সাহেবান বাগিচা।~~~~~~~
ভাবা যায় এক সময় কলকাতার ষাট লক্ষ বিঘা জমির মালিকানা ছিল রাণী রাসমণির। থাকলে কি বা হত………রাণির বাড়ির বউ শিউলি ক্ষতিপূরণের দাবিতে আদালতে আদালতে ঘুরেছেন। রানি রাসমণির বড় মেয়ের নাতবৌ শ্যামলী দাস ও অমিতাভ দাসকে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সেবায়েত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট 2004 সালে। রাণির বংশধর হওয়া সত্বেও তাঁদের সেবায়েত করা হচ্ছিল না। এই নাতবৌ এখন সাত আলমারি ভর্তি রাণির সম্পত্তির আসল দলিল নিয়ে, পুজোর ঘরে জেরক্স মেসিন বসিয়ে 60 লক্ষ বিঘা সম্পত্তির মোকদ্দমা লড়ে চলেছেন।
রাজতন্ত্রের অবসান হয়েছে। রাজত্বও নেই। কিন্তু সেই ভারতবর্ষে আজও রাজবংশেরই কর্তত্ব অক্ষুন্ন। সর্বত্রই রাজ পরিবার ও জমিদারির সম্পত্তি খাস হয়েছে, কিন্তু ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়েছে সমানে। একমাত্র ব্যতিক্রম রাণি রাসমণির ক্ষেত্রে। কারণ রাণির সম্পত্তি জাল দলিলের কল্যাণে পরহস্তগত হয়েছে, কেউ সংরক্ষণ করার কথা ভাবেইনি। পলাশী যুদ্ধের কথা, সেই পরাজয় ও বিশ্বাসঘাতকতার কথা বাঙালির প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে জড়িযে আছে। অথচ ইংরেজদের বিরুদ্ধে রাণির জেতা লড়াই বাঙালি মনে রাখেনি। কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোর কথা উঠলেই এসে পরে ১৩, নং রানি রাসমনি রোডের রাসমনি কুঠির পুজোর কথা। দীর্ঘ ২৫০ বছরেরও বেশী পথ অতিক্রম করে এই পুজো আজও বাঙালির ঐতিহ্যের পুজো। ইতিহাস বলে রানির শ্বশুরমশাই প্রীতিরাম দাস এই পুজোর প্রবর্তন করেন। কিন্তু গঙ্গায় কলাবউকে স্নান করানোর অধিকার আদায়ে, দক্ষিনেশ্বর মন্দির এলাকায় ইংরাজ সৈন্যর কুচকাওয়াজ বন্ধ করার এবং বাংলার জেলেদের মাছ ধরার অধিকার অব্যাহত রাখার জন্য গঙ্গায় আড়াআড়ি লোহার শিকল পরিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা বাঙালি মনে রাখেনি।
রাণী রাসমণি তাঁর বিবিধ জনহিতৈষী কাজের জন্য প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। তিনি তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরী পর্যন্ত একটি সড়ক পথ নির্মাণ করেন। কলকাতার অধিবাসীদের গঙ্গাস্নানের সুবিধার জন্য তিনি কলকাতার বিখ্যাত বাবুঘাট, আহিরীটোলা ঘাট ও নিমতলা ঘাট নির্মাণ করেন। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি (অধুনা ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার) ও হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠাকালে তিনি প্রভূত অর্থ সাহায্য করেছিলেন।
১৭৯৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কোনা গ্রামে এক দরিদ্র কৃষিজীবী মাহিষ্য পরিবারে রাণী রাসমণির জন্ম হয়। তিনি ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী। মাত্র এগারো বছর বয়সে কলকাতার জানবাজারের ধনী জমিদার বাবু রাজচন্দ্র দাসের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি স্বহস্তে তাঁর জমিদারির ভার তুলে নেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তা পরিচালনা করতে থাকেন। ব্যক্তিগত জীবনে রাণী রাসমণি এক সাধারণ ধার্মিক বাঙালি হিন্দু বিধবার মতোই সরল জীবনযাপন করতেন। ১৮৬১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর জীবনাবসান হয়।
১৮৪৭ সালে ধনী বিধবা জমিদারনি রানি রাসমণি দেবী অন্নপূর্ণাকে পূজার মানসে কাশীতে তীর্থযাত্রার আয়োজন করেন। ২৪টি নৌকায় আত্মীয়স্বজন, দাসদাসী ও রসদ নিয়ে তিনি রওয়ানা হন। কিংবদন্তি অনুসারে যাত্রার পূর্বরাত্রে রানি দেবী কালীর স্বপ্নদর্শন পান। দেবী তাঁকে বলেন, ” কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গঙ্গাতীরেই একটি নয়নাভিরাম মন্দিরে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা কর। সেই মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েই আমি পূজা গ্রহণ করব। “
এই স্বপ্নের পর রানি অবিলম্বে গঙ্গাতীরে জমি ক্রয় করেন এবং মন্দির নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৮৪৭ সালে এই বিরাট মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয়; শেষ হয় ১৮৫৫ সালে।
মন্দিরের ২০ একরের প্লটটি জন হেস্টি নামে এক ইংরেজের কাছ থেকে কেনা হয়। লোকমুখে জায়গাটি পরিচিত ছিল সাহেবান বাগিচা নামে। এর একটি অংশ ছিল কচ্ছপাকার মুসলমান গোরস্থান। তাই তন্ত্রমতে স্থানটি শক্তি উপাসনার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। আটবছরে নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই মন্দির নির্মিত হয়। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে স্নানযাত্রার দিন মহাসমারোহে মন্দিরে মূর্তিপ্রতিষ্ঠা করা হয়। পূর্বে মন্দিরের আরাধ্যাকে মাতা ভবতারিণী কালিকা নামে অভিহিত করা হয়েছিল। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রধান পুরোহিত পদে ছিলেন , তাঁর ছোটোভাই গদাধর বা গদাই (পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ পরমহংস) তাঁর সহযোগী হন। পরে তাঁর ভাগনে হৃদয়ও তাঁকে সহায়তা করতে থাকেন।
সূত্র: রাসমণি উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে,আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে…..
প্রণাম নিও রানীমা।
✍️মনি লাহিড়ী