দেশাত্মবোধ , শব্দটি ভীষণ প্রিয় আমার নিকট। সুদূর অতীতে হয়ত দেশাত্মবোধ শব্দটি ব্যাপক আকারে ছিল না। কিন্তু দেশ ছিল , দেশের প্রতি প্রেম, মমত্ব , ভালোবাসা , দেশকে বন্দনা করা সকলেই ছিল। তবে এসব বোধের রকম ছিল ভিন্ন। কোন্ এক স্মরনাতীত কালে , ভারতের শক্তি উপাসক সম্প্রদায় উপলব্ধি করেছিলেন , অনুভব করেছিলেন এই মৃন্ময়ী ভূমি চিন্ময়ী দেহ সংস্রবে পবিত্র। তন্ত্রের ঋষি দিব্যদৃষ্টিতে দেখে ছিলেন – হিংলাজ হতে কামাখ্যা , কাঞ্চী পর্যন্ত ভূমি ব্রহ্মময়ীর দেহাংশ বক্ষে ধারণ করে কৃতার্থ হয়েছে। অখন্ড ভারতের ভূমিখণ্ডে #অখণ্ড_ব্রহ্মের খণ্ডাংশ ছড়িয়ে আছে। কন্যাকুমারিকা অনন্ত নীলাম্বুধির তরঙ্গচুম্বিত ভূমিখণ্ডে প্রতিক্ষারতা কুমারী দেবীর কথা সেই সুপ্রাচীন মুনি ঋষিদের অন্তরেই প্রথন জাগ্রত হয়েছিল।
আর অখন্ড ভারতে শৈব সম্প্রদায় …. তাঁদের অবদান কম নয় । সেতুবন্ধ হতে চট্টল। এনারা একই সূত্রে গেঁথে ছিলেন। যথায় যথায় দেবী অংশ পতিত হয়েছিল, তথায় তথায় দেবাদিদেব মহাদেব ভৈরব রূপে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। শৈব এবং শাক্ততীর্থ বহুস্থানেই একত্রে অবস্থান করেন। তীর্থ ভ্রমনের উদ্দ্যেশ্যে যাঁরা নানা স্থানে যান তাঁরা অবশ্যই এই বিষয় লক্ষ্য করেছেন। সেখানে উচ্চ নিচ বা উত্তর দক্ষিণ , পূর্ব পশ্চিম বলে কোনো বিষয় নেই।
গয়া ধামে পিন্ডদানের উদ্দেশ্যে গিয়েছেন সেখানেও নিশ্চয় দেখেছেন সম্প্রদায়ের কোথাও পার্থক্য নেই। কোনরূপ প্রাদেশিকতা নেই। বিষ্ণুরপাদপদ্মে হাত দিলে কার হাত কার হাতে ঠেকল সে বিচার কেউ করে না। প্রাচীন কলিঙ্গের যাজপুরে #নাভিগয়া এবং দাক্ষিণাত্যের #পাদগয়া আছে। পিতৃমাতৃ ঋণ পরিশোধকামীকে উক্ত দুই গয়াতেও যেতে হয় । ভারতে বৈষ্ণব তীর্থও অসংখ্য । আজকাল তো লোকে নিতান্তই শখ মেটাতে ভ্রমন করেন। তীর্থকৃত্য সম্পাদনের নিমিত্ত খুব স্বল্প মানুষই তীর্থে গমন করেন। তাই , শিক্ষিত মানুষের নিকট দেব তীর্থ মর্যাদাও কমে গেছে।
প্রাচীনকালে রামায়ন, মহাভারত এবং পুরানাদিতে যে #রাজসূয় যজ্ঞের কথা উল্লেখ আছে বা প্রাচীন ভারতের রাজা মহারাজাগন যে রাজসূয় যজ্ঞ করতেন তা কেবলমাত্র আধিপত্য বিস্তারের উদ্দ্যেশ্যেই ছিল না। একই অনুশাসনে সমগ্র ভারতকে একই সূত্রে গাঁথাই এর গূঢ়তম উদ্দেশ্য ছিল। অতীতে এই উদ্দেশ্যেই #অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো। যজ্ঞাশ্ব যথেচ্ছ ভ্রমণ করত , কোনো রাজ্যের মধ্যে এই অশ্ব উপস্থিত হলে কোনো বীরত্বাভিমানী রাজ্যেশ্বর , রাজকুমার অথবা সেনাক্ষ্য ইচ্ছা করলেই সেই যজ্ঞের অশ্ব ধরতে পারতেন এবং সেই জন্য যুদ্ধ বিগ্রহ ঘটত। তথাপি , কেবলমাত্র জিগীষাই অশ্বমেধের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না।
বর্তমান Z যুগে তো মানুষ পুরাণ পাঠ তুলেই দিয়েছেন। তাঁদের পুরান অপেক্ষা নানা প্রকার মনোরঞ্জনকারী বস্তুতে আগ্রহ অধিক। যাঁরা পুরান, রামায়ণ , মহাভারত , শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ করতেন তাঁদের হয়ত কেউ আর নেই। অর্থাৎ , সেই সব কথক শ্রেণীর বংশধরগণ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অন্য বৃত্তিকে আপন করতে গিয়ে নিজের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ভুলে গেছেন।
কথকগণ যে মহান শিক্ষা গাঁ ঘর, গঞ্জে , হাটে ,মাঠে , বাজারে , কিংবা সদর নগরের মহল্লায় বিলিয়ে বেড়াতেন সে শিক্ষা সমাজ হতে লোপ পেয়েছে। কিন্তু তাঁদের স্থান অধিকার করতে পারে এমন বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবিত হয় নি। একমাত্র এই কথক শ্রেণীর অভাবে দেশ যেরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার তুলনা নেই।
সাধারণ মানুষের বেশ কয়েকজনের ধারণা পুরানাদি হল অলীক কাহিনী। বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক মদতপুষ্ট ঐতিহাসিকগণ পাথুরে প্রমাণের সন্ধানে পুরান মাত্রই অবজ্ঞা করেছেন। ইংরেজি নবীশগণের দুই চোখের বিষ হল পুরানাদি। কিন্তু পুরান না পড়লে ভারতকে জানা যায় না , চেনা যায় না , বোঝা যায় না।
“ধর্মে চ অর্থে চ কামে চ মোক্ষে চ ভরতর্ষভ।
যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন তৎ ক্বচিৎ।।”
ভারতের সমাজতত্ত্ব , ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির অর্থ বুঝতে হলে বেদ , পুরান , রামায়ণ ,মহাভারত অবশ্যই অধ্যয়ন করতে হবে। এখন ধুয়া উঠেছে ভারতীয় সুপ্রাচীন যতকিছু বেদ শ্রুতি, পুরান সকলই অর্বাচীন কালে রচিত এবং পুরাণে প্রক্ষেপ ঘটেছে প্রচুর। কিন্তু এটা তাঁদের জানা উচিৎ যে , বেদ , বেদান্ত , উপনিষদ , বেদান্ত জ্যোতিষ , আয়ুর্বেদ, নানা পুরান একে অপরের পরিপূরক । এক পুরাণে যা বর্ণিত হয়েছে অপর পুরাণে তারই অনুশীলিত সুসার্থ ভাষ্য আছে। এক্ষেত্রে কাল বিচারের কোনো রূপ প্রয়োজন নেই। এখানে এটাই অবলোকন করতে হবে যে , এক পুরাণের রহস্য অন্য পুরাণে কি উৎকর্ষের সঙ্গে উদঘাটিত হয়েছে। সনাতনী সমাজের স্তরবিন্যাস ও জাতির মানসিক প্রকর্ষের পর্যালোচনায় এর উপযোগিতা শিক্ষিত সমাজের নিকট অবহেলিত হয়ে থেকে গেল। পুরাণের মধ্যে বিরোধ অপেক্ষা সমন্বয়ের , বৈচিত্র্যের মধ্যে মহান ঐক্যের চিত্রই অধিকতর বিকাশলাভ করেছে।
অন্যকে দোষ দিয়ে আপনার দোষ ঢাকার কোনো চেষ্টা করছি না। আমাদের মধ্যে যেরূপ দুর্বলতা আছে অন্য জাতির মধ্যে তা আরো অধিক আছে । ক্যাথলিক – প্রোটেস্ট্যান্ট হোক বা বিবিধ রকমের ভাগ সম্পন্ন মরু গোষ্ঠীই হোক , বিবাদ দ্বন্দ্ব অনবরত বেঁধে আছে। কিন্তু ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য অধিকাংশই পুরাণ দ্বন্দ্ব অপেক্ষা ঐক্যের পথেই অগ্রসর হয়েছে। দাক্ষিণাত্যে শৈব- বৈষ্ণবে দ্বন্দ্ব ছিল, বঙ্গে শাক্ত – বৈষ্ণব দ্বন্দ্ব ছিল একথা অস্বীকার করছি না। তাই বলে পুরানকে দোষ দিয়ে ঢাকী সুদ্ধ জলে বিসর্জন দিয়ে কি লাভ হবে ?
স্বদেশী আন্দোলনের সময় বন্দেমাতরমের সঙ্গে একটি শ্লোক বিল্পবীদের মধ্যে ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল। –
যস্য প্রান্তে সমুদ্রাঃ সুবিষমচপলা শৈলমালা বিশালা
রাজন্তে যত্র নদ্যা সুবিমলসলিলা শ্যামলা শস্যমালা।
সুবিশাল এবং সুবিচিত্র দেশ এই ভারতবর্ষ। সাগরাম্বরা, নদীমেখলা , কাননকুন্তলা – পর্বত, প্রান্তরব্যবধান বহুল এই সুবিশাল জম্বুদ্বীপ অর্থাৎ ভারতবর্ষকে একতার সূত্রে গেঁথেছিল ভারতের তীর্থ ক্ষেত্র।
নব নব যত ব্যাখ্যা রচিত হয় সেসবে ভারতের তীর্থ মাহাত্ম্যের যুগোপযোগী ভাষ্য আর রচিত হয় না। কোনো ব্রতধারী আর মনে একাত্মতাবোধ জাগ্রত করতে বদ্ধপরিকর হল না। সেকুলারদের নিকট তীর্থ সংস্কারে অর্থ ব্যয় বোধয় অমার্জনীয় অপরাধ। ভীষণই দুঃখ অনুভূত হয় যে মানুষ আপন গৃহের লক্ষ্মীর রত্নভান্ডারকে অবজ্ঞা করে মরীচিকার দিকে ছুটছে। অথচ দেশের ঋষি কবিগণ সেই কোন প্রাচীন কালে উদাত্ত কন্ঠে বলে গেছেন –
“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী”
সেই দেশের মানুষকে আজ দেশাত্মবোধ বোঝাতে হয়।
অপহৃতা জনক নন্দিনী দেবী সীতাকে উদ্ধারের নিমিত্ত শ্ৰীরাম চন্দ্রের পরিচয় হয় সুগ্রীবের সাথে। হনুমানের সহায়তায় সীতার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে । সাগরে সেতু বন্ধন হল। শ্রীরাম বানর সেনা নিয়ে লঙ্কায় উপস্থিত হলেন। তুমুল যুদ্ধের পর রাবণ ধ্বংস হল। শ্ৰী রাম লঙ্কার সিংহাসনে বিভীষণের অভিষেকের উদ্যোগ করলেন। বিভীষণ সনির্বন্ধ রামকে অনুরোধ করলেন রাজা হবার জন্য। শ্ৰী রাম তখন বিভীষণের সেই বক্তব্যের প্রতি উত্তরে বলেছিলেন –
ইয়ং স্বর্ণপুরী লঙ্কা সখে মহ্যং ন রোচতে।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।।
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ গৌড়বঙ্গ – সংস্কৃতি : হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়