দোহাই ডাক্তার, আর যাই করো। অপারেশানের কথা বোলো না। কাতরস্বরে বললেন রবীন্দ্রনাথ।

বিধান রায় একটু যেন বিরক্তই হলেন। তবু যথাসম্ভব গলাটা মিষ্টি করে বললেন – কেন এরকম ছেলেমানুষি করছেন বলুন তো। অলরেডি অনেক দেরী হয়ে গেছে। তখন পইপই করে বারণ করলাম। শুনলেন না। কালিম্পং যাবার পরই কিরকম বাড়াবাড়ি হল দেখলেন ত ?

অভিমানী রোগী মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।

ধন্বন্তরি চিকিৎসক এবার হেসেই ফেললেন। নাহ্। আপনি রেগে গেছেন দেখছি। আচ্ছা, আপনার এর আগে অপারেশান হয়নি ?

হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ধীরেধীরে বললেন। লন্ডনে।পাইলসের জন্যে। প্রায় আঠাশ ঊনত্রিশ বছর আগে।

তারপর কেমন ছিলেন। ভাল না ?

তা অবশ্য। একেবারে ভাল না হলেও, নাইনটি পারসেন্ট ত বটেই।

তাহলে ?

মনটা মানছে না হে। বুঝতে পারছি তোমাদের যুক্তি। আমি বুঝতে পারছি পরপারের ডাক এসে গেছে। তাই চাইছি আমার এই শরীরটা যথাসম্ভব নিটোলভাবে তেনার হাতে সমর্পণ করতে।

না। না। এরকম বলছেন কেন। প্রস্টেটটা বড় হয়ে গিয়ে ঝামেলা করছে। শরীরে ইউরিয়া বেড়ে যাচ্ছে। সুপ্রাপিউবিক সিস্টোস্টমি করে দিলেই ঝামেলা চুকে যাবে। বিধান রায় আশ্বাস দিলেন।

ও বাবা। কি অপারেশান ? এ তো বড্ড খটোমটো নাম।

মানে হল ইউরিনারি সিস্টেমের বাইপাস। ইউরিনটা আর আটকাবে না।

তাই বলো। যার ভালো নাম জ্যোতিষার্ণব, তারই ডাক নাম যতে। রবীন্দ্রনাথ মুচকি হেসে বললেন।

আজ তাহলে উঠি ?
বিধান রায় উঠে পড়লেন। শান্তিনিকেতন যেতে চান শুনলাম। যান, ঘুরে আসুন। তারপর একটা সেলুন কার বুক করে চটপট জোড়াসাঁকো চলে আসুন। দেরী করবেন না।

আর দেরি ! মরার জন্য আমার তর সইছে না। অস্ফুটে বললেন রবীন্দ্রনাথ।

কিছু বললেন নাকি। বিধান রায় আবার ঘুরে দাঁড়ালেন।

না, কিছু না। তুমি সাবধানে যেও।

শান্তিনিকেতনে ফিরেও একই সমস্যা।
রথীন্দ্রনাথও একদিন বলেই ফেললেন – বাবামশাই, অপারেশানটা করিয়েই নিন। সবাই বলছে।

দূর, তোমাদের সবারই এক কথা। আমার শরীরটাও ফুটোফাটা না করে কারোর শান্তি নেই।
রবীন্দ্রনাথ পাশ ফিরে শুলেন। বড্ড হতাশ লাগছে। বহুদিন আগে কান ভনভনানির জন্য ইউনানি ওষুধ খেলেছিলেন। তাতে রোগ সারলো। কিন্তু বড্ড ডিপ্রশান হয়েছিল। অ্যালোপাথির নাম শুনলেই সেইরকম ডিপ্রেশন যেন ফিরে ফিরে আসছে। আর এই কাটাছেঁড়ার কথা ভাবলেই কবির হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে আসে। তিনি নিজেই বুঝতে পারছেন তার যাবার সময় এগিয়ে আসছে। একসময় কত অত্যাচারই না করেছেন শরীরের ওপর। রোদে পুড়েছেন, জলে ভিজেছেন। কিস্যু হয় নি। আর এখন এত যত্নের মধ্যে থেকেও ……

দুরে আলোর একটা ঝলকানি, না ? তার মধ্যে দিয়ে একটা মানুষের অবয়ব ফুটে উঠছে না ? তবে কি ডাক এসে গেল ! ধড়মড় করে উঠে বসলেন রবীন্দ্রনাথ।
ও হরি। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন।

এই কে আছ। একটা খাতা পেন নিয়ে এসো না।

ছুটে এলেন রানী। এই যে গুরুদেব। বলুন কাকে কি চিঠি লিখতে হবে ?

না। একটা গান লেখ ত। ওই মহামানব আসে / দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে ….।

কি সুন্দর গান, গুরুদেব। আর কি মিষ্টি সুরটা !

ভালো হয়েছে না ? ছেলেমানুষের মত খুসি হলেন কবিগুরু। তাহলে এখনো ফুরোই নি ? নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন।

পরের দিন আবার ডাক। একটা ছড়া লেখো না।

বলুন গুরুদেব।

লেখো – গলদা চিংড়ি তিংড়ি মিংড়ি / লম্বা দাঁড়ার করতাল।

বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। জীবনের শেষ পৌষমেলা চলে গেল। এবারই প্রথম পৌষ উৎসবের প্রার্থনায় অংশ নিতে পারলেন না। বড্ড মন খারাপ লাগছিল, বাপ পিতেমোর ঐতিহ্য। এবারই তাতে ফাঁকি পড়ে গেল। কি করে যাবেন। প্রায় রোজই জ্বর আসে। কবিরাজ মশাই বলেছেন ভাল করে দেবেন। সেই ভরসাতেই শান্তিনিকেতন ছাড়ছেন না। কেটে গেল জীবনের শেষ পঁচিশে বৈশাখও।

মাঝে মাঝে বেশ ভাল লাগে। শরীরটা পুরোনো দিনের মতই তরতাজা লাগেই। তারপর যে কে সেই। এরই মধ্যে চলছে কবিতা লেখা, গান লেখা।

কি করে যে পারেন সবাই অবাক হয়। রবীন্দ্রনাথ কি করে বোঝাবেন ! তিনি তো অক্ষরগুলোকে যেন চোখের সামনে দেখতে পান। কি মসৃণ ভাবেই না তারা একে অপরের ঘাড়ে চড়ে বসে কবিতা আর গান হয়ে যায় !
কিন্তু কয়েকদিন পরে তাও যেন বন্ধ হয়ে গেল। আর শান্তিনিকেতনে রাখাটা খুবই ঝুঁকির হয়ে যাবে সবাই এখন বুঝতে পারছে। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশও তাগাদা করতে থাকলেন। অগত্যা কবিও মত দিলেন। ওদিকে বিধান রায়ও ভীষণ রাগারাগি করছেন। দিন ঠিক হল।

ন’ই শ্রাবণ। জুলাই মাসের পঁচিশ তারিখ। শান্তিনিকেতন থেকে শেষ যাত্রা শুরু করলেন কবিগুরু। সেই কবে বাবার হাত ধরে ছোট্ট রবির এখানে আসা। কবি নিশ্চিত – আর কোনদিনই দেখতে পাবেন না এই তাল তমাল গাছ, সেই খোয়াই। কেন জানি না আজ মৃণালিনীর কথাও বড্ড মনে পড়ছে। কি ভালই যে সে বাসত এই শান্তিনিকেতন। ও না থাকলে আজ কি কবির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত। আর কি সাংঘাতিক পরিশ্রমই না সে করত। এককথায় সমস্ত গয়নাগাটি সে বন্ধক রেখে দিয়েছিল।

বড্ড কান্না পাচ্ছে। এমনিতে মনের আবেগ সহজে প্রকাশ করেন না রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু আজ ছেলেমানুষের মত কান্না পাচ্ছে !

বউমা, দেখ তো একটা গগলস পাও কিনা।
কয়েকদিন আগে রবীন্দ্রনাথের চুল দাড়ি ছোট করে কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। গগলস পরে বেশ কিম্ভুত টাইপের দেখতে লাগছে নিজেকে। এত দু:খের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ ফিক করে হেসে নিলেন। ই আই আর এর নিবারণ চন্দ্র ঘোষ তার নিজের সেলুনখানা কবিকে দিয়ে দিয়েছেন। তবে ভীষণ গরম। অনেক দিন আগে, ভিজিয়ানাগ্রামে ট্রেনে যেতে যেতে মনে হয়েছিল ট্রেনটা যেন অবিরত ‘সেনগুপ্ত দাশগুপ্ত- সেনগুপ্ত দাশগুপ্ত’ বলতে বলতে ছুটে চলেছে। সেক্রেটারি অনিলের স্ত্রী রানী চন্দকেও বলেছিলেন সেই কথাটা। আজ আবার মনে পড়ে গেল। সেই নিয়ে প্রথমে একটু হাসিঠাট্টা করলেও ট্রেনজার্নি করতে করতেই কিন্তু কবি আবার বেহুঁশ হয়ে গেলেন। কখন যে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ঢুকলেন তা তিনি টেরও পেলেন না।

পরেরদিনই আবার সজ্ঞানে।
কোথায় আমার অপারেশান হবে ? কবি জানতে চাইলেন।

হসপিটালে অপারেশান হবে না। বাড়িরই একটা বারান্দাকে একদম স্টেরিলাইজ করা হয়েছে। সেখানেই হবে।

যাক বাবা । যেখানে জন্মেছি, সেখানেই মরব। মৃদুস্বরে বললেন রবীন্দ্রনাথ।

কিছু বললেন নাকি, গুরুদেব। জিজ্ঞাসা করলেন ডাক্তার নীলরতন সরকার। তিনি এখন প্রায় রোজই আসেন। প্রথিতযশা ডাক্তারদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি অপারেশানের বিপক্ষে। বারবার বলছেন – বিধান , সাধারণ পেশেন্ট আর রবীন্দ্রনাথের শরীর কিন্তু সমান নয়। অপারেশানের ফল খারাপও হতে পারে। অথচ আর কোন বিকল্প পথও তিনি দেখাতে পারেন নি।

ব্লাড আর ইউরিন টেস্ট প্রায় রোজই হচ্ছে। নিউট্রোফিল কাউন্টটা একটু বেশী। ইউরিনে ই কোলাইও বড্ড।

মঙ্গলবার দিন। ঊনত্রিশে জুলাই। কবি উচ্চারণ করলেন তার শেষ কবিতা।

তোমার সৃষ্টির পথ / রেখেছ আকীর্ণ করি / বিচিত্র ছলনাজালে / হে ছলনাময়ী / শেষ পুরষ্কার নিয়ে যায় সে যে / আপন ভান্ডারে / অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে / সে পায় তোমার হাতে / শান্তির অক্ষয় অধিকার।

লিখেও কবির মন খুঁতখুঁত। একটু যেন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে। কাল ঠিক করে দেব। ভাবলেন কবি।
কিন্তু সে সুযোগ তিনি আর পেলেন না।

সকালে মেজাজটা বেশ ভালো। কারণ শরীরটা শরীফ। কফি আর পেঁপে খেলেন। কবিতাটা নিয়ে বসবেন ভাবছেন। এমন সময় আবির্ভাব ডাক্তার ললিত ব্যানার্জির। নামকরা সার্জেন।

তাহলে আজই ওটিটা করে দিই ?

ওটি আবার কি ? এটি, সেটি, ওটি।

আজ্ঞে। অপারেশানটা। ওটি মানে অপারেশান। আজই করে দি। টুকুস করে হয়ে যাবে !

করে দাও। ( পড়েছ যবনের হাতে ….।)

সকাল থেকে কিছু খান নি ত ?

খেয়েছি ত। পেঁপে আর ….

অ। ঠিক হ্যায়। তাহলে ত অজ্ঞান করা যাবে না। লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে করে দেব। কিচ্ছু টের পাবেন না।

কবি কিন্তু খুবই ব্যথা পেলেন। মুখ বুজে সহ্য করলেন। কোনো অনুযোগ করলেন না। দুতিন দিন সাবধানে থাকতে হবে। কারণ ইনফেকশান যা হবার তা সাধারণত তিন দিনের মধ্যেই হয়।

হল ঠিক উল্টো।
অসুস্থতা বাড়ল তিনদিন পর থেকে। ডাক্তারেরা প্রথমে বেশ খুশী খুশী ছিলেন। কবিগুরু বোধহয় এ যাত্রাতেও করে গেলেন। অসম্ভব ওনার জীবনীশক্তি। এর আগে ভয়ানক ইরিসেপেলাস রোগে টানা পঞ্চাশ ঘন্টা অজ্ঞান ছিলেন। সবাইকে অবাক করে সেবার কিন্তু উঠে বসেছিলেন।

তিনদিন পর থেকে জ্বর আবার ফিরে এল। কবি প্রায়ই বেহুঁশ হয়ে যেতে থাকলেন। যখনই জ্ঞান আসে তখন খালি বলেন – জ্বালা, গায়ে বড্ড জ্বালা। ইউরিনের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকল, কিন্তু পাস্ সেল অনেক বেডে গেল। ডাক্তারেরা বুঝতে পারলেন এবার তারা পরাজিত হবেন। হিক্কা কমাতে না পেরে বিধান রায় অসহায়ভাবে বাড়ির মহিলাদের কাছে বললেন- নাহ্। আমি পারলাম না। এত দেরী করে অপারেশান হল ! তোমরা ত অনেক টোটকা জানো। দ্যাখো না। চেষ্টা করে। যদি কিছু হয় !

বাইশে শ্রাবণ। বুধবার। আগস্ট মাসের ছয় তারিখ।
কবির রেডিয়াল পালস প্রায় অন্তর্হিত।

অমিতা ঠাকুর প্রার্থনা করছেন – শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্। কবির প্রিয় মন্ত্র।
প্রার্থনা করছেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। প্রার্থনা করছেন নির্মলকুমারী মহলানবীশ। তমসো মা জ্যোতির্গময়।
কবির পদতলে রাখা হল চাঁপাফুল। রবীন্দ্রনাথের বড় প্রিয়।
চিনা অধ্যাপক তান ইয়ুন শান নিজস্ব ভাষায় প্রেয়ার করছেন।

বেলা বারোটা বেজে নয় মিনিট।
এতক্ষণ অচেতন কবি যেন সজ্ঞানে ফিরে এলেন। এত ঝরঝরে তিনি বহুদিন বোধ করেন নি। তার শরীরটা যেন লাফিয়ে উঠে ভাসতে লাগল। আরে, একি। তিনি ত সবাইকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। এমনকি তার শায়িত শরীরটাও ! এই কি তবে মৃত্যু ? এতো বড়ই আরামপ্রদ অনুভূতি। একে তাহলে এতদিন মিছেই ভয় পেয়েছিলেন। বাহ্। কি সুন্দর তিনি ভেসে বেড়াচ্ছেন। ঐ তো শিলাইদহের জমি, আকাশ, নদী। আগে কি যেন নাম ছিল ? হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। খোরশেদপুর। ঐ তো। পতিসর। যেখানকার তিনি এখনো জমিদার। এখানকার প্রজারা তার যেন বেশী আপনজন। বড় সরল আর পরিশ্রমী ছিল। বিদায়। সবাই ভাল থেক। আরে, সামনে ওটা মৃণালিনী না ? কি যেন বলছে। আজ আমাদের ছুটি, ছুটি, ছুটি। হ্যাঁ গো, আজ আমাদের সব কাজ থেকে ছুটি। ছুটি তোমার বড় প্রিয়, তাই না ? তাই তো তোমার ডাকনামও ‘ছুটি’। হাত বাড়িয়ে ওটা কে ? বাবামশাই ! পিছনে দাঁডিয়ে মিটমিট করে হাসছেন, কে উনি ? ও। দাদামশাই। প্রিন্স দ্বারকানাথ। দাদামশাই, আপনার সম্বন্ধে একসময় আমার অনেক ভুল ধারণা ছিল। আমি আপনার ব্যবসার কত জরুরী কাগজ পুড়িয়ে ফেলেছিলাম। আমায় মার্জনা করবেন। কবি হাত জোড় করে প্রার্থনা করলেন। দ্বারকানাথ বুকে টেনে নিলেন তার বংশের সবচেয়ে খ্যাতিমান পুরুষটিকে।

জোড়াসাঁকোয় কবির ঘরটিতে উঠেছে কান্নার রোল। কবি চলে গেছেন। কিন্তু, এ কি। কবির হাতদুটো হঠাৎ বুকের কাছে চলে এল কেন ? কবি কি তাহলে সবার কাছে বিদায় চাইলেন। বলে গেলেন –
পেয়েছি ছুটি / বিদায় দেহ ভাই / সবারে আমি প্রণাম করে যাই।

হাতদুটো আবার এলিয়ে পড়ল।
কবি চিরতরে বিদায় নিলেন।

পৃথিবী আরো একটু দীন হল।

.

(সংগৃহীত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.