শঙ্করাচার্য বিবেক – চূড়ামণি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছিলেন-
দুর্লভং এয়ং এব, এতেৎ দেবানুগ্রহ হেতুকম্
মনুষ্যত্বং মুমুক্ষং মহাপুরুষশ্রয়ম্।।
মানব জনম , মুক্তি লাভের আগ্রহ এবং মহান ব্যক্তির সঙ্গলাভ – এই তিন ভগবৎ কৃপালভ্য, অন্যথা দুর্লভ। এই কলিযুগে মানব জনমে মুক্তি ঘটায় বিদ্যা স্বরূপ মহামায়া এবং তাঁর আশীর্বাদ প্রাপ্ত মানষ পুত্র কন্যাগণ। তেমনি একজন ছিলেন অনীশ দেব। ঘাসের শীষ নেই’, ‘তীরবিদ্ধ’, ‘সাপের চোখ’-এর স্রষ্টা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন রিডার অনীশ দেবের লেখালিখির শুরু ১৯৬৮ সালে। সম্পাদনা করেছেন সেরা কল্পবিজ্ঞান, সেরা কিশোর কল্পবিজ্ঞানের মতো গ্রন্থ। তাঁর জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক বই– বিজ্ঞানের হরেকরকম, হাতে কলমে কম্পিউটার, বিজ্ঞানের দশদিগন্ত ইত্যাদি। তিনি ছিলেন আমার কল্পবিজ্ঞান ও সাসপেন্স থ্রিলারের নায়ক। প্রেমেন্দ্র মিত্র আর সত্যজিতের পর বহু লেখক কল্পবিজ্ঞানে ঝুঁকেছেন। এর মধ্যে বিমল কর অন্যতম। তাঁর লেখা মন্দারগড়ের রহস্যময় জোৎস্না বাংলা কল্পবিজ্ঞানের অমূল্য এক সম্পদ। কল্পবিজ্ঞান লিখেছেন লীলা মজুমদার, শীর্ষেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদারদের মতো প্রথম সারির লেখকেরাও। সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের কর্নেল সিরিজের বেশ কয়েকটি কাহিনি কল্পবিজ্ঞাননির্ভর। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের সেরা গল্প গুল্পগুলো নিয়ে অনীশ দেব সংকলন করেছেন দুটি বই। সেরা কল্পবিজ্ঞান আর সেরা কিশোর কল্পবিজ্ঞান বই দুটি পড়লেই বোঝা যায় কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখার হাত বাঙালি লেখকদের কম শক্তিশালী নয়।
অনীশ দেবের জন্ম ১৯৫১ সালে কলকাতায়। অনীশ দেবের লেখালেখির শুরু মাত্র সতেরো বছর বয়সে। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৬৮-তে অধুনালুপ্ত মাসিক ‘রহস্য’ পত্রিকায়। তারপর থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নামজাদা বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখার প্রধান বিষয় – গোয়েন্দা-রহস্য, থ্রিলার, ভৌতিক-অলৌকিক এবং কল্পবিজ্ঞান। গল্পের বই ছাড়াও তিনি বাংলায় কয়েকটি কিশোরপাঠ্য বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থও রচনা করেছেন। পাশাপাশি ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যার উপর লেখা তার কিছু ইংরেজি বইও রয়েছে। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সংকলন গ্রন্থ সম্পাদনার কাজেও নিযুক্ত ছিলেন তিনি। কিছুকাল সম্পাদনা করেছেন কিশোর বিস্ময় পত্রিকা।
২০১৯ সালে কিশোর সাহিত্যে জীবনব্যাপী অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যাসাগর পুরস্কারে সম্মানিত হন অনীশ দেব। এর আগে প্রাচীন কলাকেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮) ও ডঃ জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ পুরস্কারে (১৯৯৯) সম্মানিত হয়েছেন তিনি।
একমাত্র অনীশ দেব ছাড়া অন্য কারো রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের কোনো নিদর্শন এই মুহূর্তে বাজারে না থাকা হয়তো জঁর ফিকশনের অনিবার্য নশ্বরত্বকেই চিহ্নিত করে। বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য এখনও তাঁর হাত ধরেই বেঁচে আছে।
তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে আছে তেইশ ঘন্টা ষাট মিনিট, ষাট মিনিট তেইশ ঘন্টা, ভয়পাতাল, পাতাল ঝড়, ভূতনাথের ডায়েরি, অশরীরী ভয়ঙ্কর, দেখা যায় না শোনা যায়, এক বিন্দু সন্দেহ প্রভৃতি। এছাড়াও তিনি সাহিত্য সঙ্কলন সম্পাদনার ক্ষেত্রেও এক উজ্জ্বল ছাপ রেখেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শতবর্ষের সেরা রহস্য উপন্যাস, রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা পত্রিকার সেরা ১০০ গল্প, রক্ত ফোটা ফোটা, বিশ্বের সেরা ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প ইত্যাদি। এম.টেক. ও পি.এইচ.ডি. ডিগ্রিধারী বিজ্ঞানের প্রফেসর অনীশ দেব বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্র এত সাবলীল ভাবে তাঁর নানা বইতে তুলে ধরেছেন তাঁর বিজ্ঞান যখন ভাবায়, বিজ্ঞানের হরেক রকম, রোমাঞ্চকর ধূমকেতু, কেমন করে কাজ করে যন্ত্র প্রভৃতি বইয়ের মাধ্যমে।
আমি কেবল অনীশ দেব পড়ে জিশান হতে চেয়েছিলাম। তবে, আজকের যুগে তো আমরা সবাই জিশান।জরুরী প্রয়োজনের‘ জায়গায় রাখুন ন্যূনতম খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষার অধিকার। আর ‘খেলার‘ জায়গায় রাখুন লড়াই। আপনারই চেনা কারও সাথে অথবা অচেনা কিন্তু আপনারই মত প্রয়োজনের তাগিদে উঠে আসা কোনো মানুষের সাথে আপনার সংগ্রাম।
চেনা লাগছে? ঠিকই ধরেছেন, খেলার নাম ‘জীবন‘ ওরফে বেঁচে থাকার লড়াই। যেখানে রোজকার চাহিদাগুলো পূরণ করতে প্রতিটি মানুষকে নামতে হয় যুদ্ধে, অন্য মানুষদের হারিয়ে অস্তিত্বের সংগ্রামে থেকে যাবার আশায়।
তেইশ ঘন্টা ষাট মিনিটে এই টিকে থাকার লড়াই আবহ দিয়েছেন আজ থেকে আরো সোয়া তিনশ বছর পরের। যেখানে বৈষম্য আর উঠোন, ব্যালকনিতে বিভক্ত নয়, একটা গোটা শহর ভাগ হয়ে গেছে ‘ওল্ডসিটি‘ আর ‘নিউ সিটিতে‘। নিউ সিটির প্রযুক্তি, বৈভবের জীবনযাত্রা যেখানে স্বর্গের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়, সেখানে ওল্ড সিটিতে বাড়িঘর ভেঙে এখনশুধুই নোংরা বস্তির ভিড়। মাঠে ঘাস নেই, মাটিতে গাছ নেই, মানুষের হাতে কাজ নেই। অপরাধের সংখ্যা যত বেড়েছে পাল্লা দিয়ে কমেছে চিকিৎসা এবং শিক্ষার সুযোগ। প্রশাসন নেই বললেই চলে কেবল বিনাপয়সার বিনোদন আছে! কেমন সেই বিনোদন?
বিনোদনের যদিও হরেক নাম তবে তার মধ্যেও সবচেয়ে জনপ্রিয় হল ‘কিল গেম‘! যে খেলার কোয়ালিফায়িং পর্ব আর মূলপর্বে প্রতিযোগীরা কখনো লড়াই করে হিংস্র জানোয়ারের সাথে কখনো একে অপরের সাথে। নিয়ম একটাই, হয় মরো অথবা মারো। সেই খেলার (?) অবিরাম সম্প্রচার হয় দুই শহরেই। নিউ সিটিতে বিজ্ঞাপনের টাকা উসুল করতে আর ওল্ড সিটিতে কারণ, পরের গেমের জন্য চাই আরো আরো উত্তেজনা দিতে পারে এরকম খেলোয়াড়! চাই এমন কাউকে যে জীবনের জন্য লড়বে বেঁচে থাকার তোয়াক্কা না করেই।
গল্পের মূল চরিত্র জিশান কিভাবে এই মারনখেলায় ঢুকে পড়ে আর কিভাবে বিভিন্ন খেলায় সে মহড়া নেয় অসম প্রতিযোগীদের তাই নিয়েই গল্প। আর তার মাধ্যমেই সে এগিয়ে যায় সেই অমোঘ খেলার দিকে, যেখান থেকে কেউ ফেরেনি আজ পর্যন্ত, যার নাম ‘কিল গেম‘। দিন গুজরানের রোজকার লড়াই থেকে এই গল্পের প্রতিটা লড়াই একটা জায়গায় শুধু আলাদা। আমাদের একেকটা যুদ্ধ জিতে ফেরার পুরস্কার ‘একটু ভাল করে বাঁচা‘, এখানেও পুরস্কার তাই। কেবল ব্যর্থতার মূল্যটা একটু আলাদা। এখানে মুহূর্তের ভুল মানেই হার, হার মানে মৃত্যু।
অনীশ দেবের লেখা ভয়ের আর কল্পবিজ্ঞানের ছোটগল্প পড়া ছিল এর আগে, তাই টানটান লেখনী সম্পর্কে ধারণা ছিলই। তবে যেরকম সংলাপধর্মী বর্ননা এবং দুতিন বাক্যের প্যারাগ্রাফে পুরো বইটা লেখা হয়েছে তাতে বই পড়াটা আধমিনিটের জন্যেও ক্লান্তিকর হয়নি বোধ হয়। চমৎকার! সত্যি বলতে কি, লেখাটা পড়তে পড়তেই, প্রায় সিনেমা দেখছি এই ভাবনা একবারের জন্যেও না আসাটা অসম্ভব, এতটাই বেশি বেশি করে সিনেম্যাটিক মুহূর্ত ছড়িয়ে রয়েছে পুরো বইটায়।
সেই কিল গেমেই হেরে গেলেন অনীশ দেব। প্রয়াত সাহিত্যিক অনীশ দেব (Anish Deb)। করোনায় (Corona) আক্রান্ত হয়েছিলেন অনীশ বাবু। বুধবার সকাল ৭.১৮ মিনিটে মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল তাঁর। ভর্তি ছিলেন কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়েছিল তাঁকে। দরকার পড়েছিল প্লাজমা ডোনারের। কিন্তু কোনও কিছুতেই আর লাভ হল না। চিরবিদায় নিলেন অনীশ দেব। লেখকের জন্য এবি পজিটিভ রক্তের প্লাজমার দরকার ছিল। মঙ্গলবার রাত থেকেই নেটমাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাহাকার পড়ে গিয়েছিল প্লাজমার খোঁজে। জানা যায়, বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে প্লাজমা জোগার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভেন্টিলেশন থেকে ফিরতে পারলেন না সাহিত্যিক।
তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যে শেষ হয়ে গেল একটা অধ্যায়। কল্পবিজ্ঞানের জগতে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বড় নাম ছিলেন অদ্রীশ বর্ধন ও অনীশ দেব। অদ্রীশ গত বছরই মারা গিয়েছিলেন। প্রয়াত হলেন অনীশ দেবও। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া বাংলার সাহিত্য মহলে।
আসলে অনীশ দেব নিশ্চয় অনেক বড় লেখক ছিলেন , খ্যাতি ছিল। কিন্তু খ্যাতি ওনার সাধারনত্বকে , ওনার মাটির কাছে থাকা , মাটির গন্ধকে গ্রাস করতে পারে নি। সদা মিশুকে মানুষটি অমায়িক হেঁসে সবার সাথে কথা বলতেন। কোনো বইমেলায় ওনার সাথে নিতান্ত সাধারণ অপরিচিত হয়ে অটোগ্রাফ নিতে বা সেলফি তুলতে গেলে তাঁর সঙ্গেও উনি মিষ্টি হেঁসে কুশল কথা বলতেন। তাই অনীশ দেবকে দেখে একটা শ্লোক মনে হতো –
অষ্টাদশ পুরাণেষু ব্যাসস্য বচনদ্বয়ম্।
পরোপকার পুণ্যায় , পাপায় পর পীড়নম্।।
পরোপকারে পুণ্য হয়, অন্যকে কষ্ট দিলে পাপ হয়। অতএব মন বচন ও কর্মে কোন জীবের কষ্টের কারণ হবে না। উনি তেমনটাই ছিলেন। ছিলেন বলেই নিতান্ত আমাদের মতো সাধারণ পাঠকেরাও আজ লেখক হারা হয়েছি।
আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো, পৃথিবী,
শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদীতলে।
মহাবীর্যবতী, তুমি বীরভোগ্যা,
বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে,
মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে;
মানুষের জীবন দোলায়িত করো তুমি দুঃসহ দ্বন্দে।
ডান হাতে পূর্ণ করো সুধা
বাম হাতে চূর্ণ করো পাত্র,
তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত করো অট্টবিদ্রূপে;
দুঃসাধ্য করো বীরের জীবনকে, মহৎজীবনে যার অধিকার।
©দুর্গেশনন্দিনী