কলকাতার সাহিত্য-সিনেমার পরিসর কার্যত দখল করে রেখেছে সেকুলাররা। সেখানে মিষ্টি মিষ্টি সম্প্রীতির বাণী বিতরণ করা হয়। তেমনই একটি সম্প্রীতিমাখা বই নিয়ে বধ্যভূমি পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রতিক্রিয়া লিখলেন একজন বাঙালী।
সাহিত্যের স্বাধীনতা ভালো, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে যদি সুপরিকল্পিতভাবে নিজেদের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ মিশিয়ে দেওয়া হয়, তাকে আমাদের সচেতনভাবে চিনে নিতে হবে। পড়ুন।
পাঠ_প্রতিক্রিয়া
পড়ে ফেললাম একশো ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার এই অপন্যাসিকাটি। হ্যাঁ, উপ নয়, অপ- উপসর্গটিই আমি বসাচ্ছি এই লেখা প্রসঙ্গে। অথচ এর বাচনভঙ্গিটা বেশ ভালই ছিল, আদুরে, শান্তিমাখা। তিথিডোর-এর বুদ্ধদেব বসুর লেখনীকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু ত্রিশ পাতা পার হবার পরই ভ্রু কুঁচকে উঠে। কেন?
আমি কেন কলকাতা ঢাকা দুইখানের প্রগতিশীল সাহিত্যিক, সিনেমাকারদের ভণ্ড হিপোক্রেট বলি?
উত্তর নিচে সুষুপ্ত পাঠকের একটি লেখানুযায়ী ব্যাখ্যা করছি। এই বইটির সুনাম কলকাতার লেফটিস্টরা আকাশে বাতাসে (পড়ুন, বিভিন্ন সাহিত্যের গ্রুপে) প্রচার করছে আর আমাদের এদেশীয় কিছু অল্পবুদ্ধি লোকও যে নাচতেছে তা নিয়ে — সেখানে বড় সমস্যা হলো, ইতিহাসের “মাছ”কে ভয়ানক সুগারকোটের “শাক” দিয়ে ঢাকা।
খাবারের পদ-নারীর সংগ্রাম ওসব আমরা “সাতকাহন”, শঙ্করের ভ্রমণসমগ্র, ভোম্বল সর্দারে পড়েছি। আসল জিনিসটা বলি।
গল্পের মূল চরিত্র ইন্দুবালা খুলনার মেয়ে, কিন্তু তার বাবা তাকে কলকাতা বিয়ে দেয়। তখনো ১৯৭১ সাল আসেনি। কিন্তু কেন ইন্দুকে ওপারে বিয়ে দিয়ে দেয়, সেপ্রসঙ্গে লেখক বারবার মনিরুল নামে এক প্রেমিকের প্রসঙ্গ এনেছেন। মনিরুলের মত আরো একটি চরিত্র আছে, রিয়াজ। সেও হিন্দু মেয়ের সাথে প্রেম করে। মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “পূর্ব-পশ্চিম”-এর মত। ঢাকার বাসিন্দাদের ফ্যান্টাসি হিন্দু মেয়ে ভোগকে যিনি নিয়ে গেছিলেন অনন্য মাত্রায়। সেখানে তুতুলসহ আরো পাঁচটি কেস ছিল মুসলমান ছেলে হিন্দু মেয়ে নিয়ে। তাইতো আমাদের কলেজস্ট্রীট- মানে নীলক্ষেতে এই ট্রিলজির আর দুটো পার্টের চেয়ে পূর্ব পশ্চিম বেশ জনপ্রিয়।
আমি বিশ্রী বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করি যে, ইন্দুর বর বা রিয়াজের প্রেমিকার পরিবারকে ঢাকাই সিনেমার খলনায়ক মিশা সওদাগরের মত চিত্রায়ণের অপচেষ্টা করেছেন লেখক কল্লোল লাহিড়ী। আর মনিরুলদের বেলায় মুসলিম পরিচয়ের গেম খেলে তাদের চিত্রিত করেছেন একদম সজল নয়ন কোমল নবদূর্বাদলশ্যাম হিসেবে।
আরো হাস্যকর ব্যাপার যে ১৯৫০ সালের অতবড় হিন্দু নিধনযজ্ঞের কোন উল্লেখ তো নেইই, উল্টো রিয়াজকে নাকি গ্রামের হিন্দুরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। তার হিন্দু প্রেমিকাকেও। পাকিস্তান বা ইউপির অনার কিলিং তিনি একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘাড়ে অনায়াসে চাপিয়ে দিলেন।
তো মেয়ে যাতে মুসলিম ছেলের সাথে বেশি না মেশে তাই ইন্দুর বাবা ভারতে মেয়ের বিয়ে দেন।
সেখানে আপনার ৭১ সালে ঘরে ইন্দুর মা, ভাইকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার কথা আছে। কিন্তু খুলনায় হিন্দু নারী ও বাড়িকে “গণিমতের মাল” আখ্যায়িত করে শর্ষিনার পীর যে চিঠি লিখেছিলেন, তা নিয়ে কোন উল্লেখ নেই। মানে সেখানে ধর্ম মুখ্য না। চমৎকার। আগ্রহী পাঠক বিস্তারিত জানতে ২০১৭ সালে প্রকাশিত, সহুল আহমেদ রচিত “মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের ব্যবহার” ও ২০২০ সালে প্রকাশিত আফসান চৌধুরীর “হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর” পড়তে পারেন।
তো এখন আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশি (পূর্ব পাকিস্তানি) হিন্দুরা আসলে কেন দেশ ছাড়ছিল?
১৯৬৪ সালে ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের হাজার খানেক মানুষ সাম্প্রদায়িক হামলায় মারা গেলো অথচ সেই ঘটনা নিয়ে কেউ উপন্যাস লিখল না! ১৯৬৪ সালের ১৮ জানুয়ারি ইত্তেফাকের রিপোর্টে থেকে জানা যায় পুরান ঢাকার হিন্দুদের ৯৫ ভাগ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১ লক্ষ হিন্দু জনগোষ্ঠি ঢাকা শহরে গৃহহীন অবস্থায় বসবাস করছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানায় ১০০০ মানুষ এই হামলায় মারা গেছে! ঢাকা মেডিকেলে ৬০০ লাশ দেখার কথা একজন নার্স জানায়। ঢাকা শহরের স্কুলগুলো শিক্ষক ও স্টুডেন্ট শূন্য হয়ে যায়। কারণ তখনও শিক্ষক ও স্টুডেন্টের ৮০ ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলো। তুচ্ছ একটি চুলের জন্য এতবড় ঘটনা এত মৃত্যু ঘটে গেলো তবু লেখক শিল্পীদের মত সংবেদনশীল গোষ্ঠীর মনে দাগ কাটল না? মানুষগুলো হিন্দু ছিলো বলে?
এদেশে বা কলকাতায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেও বড় বড় সাহিত্যিক কবি এসেছে। তারাও কেউ ৫০ ৬৪ ৬৫ সালের হিন্দু নিধন নিয়ে উপন্যাস নাটক কবিতা লিখেননি মুসলমানদের কাছে “সাম্প্রদায়িক” সন্দেহভাজন না হতে এবং জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে।
৬৪ সালে ভারতের এক মসজিদ থেকে নবীজী (স.)এর চুল চুরি যাবার অভিযোগে বাংলাদেশের নিরীহ হিন্দুদের উপর হামলে পড়ে সংখ্যাগুরু জনতা। এরা নাকি ‘গুটিকয়েক’ সাম্প্রদায়িক কীট। বাকী ৯৯ ভাগ নাকি অসাম্প্রদায়িক! তাহলে ৬৪ সালের ঘটনা নিয়ে সত্যজিৎ মৃণাল ঋত্বিক বা জহির রায়হান, আলমগীর কবির কেউ সিনেমা বানাল না কেন? সৈয়দ শামসুল হক ৬৩ সালে আনারকলি নামে উপন্যাস লিখলেন দেশভাগের উপর। তাও উপন্যাসের প্রেক্ষাপট পাঞ্জাব ও লাহোর। কিন্তু পরের বছরের দাঙ্গা চাক্ষুষ করে কিছু লিখেননি। হুমায়ুন আহমেদ দেড়শটির মত উপন্যাস লিখেছেন। অনিল বাগচীর একদিন- নামক উপন্যাসে অনিলকে তার বোনের মুসলমান ছেলের সাথে সম্পর্ক মেনে নেওয়ানো দেখিয়েছেন। “মাতাল হাওয়া”-তে হিন্দু মেয়েকে ইসলামে পজিটিভলি ধর্মান্তরিত করা দেখিয়েছেন। কিন্তু ৯০-২০০১-০৩ নিয়ে কখনো তার কলম সরেনি।
৯০ এর বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভয়াবহ হিন্দু নিধন নিয়ে উপন্যাস লিখেন তসলিমা নাসরিন। শুধুমাত্র এই উপন্যাস লেখার কারণ তসলিমার উপর বাংলাদেশের সমস্ত কবি সাহিত্যিক তাদের সমর্থন তুলে নেয়। তারা বলতে থাকে বাংলাদেশে এরকম সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেনি তসলিমা বিজেপির টাকা খেয়ে ‘লজ্জ্বা’ উপন্যাস লিখেছে। আহমদ ছফার মত ভণ্ড, মেয়ে দেখলেই লুলামি করা বুদ্ধিজীবী মানুষজন এগুলো লিখতো। এরা যে আজকের বামদের আদর্শ হবে না তো কী হবে?
আমাকে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে “আহা রে” সিনেমার পরিচালক রঞ্জন ঘোষ নিজ মুখে বলেছিলেন তারা ইচ্ছে করেই বেশি বেশি মুসলমান ছেলে হিন্দু মেয়ের প্রেম দেখাচ্ছেন, বিজেপির “লাভ জিহাদ” প্রচারণার কাউন্টার দিতে। কিন্তু গুগলে সার্চ দিয়ে নানা ঘটনা দেখলে আসলে বিজেপির কথাটাই সত্যি মনে হয়। আপনারাও চাইলে অমুসলিমদের সাথে বিবাহ- টার্মটি গুগলে সার্চ দিয়ে পড়তে পারেন।
ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – তাই একটি অপসাহিত্য, মিঠে বুলি, একটু মহাভারতের কোটেশনের আড়ালে একগাদা কাউন্টার প্রোপাগাণ্ডার লিফলেট ছাড়া আর কিছুই নয়। সুপাঠকদের উচিত এমন অপলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।
✍🏽 নতুন ইহুদি