ভগত সিং সাভারকরকে ‘বীর’ এবং ‘ধর্মান্ধ নৈরাজ্যবাদী’ হিসাবে অভিহিত করেছিলেন, তবে দুজনেরই লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা।
রত্নগিরিতে সাভারকারের বাড়িতে সবসময় একটা গেরুয়া পতাকা উত্তোলিত করা থাকত, কিন্তু ভগত সিং, রাজগুরু এবং সুখদেবের আত্মবলিদানের পরের দিন, সেই জায়গায় উড়েছিল কালো পতাকা।
ভারতীয় বিপ্লবীদের সবচেয়ে বেশী অনুপ্রাণিত করেছিলেন ভগৎ সিং এবং তিনিই ছিলেন বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃৎ। এই তরুণ বিপ্লবী ভগৎ সিং এবং ‘স্বতন্ত্র বীর’ হিসাবে পরিচিত বিনায়ক দামোদর সাভারকারের মধ্যে ছিল এক ‘সংবেদনশীল সংযোগ’, যা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করা হয়নি। বিপ্লবের আঙিনায় ভগত সিং সাভারকরকে ‘আদর্শ’ হিসাবে দেখেছিলেন।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘মতওয়ালা’ পত্রিকায় ১৯২৪ সালের ১৫ এবং ২২ নভেম্বরের সংখ্যায় ভগত সিংয়ের ‘বিশ্ব প্রেম’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ”বিশ্বপ্রেমী হলেন সেই নায়ক যিনি তীব্র উগ্রবাদী, গোঁড়া নৈরাজ্যবাদী, আর এটা বলতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা লাগছে না যে এইরকমই এক দেশনায়ক হলেন— বীর সাভারকর। বিশ্বপ্রেমের জোয়ারে ভাসতে গিয়ে আমরা সেই নরম ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটা প্রত্যাখান করে দিয়েছিলাম যে নরম ঘাস পায়ের নীচে কাঁটার মতো ফুঁটে”…বলবন্ত সিং ছদ্মনামে এই নিবন্ধটি লেখা হয়েছিল। (রেফারেন্স- ভগত সিং এবং তাঁর সহযোগীদের সম্পূর্ণ উপলব্ধ নথি, পৃষ্ঠা নং ৯৩, পুনর্মুদ্রণ মে ২০১৯, রাহুল ফাউন্ডেশন, লখনৌউ।)
যেদিন ভগত সিং এই নিবন্ধটি লিখেছিলেন, তখন সাভারকর রত্নগিরিতে গৃহবন্দী ছিলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
শহীদ ভগত সিং ১৯২৮ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ‘কীর্তি’ প্রকাশনায় ‘ফ্রীডম মিটস্ মার্টারডম’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯২৮ সালের এই নিবন্ধে, আগস্ট সংখ্যার মুখ্য উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছিল যে— ‘আমাদের উদ্দেশ্য হ’ল সেই জীবনী গুলিকে ছাপানো এবং আন্দোলনের অগ্ৰগতিকে যথাযথভাবে তুলে ধরা যাতে পাঠকরা বুঝতে পারেন পাঞ্জাবে কীভাবে জাগরণ শুরু হয়েছিল এবং কিসের জন্য ছিল এই জাগরণ, কিভাবেই বা চলছিল এই কর্মকাণ্ড আর কেনোই বা শহীদরা তাদের জীবনের বলিদান দিয়েছিল?
একই নিবন্ধে লেখা হয়েছিল কিভাবে কার্জন ভাইয়ালি কে মেরেছিলেন বিপ্লবী মদনলাল ধিঙ্গরা এবং সাভারকর। ভগত সিং বলেছেন, “স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব ইংল্যান্ডেও পৌঁছেছিল এবং মিঃ সাভারকর ‘ইন্ডিয়া হাউস’ নামে একটি সভা শুরু করেছিলেন। মদনলালও এর সদস্য হয়ে গেল…। একদিন অনেক রাত পর্যন্ত শ্রী সাভারকর ও মদনলাল ধীঙ্গরা পরামর্শ করলেন। জীবন বিসর্জন দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহসের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সাভারকর মদনলালকে মাটিতে হাত রাখতে বললেন এবং তাঁর হাতে একটি কীলক গেঁথে দেন, কিন্তু এই পাঞ্জাবী বীর একটু টু শব্দটিও করেননি, কোনো দীর্ঘশ্বাস পড়েনি। কীলক সরানো হয়েছিল। দুজনের চোখ জলে ভরে উঠেছিল, তাঁরা দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন। ওহ্, এটা কি সুন্দর একটা সময় ছিল। ঐ চোখের জল ছিল অমূল্য, শাশ্বত! এ ছিল এক গৌরবময় যুগলবন্দী! পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের কী জানা উচিত? নাহ্, সেইসব ভীরু মানুষদের কথা নয়, যারা মৃত্যুর কথা ভেবেই ভয় পায় বরং জানুন সেইসব মহৎ, পবিত্র প্রানগুলির কথা যাঁরা দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে নিজেদের জীবনকে অর্ঘ্য হিসাবে নিবেদন করেছিলেন দেশমাতার পায়ে!’
(তথ্যসূত্র- ভগত সিং এবং সমস্ত তার সঙ্গীদের দলিলগুলি উপলভ্য, পৃষ্ঠা নম্বর ১৬৬-৬৮, পুনর্মুদ্রণ মে ২০১৯, রাহুল ফাউন্ডেশন, লখনউ)
বিখ্যাত মারাঠি ইতিহাসবিদ ওয়াই.ডি. ফাড়কের মতে, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কিত সাভারকারের বই ‘১৮৫৭- ইন্ডিপেনডেন্স সামার’ বইটির ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন ভগৎ সিং এবং তা বিপ্লবীদের মধ্যে প্রচার করেছিলেন। (তথ্যসূত্র- গবেষণা সাভারকরঞ্চ, ওয়াই.ডি.ফাড়কে, শ্রীবিদ্যার প্রকাশন, পুনে)
ভগৎ সিং সাভারকারের অন্য একটি বই ‘হিন্দুপাদপদশাহী’ থেকেও অনুপ্রানিত হয়েছিলেন। কারাগারে বন্দী অবস্থায় থাকার সময় ডায়েরিতে তিনি এই বইটি সম্পর্কে লিখেছিলেন:
ত্যাগ তখনই প্রশংসিত হয় যখন তা সত্যি হয় এবং সাফল্যের জন্য অপরিহার্য হয়। তবে যে ত্যাগের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত সাফল্য পাওয়া যায় না তা তো একপ্রকারের আত্মহত্যা, আর তাই মারাঠা যুদ্ধে এর কোনও স্থান নেই। (হিন্দুপাদপদশাহী, পৃষ্ঠা ২৫৭)
মারাঠাদের সাথে লড়াইয়ের অর্থ হলো, বাতাসের সাথে লড়াই করা, জলের উপরে জল ছোঁড়া। (হিন্দুপাদপদশাহী, পৃষ্ঠা ২৫৮)
বীরত্বপূর্ণ কাজ না করে, সাহসিকতার প্রদর্শন না করে, অকুতোভয় না হয়ে ইতিহাস গড়তে চাওয়া আমাদের সময়ে দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। আর আমাদের সাহসিকতা বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ না পাওয়া ছিল দুর্ভাগ্যজনক।
(হিন্দুপাদপদশাহী, পৃষ্ঠা ২৬৫-২৬৬)
রাজনৈতিক দাসত্বের উচ্ছেদ যে কোনও সময়েই হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সাংস্কৃতিক আধিপত্যের শেকল ভাঙা মুশকিল। (হিন্দুপাদপদশাহী, পৃষ্ঠা ২৭২-২৭৩)
হে স্বাধীনতা, যার হাসিমুখ দেখার আশা আমরা কখনই ছাড়িনি, যান সেই আক্রমণাত্মক, বোকা মানুষগুলোকে বলুন ‘ শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার চেয়ে, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আপনার মন্দিরে আমাদের এই রক্তপ্রবাহ বজায় রাখাও আমাদের কাছে মধুর’ টমাস মুরের এই লাইনগুলি লিখেছিলেন সাভারকর ( হিন্দুপাদপদশাহী, পৃষ্ঠা ২১৯)
‘ধর্মান্তরিত হওয়ার বদলে নিহত হন’ এটাই ছিল তৎকালীন সময়ে হিন্দুদের মধ্যে ওঠা বহুল প্রচলিত স্লোগান। কিন্তু রামদাস উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘না, এটি ঠিক নয়’। ধর্মান্তরিত না হয়ে নিহত হন – এটি ভাল তবে তারচেয়েও বেশী ভালো— ‘না তো মারা যাবেন, না তো ধর্মান্তরিত হবেন’।
১৯৩৩ সালের ২৩ শে মার্চ ভগত সিং, রাজগুরু এবং সুখদেবকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় সাভারকর নীচের কবিতাটি রচনা করেছিলেন:
হা, ভগত সিং, হায় হায়!
আপনি ফাঁসির দড়ি বরণ করলেন, আমাদের জন্য!
রাজগুরু, আপনিও!
বীর কুমার, রাষ্ট্রসমরে শহীদ
হায় হা! জয় জয় হা! ………
রত্নগিরিতে সাভারকারের বাড়িতে সর্বদা গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করা হত। কিন্তু ভগত সিং, রাজগুরু এবং সুখদেবের বলিদানের পরের দিন, তাঁর বাড়িতে একটি কালো পতাকা উত্তোলিত হয়। ভগবতী চরণ ভোড়া এবং ভগৎ সিংয়ের অন্যান্য সহযোগীরাও ভগৎ সিং এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের মৃত্যু সাভারকর এবং তাঁর সাহিত্যের উপর কিভাবে আর কতোটা প্রভাব ফেলেছিল সেই সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। ‘ভগত সিং ও তাঁর সঙ্গীদের কর্মকান্ডের সম্পূর্ণ তথ্য’ উপলব্ধ রয়েছে। এই মহান উদ্যোগ নেওয়া এবং এইসমস্ত কিছু প্রকাশনার পিছনে রয়েছে রাহুল ফাউন্ডেশন।
আপনি এই লেখাটি পড়ছেন কারণ আপনি ভাল, সংবেদনশীল এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার মূল্যায়ন করেন। আমাদের মনে এই বিশ্বাস তৈরী করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনি এটাও জানেন যে সংবাদমাধ্যমের সামনে একটি অভূতপূর্ব সংকট দেখা দিয়েছে। মিডিয়াতে ভারী বেতন কাটা ও ছাঁটাইয়ের সংবাদ সম্পর্কেও আপনি সচেতন হবেন। মিডিয়া ক্রাঙ্কের পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। তবে একটি বড় কারণ হ’ল ভাল পাঠকরা ভাল সাংবাদিকতার আসল মূল্য বুঝতে পারছেন না।
আমাদের নিউজরুমে যোগ্য সাংবাদিকের অভাব নেই। আমাদের কাছে দেশের অন্যতম সেরা সম্পাদনা এবং ফ্যাক্ট চেকিং দল রয়েছে, পাশাপাশি খ্যাতিমান নিউজ ফটোগ্রাফার এবং ভিডিও সাংবাদিকদের একটি দল রয়েছে। আমাদের প্রচেষ্টা ভারতের সেরা নিউজ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। আমরা দৃঢ়তার সাথে এই প্রচেষ্টাটি চালিয়ে যাচ্ছি।
দ্য প্রিন্ট ভাল সাংবাদিকদের বিশ্বাস করে। তাদের কঠোর পরিশ্রমের জন্য সঠিক বেতন দেয় এবং আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন যে এইরকম গল্প আপনাদের কাছে তুলে আনার জন্য আমরা এবং আমাদের সাংবাদিকরা অত্যধিক সময় ব্যয় করতেও দ্বিধাবোধ করি না। এইসব কিছুর মূল্য অনেক। আমাদের পক্ষে সাংবাদিকতার এই মান বজায় রাখার একমাত্র উপায় হ’ল — আপনাদের মতো প্রবুদ্ধ পাঠকরা যদি হৃদয় থেকে এই প্রচেষ্টাকে গ্ৰহন করেন।
যদি আপনি মনে করেন যে আমরা একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন, সাহসী ও অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী এবং আপনাদের সহযোগিতা লাভের যোগ্য, তাহলে নীচের লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন। আপনার ভালোবাসা দ্য প্রিন্টের ভবিষ্যত করে তুলবে সুদৃঢ়।
শেখর গুপ্ত
প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক