#দ্বিতীয়_ভাগ
স্বাধীনতার আগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেমন সুইডেন, জার্মানি, ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া থেকে আবার এশিয়ার জাপান থেকেও দেশলাই আমদানি করা হত, যাতে ফরমায়েশ মতো দেবদেবীর মূর্তি থাকত। তখন কাঠের বাক্সের ওপরে এক দিকে ছবি সাঁটা থাকত। সে সময় কলকাতায় বিক্রি হওয়া সুইডেনে তৈরি দেশলাই বাক্সের প্যাকেট লেবেলে চমৎকার মা কালীর ছবি পাওয়া গেছে।
একই ভাবে জাপানের বাক্সেও তা দেখা গেছে, যেখানে কোনও কোম্পানির নাম নেই। মনে করা হয়, ভারতের প্রথম দেশলাই আমদানিকারক সংস্থা হল কলকাতার ‘এ এম এসাভি’, যারা পরবর্তীতে মানিকতলায় এসাভি ম্যাচ ফ্যাক্টরি চালু করে। সুইডেনে ছাপা ছবির মতো একই ছবি ছোট বড় সাইজে ওই কোম্পানির বাক্সে পেয়েছি। তফাত হল, এখানে ‘স্বদেশি দেয়াশলাই’ লেখা ছিল। ক্যালকাটা ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজের বাক্সে অন্য ছবি পাওয়া গেছে।
‘তারা মা’ লেখা দুটি বিরল মার্কা পাওয়া গেছে ‘কে এম ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’র বাক্সে। অন্যান্য লেবেলেও দেবী বা হিন্দু দেবী হিসেবে মা কালী আছেন। সে সময় কালীপুজোর সময় চলতি কথায় ‘লাল-নীল দেশলাই’ খুব বিক্রি হত, যাকে ‘বেঙ্গল ম্যাচেস’ বলা হয়। অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য কালী মার্কা বেঙ্গল ম্যাচে লেখা আছে যে সেটি ব্রিটিশ এম্পায়ারে তৈরি এবং ‘বেটার দ্যান জার্মান গুডস’। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এক সময় জার্মানিতে তৈরি দেশলাই সহ প্রচুর সামগ্রী কলকাতায় সস্তায় বিক্রি হত, এখনকার চিনে জিনিসের মতো। দেশলাই বাক্সে সেই ইতিহাস ধরা পড়েছে।
শিবকালীর শিবকে নিয়েও অনেক দেশলাই বেরিয়েছে। বহু পুরনো মার্কায় দেখা যায়, বাংলাতে ‘জাপানে তৈয়ারি’ ‘মহাদেব দেশলাই’ লেখা আছে কলকাতার ‘এফ পি নাল্লাদারো কোম্পানি’র জন্য। আবার আর একটি জাপানি বাক্সে শিবের ছবি পাওয়া যায়, যেটি বম্বের টাটা অ্যান্ড সন্সের জন্য তৈরি হয়েছিল।
উক্ত সব কলকাতার বিদেশী ম্যাচ আমদানী কোম্পানি গুলির মধ্যে আরো কিছু কোম্পানি উল্লেখযোগ্য ছিল , যেমন – জে এইচ মিত্রা এন্ড কোম্পানি – সুইডেন , এ জানউইৎজার – জাপান , এ এম এসাভয় ম্যাচেস – সুইডেন , এন্ড্রু ইউল এন্ড কোং – জাপান, বি এম ব্যানার্জি – জাপান, ক্যালকাটা জাপান ট্রেডিং কোং – জাপান, গুডউইন ম্যাচেস – সুইডেন, গ্রূণ এন্ড কোম্পানি – জাপান, এম ই প্যাটেল – জাপান, অস্ট্রিয়া, স্ট্রুদারস এন্ড কোং লি – ইংল্যান্ড , অস্ট্রিয়া, ওলদামেয়ের এন্ড হেডেনফেল্ড – কলকাতা ইত্যাদি।
২য় বিশ্বযুদ্ধের আগেপরে কলকাতায় দেশলাই বাক্সের খোল জমানোর হবি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায়! লোকমুখে এর নাম ছিল “মার্কা জমানো”। বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে এই হবির ভালোমত কদর ছিল সারা ভারতেই। তবে ডাকটিকিট সংগ্রহের শখের মতোই এরপরে পিকচার পোস্টকার্ড, সিমকার্ড, ক্রেডিট কার্ড, এমনকি ফোনের মডেল ইত্যাদি কতো কিছু জমানোর শখ এসে পরে ওই হবির যেন প্রায় তেরটা বাজিয়ে ছেড়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে ধূমপান বিরোধিতা, বাক্সের বদলে কাগজের প্যাক চালু হওয়াও তার পেছনে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
একটা সময় দেশলাই বাক্সের উপরের নানারকম বিচিত্র ছবি আর রকমারি ব্র্যান্ডিং এর চমক দেখে আশ্চর্যান্বিত হতে হত। কোনোটার উপরে ছিল সেকালের বলিউডি হাতে আঁকা পোস্টারের ধাঁচে হিরোর ভঙ্গিমা, কোনোটায় আবার তাসের পাত্তি জোকার, আবার আরেকটায় হয়তো উদীয়মান সূর্য, জয়মাতাদি, মোরগ, মশাল বা নিশান মার্কা।
দেশলাইয়ের ছবিতে ইতিহাস ও সমাজ দিব্যি বোঝা যায়। আন্দাজ করা যায়, তখনকার ভাবনা, প্রবণতাগুলো। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, তার সংগ্রামের প্রতি সমর্থন, আর স্বাধীনতা পেয়ে যাওয়ার পর উল্লাস— ভারতের বিভিন্ন দেশলাইয়ের ছবিতে ফুটে ওঠে। কারা তখন গোটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক-নায়িকা, তাও পরিষ্কার হয়ে যায়।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কলকাতা ও বাংলার দেশলাই : গোপাল বিশ্বাস