সমগ্র দেশ তথা বিশ্ব এক চূড়ান্ত দুঃসময় এর মধ্যে দিয়ে চলেছে যার কারণ COVID-19 নামক একটি ভাইরাস, যার সংক্রমণে বিশ্ব মানচিত্রের সবকটি দেশ থরহরিকম্প। এরকম অবস্থায় একটি বিশেষ কারণে এই Central Vista Project সংক্রান্ত বিষয়ে লিখতে বসা।
গত কিছুদিন ধরে সামাজিক গণমাধ্যমগুলিতে একটি বিষয়ে প্রচার বা মিথ্যা প্রচার চলছে, কিছু কায়েমী স্বার্থান্বেষী মানুষের দ্বারা, যার মূল বক্তব্য “যেখানে করোনা তে দেশের অর্থনীতি টালমাটাল, মানুষ কর্মহীন,, সেখানে মোদী নিজের স্বপ্নের বাসভবন তৈরিতে বরাদ্দ করলেন ২০০০০ কোটি (20000 crore)”। মূলতঃ কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী কিছু রাজনৈতিকO দল, তথাকথিত উদারবাদী, বামপন্থী, মানবতাবাদীরা এই পোস্টটির মাধ্যমে সাধারন মানুষকে উস্কানি দিয়ে চলেছে।
এই যে “মোদীর স্বপ্নের বাসভবন নির্মাণে ২০০০০ কোটি” এই শব্দবন্ধের সত্যাসত্য বিশ্লেষণ করে কি পাওয়া যায়, আসুন, দেখা যাক।
■ ভূমিকা – প্রথমেই বলি “মোদীর স্বপ্নের বাসভবন নির্মাণে ২০০০০ কোটি” – এই একটি সর্বৈব মিথ্যা প্রচার। প্রকৃতপক্ষে এই কর্মকান্ডের নাম “Central Vista Project”, যার লক্ষ্য নতুন সংসদ ভবন নির্মান এবং কেন্দ্রীয় সরকারী সমস্ত দপ্তর, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন সবকিছুকে এক জায়গায় নিয়ে আসা। এই কর্মকান্ডের প্রয়োগস্থল রাজধানী দিল্লির ইন্ডিয়া গেট থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত বিস্তৃত রাজমার্গের (যেখানে আমরা প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ হতে দেখি) এর পার্শ্ববর্তী জায়গা।
■ উদ্দেশ্য – এবারে আসা যাক এই প্রকল্প স্থাপনের উদ্দেশ্যগুলিতে
১. ◆নতুন সংসদভবন নির্মাণ◆
বর্তমানে যে সংসদ ভবন আমরা দেখি, তার শিলান্যাস হয়েছিল ১৯২১ সালে এবং তা সম্পূর্ণ হয় ১৯২৭ সালে। ১৯২৬ সালে গঠিত Imperial Legislative Council এর সদস্যসংখ্যা ছিল ৬৩৫ (635), যার মধ্যে Council of State (উচ্চকক্ষ) এর সদস্য ২৬০ (260) জন এবং Legislative Assembly (নিম্নকক্ষ) এর সদস্য ৩৭৫ (375) জন। বর্তমানে, অর্থাৎ এই সংসদ ভবন নির্মানের ৯৩ বছর পরে, মোট সদস্য সংখ্যা ৭৯০ (790) জন, যার মধ্যে রাজ্যসভা (উচ্চকক্ষ) তে ২৪৫ (245) জন এবং লোকসভা (নিম্নকক্ষ) তে ৫৪৫ (545) জন। একথাও মাথায় রাখতে হবে, সেইসময়ের থেকে জনসংখ্যার যে বিপুল বৃদ্ধি ঘটেছে (১৯২১ সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩২ কোটি, যা বর্তমানে আনুমানিক ১৩৭ কোটির কিছু বেশি) তার সাথে তাল মিলিয়ে জনপ্রতিনিধির সংখ্যা বাড়াতে গেলে, বিশেষজ্ঞদের মতে ২০২৬ সালে লোকসভায় সদস্যসংখ্যা হওয়া উচিত ৮৪৮ (848) জন। সেইকারনে এই নতুন সংসদ ভবনে ৯০০ (900) জন লোকসভা সাংসদ ও ৪৫০ (450) জন রাজ্যসভা সাংসদের বসার ব্যবস্থা থাকছে।
২. ◆সমস্ত দপ্তরকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা◆
এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের সব মন্ত্রকগুলির দপ্তর , Central Secretariat এর সম্প্রসারণ করে, এখানে নিয়ে আসা হবে। বর্তমানের কৃষিভবন, শাস্ত্রীভবন, বিজ্ঞানভবন, নির্মানভবন, উদ্যোগভবন, বায়ুভবনকে এই Central Secretariat এ স্থানান্তরিত করা হবে। এরই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী (বর্তমান বাসভবন , ৭ রেসকোর্স রোড) ও উপরাষ্ট্রপতির বাসভবন ও নতুন ভাবে নির্মান করা হবে।
দপ্তরগুলিকে রাজমার্গের দুপাশে জায়গা দেওয়া হবে এবং প্রতিটি দপ্তরের সামনে সাধারন মানুষের জন্য HELP DESK রাখা হবে।
■ ফলাফল – এই প্রকল্পের সরাসরি সুফলগুলি হল,
১. সমস্ত দপ্তর, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, রাষ্ট্রপতিভবন, উপরাষ্ট্রপতিভবন, সংসদ ভবনের রৈখিক দূরত্ব কমে দাঁড়াচ্ছে ২.৫ (2.5 km) কিলোমিটার, যা বর্তমানে ৮.৪ (8.4 km) কিলোমিটার।
এর ফলে –
● যেকোনো প্রশাসনিক কাজের সময় বহুগুন হ্রাস পাবে।
● আমরা জানি যেকোনো VVIP Convoy একজায়গা থেকে আরেকজায়গায় যেতে কতসংখ্যক গাড়ি লাগে। সেই দূরত্ব কমানো গেলে তেলখরচ বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে, শহরের সাধারন ট্র্যাফিক মুভমেন্ট দ্রুত হবে। ট্র্যাফিক জ্যাম কমলে তেল কম পুড়বে, পরিবেশ সুস্থ হবে।
● সাংবাদিকদের একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে গাড়ি ব্যবহার কমবে। এতে তাদের কাজের সময়ও বাঁচবে, পরিবেশ ও রক্ষা পাবে।
- পরিবেশের কথা বারবার বলার একটাই কারন, দিল্লিতে বায়ুদূষণের ফলে দুরাবস্থার কথা সকলেরই জানা।
২. পূর্বে উল্লিখিত ভবনগুলির মধ্যে অনেকগুলিই কেন্দ্রীয় সরকারের নিজস্ব নয়। তার ভাড়া বাবদ সরকারকে প্রতিবছর ১০০০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়, যে অর্থ আমাদের মত সাধারন মানুষদেরই করের টাকা।
এই বিপুল অর্থরাশি ব্যয় কমানো গেলে তা আখেরে জনগনের ওপর চাপ কমাবে।
♦ কেনো এইসময় এই অর্থবরাদ্দ :
এই প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ২০২৪ সালের মার্চ মাস। এর কারণ পরবর্তী জনগণনা হবে ২০২১ সালে, এবং পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন হবে ২০২৪ সালে। জনগণনার ওপর ভিত্তি করে যদি সাংসদ সংখ্যা পরিবর্তন করে , পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে ক্ষেত্রে ২০২৪ সালের আগে এই সংসদ ভবন পূর্ণভাবে কার্যকর থাকা দরকার। তাই কোনো অজুহাতে ই এই কাজ টি কে ফেলে রাখার অর্থ, পরবর্তী তে লোকসভা ক্ষেত্রের সীমা নির্ধারণ এর প্রক্রিয়া কে পিছিয়ে দেওয়া। আর এই একবার পিছিয়ে যাওয়ার অর্থ একদিন , একমাস বা এক বছর নয়, পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন অব্দি ( পাঁচ বছর) পিছিয়ে যাওয়া।
■ সমালোচনা ও তার প্রত্যুত্তর –
আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যে এখানে কোনো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রকল্পতে অর্থ বরাদ্দ করলেই কিছু শ্রেণীর তা গাত্রদাহের কারন হয়ে দাঁড়ায়। অথচ সু”শ্রী”, কু”শ্রী” বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষ কোটি টাকা, Dole politics করে ভোট কেনার খাতিরে ছড়ানো হলে, এরা চুপ করে থাকে, বা বাহবা দেয়। বলাবাহুল্য এর মাধ্যমে নতুন সম্পদ সৃষ্টি কিছুই হয়না। লাভ হয় সরকারে বসে থাকা রাজনৈতিক দলটির ভোটপ্রাপ্তির হিসাবে। সামাজিক প্রকল্পগুলি বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে না, কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা অতীব প্রয়োজন। একটি পরিবারে যেমন ভালো পোষাক, খাবার, ভোগ্যপণ্য দরকার, ঠিক ততটা বা তার থেকেও বেশী প্রয়োজন সেই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষা ও সেই বিষয়ক অর্থের সংস্থান করা।
এপ্রসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাননীয় শ্রী অজিত দোভাল মহাশয়ের একটি বক্তৃতা অবশ্য উল্লেখ্য। ভারতবর্ষ কেন আজও সমরাস্ত্র – র ব্যাপারে বিদেশের ওপর নির্ভরশীল (স্বয়ংসম্পূর্ন নয়), তার কারন বিশ্লেষণে শ্রী দোভাল বলেছিলেন যে, এই ক্ষেত্রে আজ যদি কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, তার ফল পাওয়া যায় অন্ততঃ ১০-১৫ বছর পরে। কিন্তু নির্বাচন যেহেতু ৫ বছর পর হয় এবং সব রাজনৈতিক দলেরই উদ্দেশ্য থাকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কাটিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসা, তাই তারা এসব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রকল্প গ্রহণ না করে, টাকা ছড়িয়ে ভোট কেনার কৌশল অবলম্বন এর দ্বারা ক্ষমতা ধরে রাখতেই বেশী উদ্যোগী হয়। সৌভাগ্যবশত বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার শুধু ভোট ব্যাংকের কথা মাথায় না রেখে, এরকম একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হয়েছে।
এব্যাপারে, আরো উল্লেখ্য,
এই নতুন সংসদ ভবন নির্মাণের জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটি (JPC) গঠন হয়েছিল ২০০৯ সালে তৎকালীন স্পিকার শ্রীমতী মীরা কুমারের নেতৃত্বে, UPA সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং এর সদস্য ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী পি. চিদাম্বরম ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী শ্রী জয়পাল রেড্ডি। কিন্তু আশ্চর্য সেই ২০০৯ সাল থেকে ১২ বছর কেটে গেলেও এনারা কেউ এই প্রকল্পটি নিয়ে অর্থব্যয় এর উল্লেখ করা দূরে থাক, শব্দব্যয়ও করেননি। তার বদলে তৎকালীন UPA সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল একগুচ্ছ আর্থিক কেলেঙ্কারির।
■ উপসংহার –
অবশেষে একথাই বলা যায়, যাঁরা বাৎসরিক ১০০০ কোটি টাকা ভাড়া হিসেবে খরচের কথা উহ্য রেখে, ২০০০০ কোটি টাকা খরচ করার ব্যাপারে বাজার গরম করছেন, তাঁরাও যেন কোনোদিন ২০ বছরের মেয়াদে গৃহঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি না করে চিরকাল ভাড়াবাড়িতেই থাকেন। তবেই তাদের এই প্রতিবাদ বাস্তবোচিত হবে।
দীর্ঘপ্রতীক্ষিত একটি প্রকল্পকে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে সংকল্প করেছেন, তার জন্য কোনো সাধুবাদই যথেষ্ট নয়। সরকারের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের এই নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে অজস্র অভিনন্দন।।
তারিখ : 09/05/2021
✒️🖋️🖊️ কলমে সাগ্নিক সেনগুপ্ত