খ্রিস্টানরা যখন ক্রমে ব্যবসায়ীক ভাবে ভারত অধিকার করল তারা তখন সঙ্গে করে নিয়ে এল তাদের রিলিজিয়ন ব্যবসার প্রজেক্ট। তাদের ব্যবসায়ীক বুদ্ধি উন্নত তাই তারা নিজেদের প্রজেক্ট বাস্তবায়নের পূর্বে ভারতের রিলিজিয়নল ব্যবসার বাজার সার্ভে করা শুরু করল। সার্ভে করে তারা এটা বুঝতে পারল যে আরেক আব্রাহামিক রিলিজিয়ন ইসলাম ভারতে প্রায় বিভিন্ন ভাবে ৭০০ শাসন করেও তেমন ভাবে সফল নয়। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম বিশ্বাস সেই সনাতনী বিশ্বাসের উপরই আস্থাশীল বহুবিধ অত্যাচার, নিপিড়ীত সহন করবার পরেও।
আরেকটি ব্যাপার তারা বুঝতে পারল ভারতের ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিমূল হল বেদ যা অধিকাংশ মানুষই না জেনেই তার তাঁর উপর আস্থাশীল। ভারতীয় ঈশ্বর বিশ্বাস গুলি বেদ কেন্দ্রিক নাহলেও কোথাও না কোথাও বেদের দ্বারা অনুপ্রাণিত এক স্থূল রূপ। খ্রিস্টান শাসকরা খ্রিস্টান রিলিজিয়ন ভারতে প্রসারের জন্য একটি বৃহত্তর কমিটি গঠন করল মেকলে,ম্যাক্সমুলার ইত্যাদি ইত্যাদি পাশ্চাত্য রিলিজিয়ন ব্রোকাররা এটা বুঝতে পারল যে ভারতের মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে ভাঙতে গেলে আগে বেদের বিকৃতি করতে হবে তাদেরই পথেই আর এই পথ যথেষ্ট সহজ কারণ ভারতীয়া বেদকে বিশ্বাস করলেও বেদ চর্চা থেকে বঞ্চিত বরং নিজেদের বিভিন্ন স্থূল ধর্ম বিশ্বাস গুলিকে বেদোক্ত বিশ্বাস বলে প্রতিষ্ঠা জন্য আগের থেকে বিভক্ত।
এইপথেই খ্রিস্টান মিশনারীর দল কিছু প্রোপাগাণ্ডা নামিয়ে দিল বাজারে যা আজও হিন্দু ফোবিক সকল বিশ্বাসের হাতিয়ার হিসাবে প্রধান অস্ত্র।
১) আর্যরা বিদেশ থেকে এসেছে, যদিও কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই কয়েকটি মন্ত্রকে বিকৃত করে মুলার সাহেব এই তত্ত্ব অবতারণা করে পরে একটি কাল্পনিক জেনেটিক বৈজ্ঞানিক থিউরি বাজারে আসে যেটা তথাকথিত শিক্ষিত ভারতীয়রা গ্রহণ করে।
২) আর্য অনার্য সংঘাত। যদিও বেদে অনার্য শব্দের ব্যাবহার একবারও তবুও মিশনারীরা এই কাল্পনিক থিওরি নামান আর্যরা অনার্যদের উৎখাত করে সভ্যতা স্থাপন করে। বস্তুত বেদের আর্য শব্দটি সংস্কৃতি সূচক জাতি সূচক নয় অনেকটি হিন্দুত্বের মতোই।
৩) অত্যাচারী ব্রাহ্মণ সমাজ, যারা ক্ষমতায় না থেকেও শাসন করত ভারত।
এইরকম আরও আছে লিখতে গেলে সময় অনেক দরকার। এইবার আসি বর্তমানে যা নিয়ে মতুয়া,বৌদ্ধ ও কমিউনিস্ট সমাজ প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে সেই অসুর থিওরি নিয়ে। দেখুন আমার দৃষ্টিকোণ বৈদিক ও ইতিহাস কেন্দ্রিক সুতরাং আপনার প্রচলিত বিশ্বাসের সঙ্গে আমার খাপ খাবেনা আগেই বলে রাখলাম আমি ম্যাজিকে বিশ্বাসী নই সুতরাং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই পরবর্তী ব্যাপার গুলি বিশ্লেষণ হবে একদল অশিক্ষিত শু য়ারের বিরুদ্ধে।
#অসুর
অসুর শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয় এক অতি অদ্ভুত, বর্বর, অত্যাচারী প্রাণীর প্রতিমূর্তি।
বিশেষ করে ভারতীয় পুরাণে অসুর নিয়ে নানান কল্পকাহিনী আছে, দেবাসুরের যুদ্ধ, দেবতাদের হাতে নানান অসুর নিধন, দেবীদুর্গার হাতে বিভিন্ন অসুর নিধনের কাহানী পুরাণের অন্যতম উপজীব্য বিষয়।
পুরাণ অনুসারে অসুরা অন্ধকারে, অত্যাচারে জাজ্বল্যমান নিদর্শন, যাদের হাতে মানুষ, দেবতা সবাই লাঞ্ছিত, নিপীড়িত। তবে দেখা যায় অসুররা যতই দেবতা ও মনুষ্য বিরোধী হোক না কেন তারাও পৌরাণিক ত্রিদেবেরই উপাসক।
এইবার দেখাযাক বৈদিক সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে অসুর শব্দের প্রকৃত অর্থ। যা সময়ে অন্তরে নিন্দা সূচক শব্দে পরিণত হয়েছে, তা কিন্তু সুদূর অতীতকালে সমাদৃত ছিল আমাদের সভ্যতায়।
অসুর শব্দটি এমন একটি শব্দ যা সময়ের অন্তরে বন্দিত থেকে নিন্দিত হয়েছে। এই লেখাতে সেই বিষয়েই আলোকপাত করবার চেষ্টা করবো।
বেদের প্রথম ভাগে যেই শব্দ প্রশংসা সূচক ছিল তা কি কারণে পরবর্তী সময়ে নিন্দিত হল সেটা চিন্তার বিষয়। এই আলোচনা শুরুর আগে আমাদের জানা উচিৎ বেদোক্ত দেব ও অসুর কারা?
শতপথ ব্রাহ্মণ বলছে “যজ্ঞেন বৈ দেবাঃ” যারা যজ্ঞ করতেন তারা দেব।দেবতা কথার অর্থ বিদ্বান ব্যক্তি, বিদ্যাংসো হি দেবাঃ(শতপথ ব্রাহ্মণ), বিদ্বান তিন প্রকার দেব,ঋষি,পিতৃ।
তেমনি অসুর শব্দের অর্থ বীর,যোদ্ধা,জাজ্বল্যমান, অসুর কোন নিন্দা সূচক শব্দ না ঋক্বেদে বহুবার প্রশংসা সূচক অভিবাদন স্বরূপ ইন্দ্র,সূর্য, বরুণ কে অসুর সম্ভাষণ করা হয়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে যে দেবাসুরের সংগ্রামের কথা পাই, সেটা বাস্তবে শক্তির সঙ্গে প্রজ্ঞার লড়াই ছিল, যেখানে বিদ্বানরা জয় লাভ করে ছিল, আর অসুররা পরাজিত হয়ে আর্য্যবর্ত ত্যাগ করে পশ্চিমে আ্যসিরিয় সভ্যতা স্থাপন করেন। কিন্তু আজ ইতিহাস বিকৃতির ফলে দেবতা বলতে অপার্থিব মহান শক্ত ও অসুর বলতে অদ্ভুত অত্যাচারী কিছু বোঝায়।
আসলে দেব বা অসুররা আমাদেরই মত মানুষ। এরা দুইদলই ভারতেরই দুইটি সুপ্রাচীন আর্য জাতি।তবে একদল যাজ্ঞিক, আর অন্যদল যজ্ঞ রহিত। বেদে ১০৫ বার অসুর শব্দের উল্লেখ আছে।তার মধ্যে ৯০ বারই প্রশংসা সূচক। যেমন অসুরঃ অসু ক্ষেপণে শত্রুণ্ ইত্যসুরঃ। যারা শত্রুদের উপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে পটু তারা অসুর। এবং অসুন্ প্রাণান রাতি দদাতি ইত্যসুরঃ।যারা প্রাণদান করে, যাদের মধ্যে দুর্দম প্রাণশক্তির প্রকাশ দেখা যায়, সেই সমস্ত শক্তিশালী বীররাই অসুরপদবাচ্য।
যাস্ক তার নিঘণ্টু ও নিরুক্ত গ্রন্থে(৩/৮) বলেছেন যে অস্ ধাতু থেকে অসুর শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে, যাস্কের মতে অসু শব্দ অর্থ শ্বাসবায়ু। বৈদিক যুগের প্রথম দিকে দেবশক্তিকেও অসুর উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে দেব শক্তির মধ্যে যারা বীর যেমন—- রুদ্র,মরুৎ,বরুন, ত্বষ্টা,অগ্নি, বায়ু, পুষা, সবিতা, সূর্য, আকাশ,ইন্দ্র এঁদের বৈদিক ঋষিরা অসুর বলতেন।
১)মরুৎ( ঋগ্বেদ ৬৪/২)
২)রুদ্র(ঋগ্বেদ ৫/৪২/২১)
৩)ইন্দ্র(ঋগ্বেদ ৫৪/৩)
৪)ররুণ(ঋগ্বেদ ২/২৭/১০)
৫)অগ্নি(ঋগ্বেদ ৫/১২/১)
প্রথম প্রথম দেব ও অসুরের মধ্যে খুব সৌভ্রাতৃত্ব ছিল।কিন্তু পরে ব্যক্তিত্ব জনিত মতপার্থক্য হতে শুরু করে, এই বিরোধ ছিল মস্তিষ্ক আর পেশীশক্তি মধ্যে। উপনিষদে উল্লেখ্য আছে যে সভ্যতার মধ্যভাগে দেবাসুরের যুদ্ধের কথা আর সেই যুদ্ধ পরমব্রহ্ম দেবানুকূলে ছিলেন তাই দেবতাদের জয় হয়েছিল।দেবতাদের নেতা ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে পরাস্ত করেন, শত্রুতা সুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে “অসুর” শব্দটি খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকলো, যেমন অসুরাঃ রাক্ষসাঃ দেবনিন্দকাঃ, ব্রাহ্মণে অসুরদের বৃত্র হিসাবে উপস্থাপ করল, বৃত্র মানে আবরণ, যা অন্ধকারের প্রতীক।
বৈদিক যুগের শেষভাগে যজ্ঞবাদী আর্যদের সঙ্গে আর্য অসুরদের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। আর্য অসুরজাতির অধিকাংশ ভারত ত্যাগ করে পারস্য ও তুর্কীস্থানে গিয়ে বাস করতে থাকেন।বাকীরা যারা রইলেন, তাঁরা প্রয়াগ, ছোটনাগপুর, তিব্বত ও কামরূপের দিকে চলে যান।
অসুরদের যে বড় দলটি ভারতের বাইরে চলে গেছিল, আজ থেকে ৫০০০ হাজার বছর আগেই তারাই ব্যাবিলনে এক সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এই সাম্রাজ্যের নাম অসুর বা আসীরিয়া।টাইগ্রীস নদীর উপকূলে এদের যে রাজধানী স্থাপিত হয় তার নাম অস্সুর।আসীরিয়দের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাতে অহুর শব্দটি অসুর শব্দের অপভ্রংশ, অহুর মাজদা এই সভ্যতার পরমেশ্বরের নাম। আসীরিয় সভ্যতার রাজরাজাদের নাম গুলির মধ্যেও অসুর শব্দটি পাওয়া যায়, যেমন অসুর-সিরি-পাল(Asurnasipal),অসুর-বনিপাল (Asurbanipal)।মোট কথা যাদের বাসস্থানের নাম আসিরীয় বা অসুর, রাজাদের নাম অসুর উপাধিযুক্ত এবং উপাস্য দেবতার নাম অসরি বা অস্সুর তারাই অসুর নামে অভিহিত।
ভারতীয় অসুরগণ দুর্গ নির্মাণে পটু ছিলেন।বেদে তার বহু প্রমাণ পাওয়া যায়।শম্বর অসুরের ছিল ৯০ টি দুর্গ(ঋ১/১৩০/৭)।বর্চী অসুরের লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা ছিল, তিনি নিজেও ছিলেন দুর্দান্ত বীর (ঋ ১০/১৫১/৩। পিপরু অসুরের বড় কেল্লা ছিল।ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে দেখি ইন্দ্র পিপরুর কেল্লা নষ্ট করে দিচ্ছেন(ঋ ১০/১৩৮/৩)।
এদিকে আসিরীয় অসুরদের যে পরিচয় পাই, তাতে তারাও যে যুদ্ধবিদ্যায় পটু ছিলেন তারও ইতিহাস সম্মত প্রমাণ আছে। তাদেরও দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল।কালক্রমে বাহুবলে এশিয়া মাইনরে হতে ককেশাস পর্বত পর্যন্ত নিজেদের অধিকার বিস্তার করেছিলেন।
ভারতীয় অসুরজাতি এবং আসিরীয় অসুরজাতি যে একই জাতি তা বলবার আরও কিছু কারণ আছে।
আসিরীয়রা দুরকম শ্মশান তৈরী করতেন।একটি ছিল তাদের তাবুর আকৃতি আর একটি ডিম্বাকৃতি। শতপথ ব্রাহ্মণে দেখি দেবতাদের শ্মশান ছিল চতুবস্রাকার আর অসুরদের শ্মশান ছিল গোলাকার(১৩/৪/১/৫)
আসীরীয় অসুররা মার্ডুকের প্রতীক প্রতীক পূজা করতেন। এই প্রতীক বাণাকৃতি। storm god এর পূজাও এদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।এদিকে ভারতীয় অসুররাও ছিলেন রুদ্রোপাসক।বেদে রুদ্রও strom god রূপে চিত্রিত।
আর এই দুই জাতীই ছিল মায়ার উপাসক।
অসুররা ছিল ভারতেরই একটি প্রাচীন জাতি,ভারতের আর্য জাতির বংশধর, তারা আমাদের মত মনুষ্যদেহধারী এবং আসিরীয়রাই সেই অসুরজাতির বংশধর।
তবে এই ব্যাখ্যা আধ্যাত্মিক ভাষ্য অনুযায়ী নয়,কিন্তু আধ্যাত্মিক ভাষ্যমতেও অসুর প্রশংসনীয় শব্দ।
G.SMITH এর লেখা ১৮৮৩ বই Assyrian Discoveries বইটা দেখতে পারেন বিষদ ভাবে জানাবার জন্য।
(এই লেখার তথ্য সূত্র বৈদিক ভারত, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, )
এইবার যে পৌরাণিক মহিষাসুর নিয়ে হ্যাজ নামাচ্ছে হিন্দু ফোবিকের দল সেই মহিষাসুরও আবার কিছু হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী শিবের অংশ।
হিন্দু সমাজে শয়তান বা evil এর কোন অস্তিত্ব নেই এখানে ন্যায় আর অন্যায় প্রতিষ্ঠিত এখানে রামের উপাসকরা রাবণের অসম্মান করেনা করে নিন্দা।পৌরাণিক মহিষাসুর হিন্দুদের ব্যক্তিগত ব্যাপার তারা তাকেও পূজা করে দুর্গাপূজা পদ্ধতির মাধ্যমে সুতরাং অহিন্দুরা যদি এ-ব্যাপারে নাক গলায় সেক্ষেত্রে আইন যদি সাহায্য না করে হিন্দুরাও বাধ্য হয়ে তাদের বিশ্বাসের উপর আঘাত করবে তখন আবার নাটক যেন শুরু না হয়।
– সুমিত ভরদ্বাজ