতে রামায়ণ মহাভারত এতটাই জীবন্ত, সেসব জায়াগায় প্রতিটি সনাতনী প্রথা এত নিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পালিত হয়ে চলেছে, এ তারই পূর্বতন ইতিহাস। ভারতবর্ষ হতে বৃহত্তর ভারতবর্ষে এই ইতিহাসের ধারার বহমানতার নিমিত্ত তিনজন কিংবদন্তি ব্যক্তির নাম আসে। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন ঋষি অগস্ত্য , অপরজন দুইজন হলেন ব্রাহ্মণ পন্ডিত কৌন্ডিন্য অথবা কৌডিন্য এবং বীর রাজপুত্র অজিশোক। এঁদের মাধ্যমেই গৌরবময় ভারতীয় এই প্রবাহমানতা পৌঁছেছিল বৃহত্তর ভারতে।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. রামায়ণ – দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পদচিহ্ন
২. Ramayana–An Instrument of Historical Contact and Cultural Transmission between India and Asia
৩. 1971.Traces of an Old Sundanese Ramayana Tradition in Indonesia