#একটি_স্বদেশী_কালির_ইতিহাস

আমি নব্বইয়ের দশকের কচিকাঁচা। মানে আমার শৈশব কেটেছিল ওই নব্বইয়ের দশকে। বড়িশা গার্লস প্রাইমারি ও পরে হাইতে আমার বিদ্যা শিক্ষার প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত হয়। তো স্কুলের তৃতীয় শ্রেণী থেকে ই আমাদের পেন দিয়ে লেখা অভ্যাস করানো হত। পেন মানে এখন পাওয়া নানা বল পেন বা জেল পেন নয়। পেন অর্থাৎ কালির পেন বা ফাউন্টেন পেন বা ঝর্ণা কলমেই লিখতে হত। আমাদের বাংলার শিক্ষিকা বলতেন ,ঝর্ণা কলমে লিখলে হাতের লেখা সুন্দর হয়। তারপর প্রায় ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত শীত গ্রীষ্ম বর্ষা আমার লেখার জন্য ছিল ঝর্ণা কলম ই ভরসা। কাকা কলেজস্ট্রিট থেকে সুন্দর সুন্দর ঝর্ণা কলম কিনে দিতেন আর কিনে দিতেন রয়াল ব্লু ইনক।  সঙ্গে পেতাম পুঁটিরামের ডাল লুচি আর দই  এবং ঝর্ণা কলম , কালি সংক্রান্ত নানা ইতিহাসের হদিস।


প্রতিবারই কাকা পেন ও কালি কিনে দিতে গিয়ে খুব নস্টালজিক হয়ে পড়তেন। সেই ব্যাপারটা আমার বাবার মধ্যেও ছিল। মাঝেই মাঝেই এসবের ফাঁকে স্মৃতি রোমন্থন করতেন। কেবল বাবা কাকা কেন , ইতিহাস সাক্ষী একসময় পক্ষীর পালক , খাগের কলম , তাল পাতা, গাছের বাকল ইত্যাদি ছিল লেখার মাধ্যম। মা সরস্বতীর সামনে কালো স্লেট পাথরে খড়ি দিয়ে আঁক কেটে লেখাপড়ার সূচনা হত। তারপর বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে আসত সাদা খাতা ,তাতে সমান মাপে ভাঁজ করে শুরু হতে লেখা। খাগের কলম দোয়াতের কালিতে ডুবিয়ে নিয়ে খাতায় আঁক পড়ত : অ , আ , ই , ঈ …

বাবা বলতেন , পরীক্ষার সময় ডেস্কের পাশে ছোট দোয়াত আর কলম থাকত। পরীক্ষা শুরু হলে তাতে কালির ট্যাবলেট ও জল দেওয়া হত। তাতে কলম ডুবিয়ে চলত পরীক্ষার উত্তর দেবার পালা। 
সেই পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের একটা সময় বাড়িতে বানানো ভুসো কালির ব্যবহার হত। সেই যুগ ও শেষ হল। হ্যান্ডেল বা ইঙ্ক ডিপার কলমেরও প্রায় শেষের দিন আগত ছিল। তার জায়গা দখল নিল ফাউন্টেন পেন। 

ঝর্ণা কলম বা ফাউন্টেন পেন এমন এক বিশেষ ধরনের কলম যাতে তরল কালি বিশেষ প্রকোষ্ঠে সঞ্চিত থাকে। বিশেষ প্রকোষ্ঠটির সাথে একটি সরু পথ দিয়ে কলমের নিবটি যুক্ত থাকে এবং মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে ওই পথ ধরে আসা কালি দিয়ে লেখা সম্ভব হয়। বিশেষ প্রকোষ্ঠটিতে সিরিঞ্জের মাধ্যমে বাইরে থেকে কালি ভরা যায়। এছাড়া কলমের অভ্যন্তরীণ চোষণ কৌশলের মাধ্যমে বোতল থেকে কালি চুষে নেওয়া যায়। এছাড়া কালি ভর্তি প্রকোষ্ঠ আলাদাভাবে বিক্রি করা হয়। ঝর্ণা কলম দিয়ে লিখতে তেমন কোন চাপ প্রয়োগ করা লাগে না, খুব সহজে আলতো চাপে এতে লেখা সম্ভব হয়।

যদিও ১৮৮৩ সালে ওয়াটারম্যান আবিস্কার করেন ফাউন্টেন পেন। তবুও  ঐতিহাসিক মতে বিশ্বের প্রথম ঝর্ণা কলম আবিষ্কৃত হয় ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে, মিশরে। মিশরের সম্রাট মা’দ আল-মুয়িজ এমন একটি কলম এর কথা চিন্তা করলেন যা হাত এবং কাপড় কালিতে নষ্ট করবে না। আবিষ্কৃত এই কলমে আধুনিক কলমের মত কালি জমা থাকতো এবং মাধ্যাকর্ষণ বলের সাহায্যে সূক্ষ্ম নল চুয়ে কালি বের হতো। ফাউন্টেন পেনের বাংলা তরজমা ঝর্ণা কলম নামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছিলেন।

মার্কিন ঐতিহাসিক হেস্টর ডর্সি রিচার্ডসন (১৮৬২-১৯৩৩) এর বক্তব্য থেকে জানা যায় , ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লসের শাসনকালের (১৬৪৯-১৬৮৫) একটি তথ্যপুটে উল্লেখ পাওয়া যায় ‘১৫ শিলিং দামের তিনটি ফাউন্টেন পেন’-এর। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার থেকেই ফাউন্টেন পেন কথাটা ভাল রকম চালু হয়।

দ্বিতীয় চার্লসের শাসনকালে ফাউন্টেন পেন শব্দটার প্রথম উল্লেখ তথ্যে এলেও বিশ্রুত ডায়েরিলেখক স্যামুয়েল পেপিজ কিন্তু ১৬৬৩-তেও লেখার যন্ত্রটির উল্লেখ করেছিলেন ‘মসি বহন করার’ ধাতব কলম বলে।অর্থাৎ ব্যবহারে আসার পরও বহু দিন অবধি ঝর্ণা কলমকে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল ফাউন্টেন পেন নামে চলার জন্য।

১৮৮৩ সালে আমেরিকান লুইস ওয়াটারম্যান ফাউন্টেন পেন আবিষ্কার করার পর অন্যান্য দেশেও ফাউন্টেন পেন তৈরি শুরু হয়ে যায়। ফণীন্দ্রনাথ গুপ্ত  হলেন অন্যতম দেশভক্ত ব্যবসায়ী। তাঁকে ভারতের শিল্পস্থাপনার অধিনায়কও বলা হয়।তিনি ভারতে দেশি প্রযুক্তিতে ঝর্ণা কলম তৈরির কারখানার পথপ্রদর্শক। তিনিই প্রথম দেশি প্রযুক্তিতে ঝর্ণা কলম তৈরির কারখানা করে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে এটি এফ এন কোম্পানি এন্ড পেন্সিল ফ্যাক্টরি নামে বিখ্যাত হয়।

যাক , তো যখন ফাউন্টেন পেন বাজার দখল করল তখন তার সঙ্গে প্রয়োজন হয়ে পড়ল উন্নততর কালির । বিজ্ঞান সম্মত কালি নিয়ে বাজারে সেই সময় হাজির ছিল নানান বিদেশি কালির কোম্পানি। 

নব্বইয়ের দশকে আমি Camlin এর কালি ব্যবহার করেছি। সেই সময় বাবা কাকা বা মা পিসিরা নস্টালজিক হয়ে পড়তেন #সুলেখা কালির নাম উচ্চারণ করে। যে সময় বিদেশি কালি বাজারে রমরমা ফেলেছিল সেই সময় স্বদেশি কালির একমাত্র নির্ভর যোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল সুলেখা কালি। বাবা, কাকা, মা , পিসি এনাদের নিকট শুনেছি বাড়ির বড় কেউ গুঁড়ো বা বড়ি কালি জলে গুলে কালি বানিয়ে খালি দোয়াতে ভরে দিতেন। স্কুলেও একই নিয়ম ছিল। সেও ছিল সুলেখার কালি।পরে বাজারে এল সুন্দর সুন্দর  কাগজের কৌটয় ভরা হরেক রকম সুলেখা কালি। কালি ও ঝর্ণা কলমের মধ্যে একসময় বোধয় ওই সুলেখা কালিই প্রেম টিকিয়ে রেখেছিল। 

বাঙ্গালীর ব্যবসার ইতিহাসকে স্বর্ণাক্ষরে খচিত করে গেছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা। সুলেখা কালি তৈরির পূর্বে ঠাকুর বাড়ির তৈরি কালির সঙ্গে আরও কয়েকজনের কালির নাম উল্লেখ্য। একটু বলি সেসব কথা :

সালটা ১৮৮৩। দেশজ পদ্ধতিতে রাসায়নিক কালি তৈরি করলেন কিশোরীমোহন বাক্‌চি ।জার্মানিতে এ ধরনের কালি তার মাত্র চার বছর আগে বেরিয়েছে। শুধু তাই নয়, বালিকা স্ত্রীকে সহকারী করে নিজের হাতে তৈরি সেই ‘সরস্বতী’ মার্কা কালি বোতলে ভরে লেবেল সেঁটে মাথায় করে দোকানে দোকানে বিক্রি করতে লাগলেন তিনি। দাঁড়িয়ে গেল ‘দর্জিপাড়া কেমিক্যাল ওয়ার্কস’, প্রশংসা পেল দেশ জুড়ে। আস্তে আস্তে চৌষট্টি রকমের কালি থেকে রাবারস্ট্যাম্প, সুগন্ধি তেল, প্রসাধনী, ফলের সিরাপ, আঠা, নানা ওষুধ, পরে প্রকাশনা— এক বাঙ্গালী শিল্পোদ্যোগীর প্রতিভা তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যকে কোথায় তুলেছি তা নিশ্চয় আর বলে দিতে হবে না।

রজনীকান্ত মৈত্র ও যদুবালা মৈত্রের কনিষ্ঠ সন্তান লক্ষ্মীকান্ত অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ, প্রেসিডেন্সি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও আইন পাশ করে তিনি সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শন অধ্যয়ন আরম্ভ করেন এবং তারই জন্য ‘পণ্ডিত’ উপাধিতে ভূষিত হন। অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে তিনি শান্তিপুরে ‘শিল্প আশ্রম’ গড়ে তোলেন। সেখানে দাঁতের মাজন, লেখার কালি, জুতোর কালি, কবিরাজি মাথার তেল প্রভৃতি তৈরি হত।

স্বাধীনতা আন্দোলন যখন তুঙ্গে সেই সময় শিক্ষিত ও কর্মঠ ভারতবাসী দের ডাক দিয়ে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ার আহ্বান জানানো হয় যাতে ভারতের কার্যক্ষম যুবকেরা কাজ পান এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের স্তম্ভ হয়ে উঠতে পারেন। লিখন সামগ্রী উৎপাদন শিল্পকেই অগ্রাধীকার দেওয়া হয়েছিল।

যথাযথ কারণেই বাঙ্গালী হিন্দুর সফল বাণিজ্যিক উদ্যোগ নিয়ে আলোচনায় কালির ব্যবসায় যে প্রতিষ্ঠানটির নাম সগর্বে উল্লেখ করা উচিত সেটি হল #সুলেখা_ওয়ার্কস_লিমিটেড। যার বীজ প্রোথিত হয় স্বদেশি আন্দোলনের সময়। স্বদেশি আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে #শ্ৰী_অম্বিকাচরণ_মৈত্র মহাশয়ের পুত্ররা যখন বিদেশি কালির উপযুক্ত বিকল্প প্রস্তুত এবং বিপণনের জন্য উদ্যোগ নিলেন তখন তিনি তাঁর স্বর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। 

শ্ৰী অম্বিকাচরণের দুই পুত্রের নাম ছিল : শ্ৰী ননীগোপাল মৈত্র এবং শ্ৰী শঙ্করাচার্য মৈত্র। দুই ভাই, তাঁদের মা, স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজশাহী মহিলা সমিতির সভানেত্রী সত্যবতী দেবীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ছোট্ট এক কারখানার প্রস্তাব পরিবারের সকলেই সমর্থন করলেন। বেঙ্গল কেমিক্যালসের চীফ কেমিস্ট সতীশ চন্দ্র , শ্রী শংকরাচার্য মৈত্র ও ননীগোপাল মৈত্রকে নির্দেশ দিলেন ঝর্ণা কলমের কালি তৈরীর কারখানা গড়ে তুলতে, যা আমদানী করা বিদেশী কালির সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। শ্ৰী সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত তাঁর ‘কৃষ্ণধারা’ কালি তৈরীর ফর্মুলা ননী গোপাল মৈত্রের হাতে তুলে দিলেন। প্রসঙ্গত জেলে বসেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেছিলেন ননীগোপাল। সেই সময় ব্রিটিশ পণ্য বয়কট আন্দোলন চলছিল। পরীক্ষার খাতায় বিলিতি কালির বদলে পেনসিলে ছবি আঁকায় স্নাতকোত্তরে প্রথম হতে পারেননি ননীগোপাল। শ্ৰী অম্বিকা চরণের দ্বিতীয়পুত্র নিরলস কর্মী শংকরাচার্য এবং বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র ননীগোপাল স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তেরবানানো রেসিপি দিয়েই  সূচনা করলেন সুলেখা কালির ব্যবসা। সুলেখা নামটির প্রণেতা ছিলেন স্বয়ং সতীশবাবু। ‘সুলেখা’, সুন্দর লেখা। প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক নাম ছিল #মৈত্র_ব্রাদার্স_প্রাইভেট_লিমিটেড। শুরু ব্যারাকপুরের ছোট্ট কারখানায় কুটির শিল্পের ধাঁচে।


প্রথমে ব্যাপারটা সহজ ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা কালি তৈরীর, যেটা  বিশ্ববিখ্যাত বিদেশী কালি কোম্পানী গুলোর সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। মূলধন খুবই কম। এমন কি প্রাথমিক যন্ত্রপাতিও কেনা যাচ্ছে না। যাতে কোথাও কোনও ঠোক্কর না খেতে হয় তাই পরিবারের সকলে কোমড় বেঁধে নামলেন। বাড়ির মেয়েরা কালি তৈরী করলেন। পুরুষরা সেইগুলি বিক্রীতে মন দিলেন।  সকাল-সন্ধ্যায় ব্যাগে করে ‘প্রফেসার মৈত্রের কালি’ হাঁক দিয়ে তা ফিরি করতেন।


ইতিমধ্যে ননীগোপাল মৈত্র রাজশাহী কলেজের অধ্যাপকের কর্ম হারিয়ে কলকাতায় চলে এলেন। এখানে এসে তিনি ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করলেন।১৯৩৬ সালে কলকাতার মহাত্মা গান্ধী রোডে একটা শোরুম খোলা হলো। তিনি এই কাজে তাঁর সমস্ত আয় কোম্পানীর প্রসারে নিয়োগ করলেন। শংকরাচার্য বাবুও ১৯৩৮ সালে কলকাতায় চলে এলেন । দুজনে কলকাতার বৌবাজার এলাকায় একটা বড় কারখানা খুললেন।


প্রাক স্বাধীনতা  যুগে সুলেখা কালি একটা আন্দোলনের মত ছিল। তাঁদের সাফল্যের কথা শুনে অনেক বাঙ্গালী যুবক উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন। সুলেখা কালির চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। অনেকে আবার এই নতুন উদ্যোগের সাহায্যে এগিয়ে এলেন।


ব্যবসা বৃদ্ধি হওয়ায় ১৯৩৯ সালে এই কোম্পানী কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকায় স্থানান্তরিত করা হল। 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টা ছিল সুলেখার উন্নতির সময়।তারই ফলশ্রুতি যাদবপুরের আড়াই বিঘে এবং সোদপুরের ষোলো বিঘে জমিতে কারখানার সম্প্রসারণ আর সুলেখার প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি  হয়ে ওঠা। ১৯৪৬ সালে এটা যাদবপুরে পাকাপাকি ভাবে সুলেখার নতুন জীবন শুরু হল। ঐ বছরই সুলেখা কোম্পানী ১০০০ শেয়ার হোল্ডার  কোম্পানীতে পরিণত হল।১৯৬০ সালে সুলেখা কালির আরও দুটো শাখা খোলা হল। তারই একটা হল পশ্চিমবঙ্গের সোদপুরে,  অন্যটা উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে। 


স্বাধীন ভারতে সুলেখার ব্যবসা এশিয়ার অন্যান্য দেশ এমনকি ইংল্যান্ড ,অস্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে। লেখার কালির পাশাপাশি অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের কালি তৈরি এবং বিপণন সূচিত হয়। যুক্ত হয় গঁদ, আঠা, গালা মায় ফিনাইলও। ননীগোপাল বাবুর পুত্র কল্যাণ মৈত্র ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক। ব্যবসায় তাঁর যোগদানে সুলেখা হয়ে উঠেছিল একটি সুপরিকল্পিত এবং সুপরিচালিত প্রতিষ্ঠান। আধুনিক যন্ত্রপাতি , সুগঠিত কারখানা , সংস্থার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সহায়ক সংস্থা ও পরিবহন ব্যবস্থা।, মিত্র সুলভ কর্মচারী ইউনিয়ন , সমবায় এবং সর্বান্তে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড।  সুলেখায় একটা সময় পর্যন্ত চলেছিল সুখের বাতাস। বিশেষ উদ্যোগে সবার জন্য ছোটগল্প এবং ছাত্রছাত্রীদের জন্য রচনা প্রতিযোগিতা হত।


কিন্তু সুলেখার অস্তিত্বের লড়াই আসলে শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশক থেকেইশুরু হয়েছিল বেশ কিছু সরকারী ভ্রান্ত নীতির ফলে। 

এদিকে দেশ ভাগ হওয়া এবং পূর্ব পাকিস্তান ক্রমাগত অত্যাচারিত হিন্দু বাঙ্গালীর নিজ ভূমি ,ভিটে ছেড়ে ধর্ম ও ইজ্জত রক্ষার্থে ভারতের নানা প্রদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করলেন। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ সকল বাঙ্গালী হিন্দুর আশ্রয় ভূমি হয়ে উঠল। 
 পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভয়ে পালিয়ে এসে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করেও গুটিকয়েক মানুষ, এখন ও সেই দুঃস্বপ্নের  যুক্ত বাংলার জন্য হাহুতাশ করেন। ১৯৪৭ সালের ২০শে জুন বঙ্গীয় আইনসভা ভেঙে তৈরী হল পূর্ববঙ্গ আইনসভা ও পশ্চিমবঙ্গ আইনসভা। দুই আইনসভাতেই অমুসলিম সদস্যরা বাংলাভাগের পক্ষে ও পাকিস্তানে যোগদানের বিপক্ষে ভোট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গঠন সুনিশ্চিত করেন। 
১৯৭১ সালে ৯ মাস ব্যাপী এক দীর্ঘ রক্তাক্ষয়ী, সর্বনাশা সংগ্রামের পর সৃষ্ট হয়েছিল পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক এক স্বাধীন ভূখণ্ড। পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক আগ্নেয় বিশ্বাস, আত্ম-মর্যাদার প্রতি আস্থাবান এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রত্যয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষম এক জাতির। যদিও বর্তমানে এক পক্ষের চিৎকার বারংবার প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে ভারতের অবদান সামান্যই। যদিও ন্যায় ও ইতিহাসের প্রমাণের কষ্টিপাথরে তা কখনোই স্থায়ী হয়না, অভিযোগ চলতেও থাকে, থাকবেও। 
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দু জাতি, জিহাদের নেশায় উন্মত্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারে তো এক ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান কালের হিন্দুরা কি জানেন যে সেই সময়ে মোট কটি গণহত্যা (হিন্দুদেরই বিশেষ করে) হয়েছিল? তাঁরা কখনো আদৌ শুনেছেন শাঁখারীবাজার, শাঁখারীপাড়া, রমনা, সুত্রপুর, চুকনগর, জিঞ্জিরা, শ্রীঅঙ্গন, শতনিখিল, ডেমরা, গোলাঘাট, আদিত্যপুর, কৃষ্ণপুর, বাগবাটি, বরগুনা প্রভৃতি অসংখ্য হিন্দু গণহত্যার কথা? গণহত্যাগুলির ক্ষেত্রে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর সহায়ক (local collaborators) হিসেবে যাঁরা কাজ করেছিলেন সেই রাজাকারদের প্রায় সবাই কিন্তু বাংলা ভাষায় কথা বলতেন। একই বাংলা ভাষায় কথা বলা হিন্দুদের প্রতি তাঁদের মধ্যে কোন অনুকম্পা কিন্তু জাগেনি। অথচ আজ শুনতে হয় যে বাঙ্গালীর একটিই মাত্র পরিচয় যে সে বাংলা ভাষায় কথা বলে!! 


শোনা যায়, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসর পুরান ঢাকার কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী খাজা খয়েরউদ্দিনের নেতৃত্বে ধ্বংস হওয়া রমনা কালী মন্দির ও সংলগ্ন মা আনন্দময়ী আশ্রমের পুনর্নির্মাণের কাতর প্রার্থনা নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী সাধক শ্রী শ্রী পরমানন্দ গিরির বিধবা স্ত্রী শ্রীমতী সুচেতা গিরি ও আশ্রমের সন্ন্যাসিনী জটালী মা শাহবাজ মসজিদের ইমাম জনাব আবদুল আলী ফকিরের নেতৃত্বে দেখা করতে যান এক বিখ্যাত মানুষের  সাথে। সব টাই ছিল ঢক্কানিনাদ। এই হেন কালবেলায় ১৯৭০ – ৭১ সালে উদ্বাস্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ন্যায় মানবিক ভাবনা থেকে সেই সময়ের প্রতিযোগিতা মূলক বাজারে প্রায় ১৫০ অতিরিক্ত কর্মচারী নিয়োগ সম্ভবত সুলেখার পতনকে তরান্বিত করল।বহু ভাবে চেষ্টা করেও ১৯৮৯ সালে সংস্থাটির ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। 

কালির দৌলতে বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে পরিচিত সুলেখা-ও হারিয়ে যেতে বসেছিল। দেড় যুগ কারখানা বন্ধ থাকার পর উৎপাদন শুরু হয়  ২০০৫-৬ সালে। কিন্তু লোকসান এড়ানো যাচ্ছিল না। বিগত আর্থিক বছরে সামান্য লাভের মুখ দেখে সংস্থা। ২০১১-’১২-য় পুঞ্জীভূত লোকসান ছাপিয়ে গিয়েছে লাভের মাত্রা। তবে, এ বার শুধু কালি নয়, ‘সুলেখা’ ব্র্যান্ড-নামকে মূলধন করে সৌরলন্ঠন এবং গৃহস্থালির পণ্য এনেছে সংস্থা। এনেছে উন্নত কালি, কম্পিউটার পার্ট ইত্যাদি। একজন জাতীয়তাবাদী ভারতীয় এবং বাঙ্গালী হিন্দু হিসাবে প্রার্থনা করি আমাদের সাধের সুলেখা স্বমহিমায় ঘুরে দাঁড়াবে এবং আমাদের গর্বিত করবে।


©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ  ১. সুলেখা ওয়েবসাইট ২. সুলেখা লেখচিত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.