#শিবের_গাঁ

#পর্ব_১

নদী ভরা কূলে কূলে, খেতে ভরা ধান।

আমি ভাবিতেছি বসে কী গাহিব গান।

       কেতকী জলের ধারে

       ফুটিয়াছে ঝোপে ঝাড়ে,

       নিরাকুল ফুলভারে

                বকুল-বাগান।

কানায় কানায় পূর্ণ আমার পরান।

মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হল নদী। জীবনের প্রথম সূচনা হল জল। আদিম অরণ্যবাসী গুহাবাসী মানুষ তার আদিম বাসা কিন্তু নদীর ধার বা জলাশয়ের ধার দেখেই গড়ত। তারপর আগুন আবিষ্কার করল , পশুপালন শিখল, কৃষিকাজ শিখল। মানুষের মধ্যে গোষ্ঠী বা কৌমের সৃষ্টি হল। তাদের কৃষিকাজের সুবিধা ,পশুপালনের সুবিধার জন্য নদীর তীরে কেন্দ্র করেই বসতি গড়ে উঠল। সৃষ্টি হলে সমাজ ও গ্রামের। সিন্ধু থেকে মিশর , পেরু থেকে কঙ্গো , ব্যাবিলন থেকে চীন বার বার নদী বা বৃহৎ কোনো সরোবর হয়ে উঠেছে মা। ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে নদী সম্পৃক্ত হয়ে যায়। গড়ে ওঠে নদী কেন্দ্রিক সভ্যতা এবং লোকসংস্কৃতি । 

এমনি নদী বিধৌত অঞ্চল হল পশ্চিমবঙ্গের উত্তরভাগ, মানে যাকে আমরা উত্তরবঙ্গ বলে থাকি। ভৌগলিক দিক থেকে দেখতে গেলে উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী গুলি হল তিস্তা,তোর্সা ,গালান্ডি, ডুডুয়া, মেচী, জোড়াই ,সংকোষ ইত্যাদি। এই তিস্তা – তোর্সা নদীর অববাহিকা অঞ্চলেই বিভিন্ন জাতি – জনজাতির সহাবস্থান এবং সমন্বয় সৃষ্টি করেছে এক স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বলয়। 

 তিস্তা – তোর্সা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা লোকসংস্কৃতির বা বলা যায় তিস্তা সভ্যতার প্রধান অধিবাসী হলেন মালপাহাড়ি, কোচ, রাজবংশী , রাভা, খ্যান , গারো,  মুন্ডা, সাঁওতাল, হো , নাগেসিয়া, বোরো বা মেত, টোটো ,ওঁরাও প্রভৃতি। তবে রাজবংশীরাই সংখ্যায় অধিক। এখানকার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। ফলে কৃষিকেন্দ্রীক লোকসংস্কৃতিগত লোকাচার, লৌকিক সংস্কার , কৃষিগত জাদু বিশ্বাস , লোকবিশ্বাস এই অঞ্চলের সনাতনী জীবনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। 

যেহেতু আমি লৌকিক বিষয় গুলি নিয়ে পড়াশোনা এবং লেখালিখি করি তাই আমি এর পূর্বেও বহু লেখায় বলেছি যে বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবী , ব্রত নানা লোকসংস্কার ,বিশ্বাস তথা লোকচারের মধ্যে দিয়ে সৃষ্ট হয়।  উত্তরবঙ্গের ভূ- সংস্কৃতি এবং নৃ- সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবী , বুড়োবুড়ি, মদনকাম, চড়ক, হুদুমদেও , মাশান , মহাকাল, তিস্তাবুড়ি , সন্ন্যাসী, ভাণ্ডানী , বিষহরি, যখাযখী, থানসিরি, সোনারায়, গারামঠাকুর, ডাংধরা প্রভৃতি। আর এই সব লৌকিক দেবদেবীকে কেন্দ্র করে তিস্তা তোর্সা অববাহিকায় গড়ে ওঠা বহু গ্রামের নাম নির্ধারিত হয়েছে। গ্রামনাম স্থানামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

উত্তরবঙ্গে লৌকিক ঐতিহ্যবাহী  বিশেষত প্রধান বা মূল দেবতা হিসাবে দেবাদিদেব মহাদেব শিবের অনুষঙ্গ এসেছে বার বার গ্রামনামে।

স্থাননাম সদা সর্বদা সংস্কৃতির সঙ্গে সদা সম্পৃক্ত। যেমন , কাশ্মীর প্রদেশের নাম দেবী কাশ্মীরার নামে , লক্ষণাবতী শত মরু আক্রমণে লখনৌ হলেও তার ইতিহাস বদলায় না অথবা ব্রহ্মপুরকে বার বার বহরমপুর বললেও তার ইতিহাসকে ভোলাতে পারা যায় না। অতীত সমাজের নানা অনুষঙ্গ স্থাননামে সঙ্গে মিশে থাকে। আর #প্রাচীন_স্থাননাম_কখনোই_নিরর্থক_হয়_না। স্থাননাম এমন একটি বিষয় , যার সঙ্গে সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভূগোল, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, নৃ – তত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, লোক ঐতিহ্য এবং অবশ্যই ভাষাতত্ত্বের মতো বিষয় গভীর শিকড়ের মতো জড়িত থাকে।

স্থান নামকরণে লোকমানসের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। স্থাননাম কোনরূপ একক ভাবনা নয়।বৃহত্তর সনাতনী লোকসমাজ এর স্রষ্টা। ভারতে বিশেষ করে এই বঙ্গ সমাজে স্থাননাম সনাতন ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। তা কখনো বৈদিক, পৌরাণিক কুলীন দেবতা দ্বারা প্রভাবিত অথবা কখনো লৌকিক অকুলীন দেবদেবী দ্বারা প্রভাবিত। সেখানে কখনো কোনো মানুষ তার সুকর্মের নিমিত্ত দেবতা হিসাবে পূজা পেয়ে স্থান নামে চলে আসে , কোথাও দৈবী শক্তি পূজা পেয়ে স্থান নামে জায়গা পায়। কুলীন দেবদেবীর প্রচার সর্বত্র । লৌকিক বা আঞ্চলিক দেবদেবী আবার অঞ্চল ভিত্তিতে পৃথক পৃথক হয়ে থাকে। স্থাননামে আঞ্চলিক দেবদেবী বেশ বৃহৎ একটি অংশ নিয়ে থাকেন। 

প্রাগজ্যোতিষ পুর। খুব খুব প্রাচীন এক রাজ্য। সেই মহাভারতের আগে থেকে ছিল। সেই রাজ্য পরবর্তী কালে কামরূপ নামে হয় সুপরিচিত। 
এই কামরূপ রাজ্যের আবার চার ভাগ ছিল – কামপীঠ, রত্ন পীঠ, সুবর্ন পীঠ , সৌমর পীঠ। কোচবিহার  তার রাজবংশকে পাবার পূর্ব অব্দি এটি কামরূপের অধীনে ছিল।


নরকের পুত্র ভগদত্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগদান করেন কুরু পক্ষে। কে ভালো কে মন্দ তার বিচারে আমরা যাব না। যাক, তো , রাজা ভগদত্ত অর্জুনের হাতে পরাজিত ও নিহত হন। 
ভগদত্ত শরীরে শক্তি কবচ ধারণ করতেন। কথিত আছে এই শক্তি কবচ দেবী গোসানমারী রূপে আজও পূজিতা। যদিও ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ এ এটি চুরি যায় কিন্তু সেই কবচ সিংহাসন ও কবচ কৌট আজও দেবী হিসাবে পূজিতা হন।


পাল বংশের রাজত্বের শেষে এই অঞ্চলে খেন বংশের রাজত্ব শুরু হয়। খেন বংশের পরাক্রম শালী তিন রাজা ছিলেন – নীলধ্বজ , চক্রধ্বজ ও নীলাম্বর । এনারা ১৪৪০ থেকে ১৪৯৮ খ্রি অবধি রাজত্ব করেন। কামতাপুর ছিল রাজধানী। কিন্তু সেই করাল গ্রাস এল…হুসেন শা খেন রাজ্য আক্রমন করে ও প্রবল যুদ্ধ করেও নীলাম্বর পরাজিত ও নিহত হন।
 সেই আক্রমণের পর সমগ্র এলাকায় মাৎসন্যায় সূচিত হয়। ভূঁইয়ারা যেমন স্বাধীন ভাবে প্রভুক্ত হল তেমনি একে অপরকে গ্রাস করল।


এই সময় কোচ জাতি শক্তি শালী হয়ে উঠছিল। তুরকা কোতোয়াল নামে এক দলপতি চিকনা পর্বতের নিচে অষ্ট গ্রামে অধিপতি ছিল। ঐদিকে চিকনা গ্রামে বাস ছিল হরিদাস মন্ডল নামে এক মেচ দলপতি বাস করতেন। তার সঙ্গে বিবাহ হয় এক কোচ ভূঁইয়ার দুই কন্যা জিরা ও হীরার।
জিরার সন্তান হলেন চন্দন ও মদন । হীরার সন্তান হলেন শিষ্য ও বিশ্ব। চারভাই প্রত্যেকেই খুব বলবান ছিলেন কিন্তু বিশ্ব বলের সঙ্গে বুদ্ধিও রাখতেন।
শৈশবের দিন গুলোয় গ্রামের ছেলেদের নানা রকম খেলা হত। একদিন তারা মা কালীর সামনে পুজো ও বলি বলি খেলা করছিল।
লৌকিক ভাবে কথিত আছে , বিশ্ব খেলার চলে কাঁঠাল পাতা দিয়ে বলি দিচ্ছিল তারই কোনো এক খেলার সাথীকে। কিন্তু কোন দৈব ক্রমে সত্যি বলি হলে যায় । 


অল্প সময়ের মধ্যেই চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পরে। তুরকা কোতোয়াল তাদের ধরার জন্য সেনা পাঠালে চার ভাই জঙ্গলে চলে যায়। এর বেশ কিছু দিন পরে চার ভাই শক্তি ও লোক সংগ্রহ করে তুরকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে মদন মারা গেলেও তুরকা পরাজিত ও নিহত হন।
বিশ্ব রাজা না হয়ে অগ্রজ চন্দন কে রাজা করে এবং এই তিন ভাই নিহত তুরকার তিন কন্যা কে বিবাহ করেন। এই ভাবেই একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। এই চন্দনই হলেন কোচ রাজবংশের আদি রাজা ও বিশ্বসিংহ হলেন আদি পুরুষ। 


কথিত আছে এই আদিপুরুষ  প্রথম শ্রেষ্ঠ নৃপতি বিশ্বসিংহ শিবের বরপুত্র ছিলেন। হিমালয় পর্বতমালার নিকটবর্তী অঞ্চল হবার জন্য দৈবিক এবং লৌকিক উভয় রূপেই উত্তরবঙ্গ শিবময় হয়ে রয়েছে এক সুপ্রাচীন কাল থেকে ।তাই এখানে র লৌকিক দেবদেবীরা অধিকাংশই শৈব সম্পর্ক যুক্ত। 

ক্রমশঃ

#দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ তিস্তা – তোর্সা অববাহিকা অঞ্চলের লোকঐতিহ্য : প্রসঙ্গ গ্রাম নামে শিব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.